যে কারণে ওবায়দুল কাদেরকে বেছে নিলেন শেখ হাসিনা

  25-10-2016 07:19AM


পিএনএস: দেশের অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে কে আসছেন তা নিয়ে শুধু আওয়ামী লীগেই নয়, রাজনীতি সচেতন সব মানুষেরই ব্যাপক আগ্রহ ছিল। অপেক্ষাকৃত ‘কিন ইমেজের’ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামই এ পদে বহাল থাকছেন নাকি পরিশ্রমী রাজনীতিক ওবায়দুল কাদের, নাকি অন্য কেউ। এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা ও নানামুখী বিশ্লেষণ হয়েছে, রাজনীতির টেবিল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায়। অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত রোববার আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে এ পদে আসীন হন ওবায়দুল কাদের।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের একটি অংশ চেয়েছে নেতৃত্বে পরিবর্তন। আরেকটি অংশের চাওয়া সৈয়দ আশরাফই যেন দলের গুরুত্বপূর্ণ এ পদে বহাল থাকেন। তবে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা যে ওবায়দুল কাদেরকে চেয়েছেন তা সম্মেলনের ঠিক আগ মুহূর্তে গণমাধ্যমে বেরিয়ে আসে। দলের নেতারা মনে করেন, নানা হিসাব-নিকাশ করেই ওবায়দুল কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেছে নিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তবে কেন এ পদে তাকে বসানো হলো তা নিয়েও চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে বিভিন্ন মহলে।

আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, আগামী নির্বাচন মাথায় রেখেই ওবায়দুল কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক করেছেন শেখ হাসিনা; যা কাউন্সিলে দেয়া শেখ হাসিনার বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। কারণ, এ কাউন্সিলে দলের ঘোষণাপত্র, এবং শেখ হাসিনার দেয়া প্রায় পুরো বক্তব্য ছিল আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি ও ইশতেহারের মতো।

তাদের মতে, আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিই আগামী নির্বাচন পরিচালনা করবে। সে ক্ষেত্রে দল এমন একজনকে বেছে নিয়েছে, যিনি কঠোর পরিশ্রমী, সাংগঠনিকভাবে দক্ষ এবং কর্মীদের পাশে থাকার মানসিকতা আছে। এটি আগামী নির্বাচনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিনিয়র একজন নেতা জানান, সৈয়দ আশরাফের সময় দল শক্তিশালী হয়েছে ঠিকই; কিন্তু কেন্দ্রের সাথে মাঠের নেতাকর্মীদের যোগাযোগ অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া সৈয়দ আশরাফকে কেউ সহজে পান না বলে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করা হচ্ছিল। এ কারণে হয়তো ওবায়দুল কাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি কমবেশি সবপর্যায়ের নেতাকর্মীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন।

এ নেতা আরো জানান, নির্বাচনের আরো দুই বছর বাকি আছে। এই সময়ের মধ্যে সব জেলা সফর, প্রার্থী মনোনয়নসহ নানা কাজ রয়ে গেছে। ওবায়দুল কাদেরকে এ কাজগুলো করতে হবে। তা ছাড়া বিগত উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন পরিচালনায় প্রধান ছিলেন কাদের। এই নির্বাচনগুলোয় সারা দেশে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করেছেন ওবায়দুল কাদের। এই অভিজ্ঞতা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাজে লাগিয়ে তিনি আবারো দলীয় প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করতে পারবেন এমন ধারণা তার পক্ষে কাজ করেছে।

অন্য এক নেতা বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশ নেয়নি। আগামী নির্বাচনে তা না-ও হতে পারে। এ নির্বাচনে সবাই আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে জয়ী হতে হলে আওয়ামী লীগকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে এখন থেকেই মাঠের নেতাদের সক্রিয় করা জরুরি। সেই বিবেচনায় কাদেরকে বেছে নেয়া হয়।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, এবার দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানার পছন্দের প্রার্থী ছিলেন ওবায়দুল কাদের। সব বিবেচনায় দলের গুরুত্বপূর্ণ এ পদে আসীন হন ওবায়দুল কাদের।

