চমকের নেপথ্যে নির্বাচন

  25-10-2016 08:06AM


পিএনএস ডেস্ক: আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো বাকি দুই বছর, তবে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ঘর গোছানো শুরু করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলের সদ্য সমাপ্ত ২০তম জাতীয় সম্মেলন থেকে সেই ইঙ্গিতই মিলেছে। নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন, কাউন্সিলে দলীয় সভাপতির বক্তব্য, দলের ঘোষণাপত্র, জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি—সব কিছুতেই নির্বাচনী প্রস্তুতির পূর্বাভাস রয়েছে। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যে কমিটি গঠন হচ্ছে তাদের মূল কাজ হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলকে বিজয়ী করা। সেই লক্ষ্যেই স্বচ্ছ ভাবমূর্তি থাকা সত্ত্বেও সাধারণ সম্পাদক পদে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে কর্মীবান্ধব ওবায়দুল কাদেরকে। এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তাঁদের মতে, ওবায়দুল কাদের কর্মীবান্ধব নেতা। দলের তৃণমূলের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ভালো। তিনি নিয়মিত দলীয় কার্যালয়ে যাবেন, তৃণমূলে যোগাযোগ রাখবেন। নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাঁর সাংগঠনিক শক্তি, ব্যক্তি যোগাযোগ ও জনসংযোগ দলের কাজে লাগবে। বিষয়টি মাথায় রেখেই হয়তো এবারের কমিটিতে তাঁকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সম্মেলনের আগে থেকেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় নেতাদের আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। সম্মেলনের প্রথম দিনও নেতাদের উদ্দেশে বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করুন। জনগণের মন জয়ের মধ্য দিয়ে আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করতে হবে।’ দ্বিতীয় দিন কাউন্সিল অধিবেশনে দলের তৃণমূল নেতাদের তিনি আওয়ামী লীগকে ফের ক্ষমতায় আনতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি পর্ব, মূল আয়োজন ও সভাপতির বক্তব্যে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির যে বার্তা ছিল, কমিটি গঠনেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। এ থেকেই স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতিকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে।

আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত কয়েকজন নেতাও জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ের মধ্যে দিয়ে দলকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসাই নতুন কমিটির মূল চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে নতুন কমিটিকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি—তিন ধরনের লক্ষ্য পূরণে কাজ করতে নির্দেশনা দিয়েছেন সভাপতি শেখ হাসিনা। স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য হলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলকে বিজয়ী করা। মধ্যমেয়াদি লক্ষ্য হলো ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা। আর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। সে জন্য নির্বাচনে বিজয়ী হওয়াকেই নতুন কমিটির সবচেয়ে বড় কাজ বলে মনে করছে দলের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী ফোরাম।

আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখেই আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে হাতে আর বছর দুয়েক সময় আছে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই খেয়াল করা গেছে, আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মকাণ্ডে ভাটা পড়েছে। নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে দলের কর্মকাণ্ড গতিশীল করতে হবে। ধারণা করি, ওবায়দুল কাদেরকে দলের সাধারণ সম্পাদক করার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। পেছনে আর কোনো কারণ আছে কি না বলতে পারব না, তবে বাইরে থেকে দেখে আমার এটিই মনে হচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলে একজন গতিশীল নেতার প্রয়োজন ছিল। এ ক্ষেত্রে ওবায়দুল কাদেরকে বেছে নেওয়া ভালো হয়েছে।’

লেখক, বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সরকারের কোনো ভুলভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা হয়নি। সেটি হওয়া উচিত ছিল। এতে দলও লাভবান হতো, দেশও লাভবান হতো। নেতাকর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। যেকোনো বড় দলই চাইবে নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে। আওয়ামী লীগের নতুন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জনবান্ধব নেতা ও পরিশ্রমী। তাঁকে দিয়ে দলের উপকার হবে। কিন্তু আগামী নির্বাচন কিভাবে প্রধান দলগুলোর অংশগ্রহণে হবে তার কোনো রূপরেখা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল থেকে পাওয়া যায়নি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টিতে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকাই প্রধান। তাদের আস্থা সৃষ্টির কাজটি করতে হবে। নতুন কমিটি যদি সেই লক্ষ্যে কাজ করে তাহলে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। তা না হলে আওয়ামী লীগ লাভবান হলেও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন,‘সম্মেলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলে নতুন রক্ত সঞ্চালন হয়। দলের কর্মসূচি প্রণয়ন হয়, কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন হয় ও দল শক্তিশালী হয়। আওয়ামী লীগে যে নতুন নেতৃত্ব এসেছে তাঁদের অভিনন্দন। সভাপতি পদে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। অন্য পদগুলোতেও যাঁরা এসেছেন তাঁরা অভিজ্ঞ নেতা। তাঁরা দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলেই আমার বিশ্বাস। দলকে এগিয়ে নিয়ে গেলে দেশকেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। এবারের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভাপতি নেতাকর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতির যে কথা বলেছেন এবং মানুষের মন জয় করে নির্বাচনে জয়লাভের যে পরামর্শ দিয়েছেন তা ইতিবাচক।’

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী দল। সামনের নির্বাচন নিশ্চয়ই দশম নির্বাচনের মতো হবে না। আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। সেই নির্বাচনের পথে দলকে এগিয়ে নিতে ওবায়দুল কাদেরের সক্রিয় ভাবমূর্তি সহায়ক হবে। এই চিন্তা থেকেই হয়তো তাঁকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। সড়কমন্ত্রী হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের রাস্তায় ছোটাছুটি মানুষের মনে অন্তত এ ধারণা তৈরি করতে পেরেছে যে, হি ইজ ট্রায়িং হিজ বেস্ট। এটি দলটির নির্বাচনের প্রচারণায় কাজে লাগতে পারে।’

ড. কলিমউল্লাহ আরো বলেন, ‘ভারত, নেপাল, চীন থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, কানাডা ও যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক নেতাদের এ সম্মেলনে যোগ দেওয়া ও বক্তব্য রাখার একটি প্রতীকী দিক রয়েছে। সম্মেলনে বিদেশি নেতাদের উপস্থিতি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কৌলীন্যের স্বীকৃতি। এ ছাড়া তাঁদের উপস্থিতি একই সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলটির দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্পের (২০২১ ও ২০৪১) প্রতি তাঁদের