এ ছাড়া সরকারের ইমেজ বৃদ্ধি করতে দিনরাত অবিরাম রাস্তাঘাটে ছুটে বেড়ান ওবায়দুল কাদের। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে নেয় জনগণ। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার রয়েছে জেল-জুলুম ও নির্যাতনসহ ত্যাগের ইতিহাস। আর সবচেয়ে জৌলুশপূর্ণ রাজসিক কাউন্সিল আয়োজন করতে পারায় ওবায়দুল কাদেরের ওপর সন্তুষ্ট হন শেখ হাসিনা। এসব বিবেচনায় তাকে দলের সাধারণ সম্পাদক পদে বেছে নেন তিনি।

অন্য দিকে এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দলের চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে বিশ্বস্ততা ও নেতৃত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সৈয়দ আশরাফ। এরপর টানা সাত বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকাকালে নেতাকর্মীদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখার অভিযোগ থাকলেও তার সততা ও বিশ্বস্ততা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। গত শনিবার আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে আশরাফের আবেগঘন বক্তৃতা নেতাকর্মীদের মন ছুঁয়ে যায়। মাঠের রাজনীতিতে সৈয়দ আশরাফের তেমন ভূমিকা না থাকলেও এক-এগারোর সময় জিল্লুর রহমানের পাশে সৈয়দ আশরাফের ভূমিকা অনেক বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে দলকে রা করে। ফলে ২০১২ সালের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আশরাফের পাশে ওবায়দুল কাদেরের নাম এলেও আশরাফই টানা দ্বিতীয়বার সাধারণ সম্পাদক হন।

এরপর রাজনীতির সঙ্কটময় বিভিন্ন মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফ। বিশেষ করে ২০১৩ সালে র ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান ছত্রভঙ্গ করা, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগ মুহূর্তে জাতিসঙ্ঘসহ বিদেশী প্রভাবশালী দেশগুলোর হস্তক্ষেপ মোকাবেলা এবং বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণে তার ভূমিকা ছিল যুগান্তকারী। দীর্ঘ সময় ধরে সরকার ও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও সৈয়দ আশরাফের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। অভিযোগ উঠেনি কোনো ধরনের তদবির, চাঁদাবাজি বা প্রভাব বিস্তারের। কারো জন্য ক্ষতির কারণ না হওয়ায় দলের নেতাকর্মীসহ সুধী সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান সৈয়দ আশরাফ। সেজন্য গত বছরের ৯ জুলাই স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর পদ থেকে বাদ দেয়ার পর প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাকে নিজের হাতে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব বিবেচনায় দলের কেন্দ্রীয় ও মাঠ নেতাকর্মীদের পছন্দের নেতা ছিলেন আশরাফ।

আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে চীনা প্রেসিডেন্টের যুগান্তকারী বাংলাদেশ সফর এবং বিপুল বিনিয়োগ প্রস্তাবে পাশের প্রভাবশালী একটি দেশ সৈয়দ আশরাফের ওপর চরম নাখোশ হয়। কারণ এই বিষয়টি পুরো দেখভাল করেছেন সৈয়দ আশরাফ। ফলে বিকল্প নেতা হিসেবে ওবায়দুল কাদের ছিলেন তাদের পছন্দের প্রার্থী। কাউন্সিলে এ বিষয়টিও প্রভাব ফেলেছে।

তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, সৈয়দ আশরাফ নিজেই দলের গুরুত্বপূর্ণ এ পদে থাকতে চাননি। এর আগেও তিনি একাধিকবার এ পদ থেকে সরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার আগ্রহের কারণে তিনি সরে যেতে পারেননি। এবার পদ ছেড়ে অনেকটাই হাফ ছেড়ে বাঁচেন সৈয়দ আশরাফ। ফলে সহজেই ওবায়দুল কাদেরের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পথ সুগম হয়।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন সিনিয়র নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, সৈয়দ আশরাফের মতো নেতাকে আরেকটু সুন্দরভাবে বিদায় দেয়া যেত। নেতাদের মুখে, গণমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে বিষয়টি আগেভাগে ছড়িয়ে দেয়া হয়, তাতে আশরাফ কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন।

আবার এ বিষয়টিকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ। দলের আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, সম্মেলনস্থলে বিষয়টি নিয়ে যাতে নতুন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সে জন্য আগে থেকে বিষয়টি বাজারে ছেড়ে দেয়া হয়। যাতে নেতাকর্মীরা বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেন।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন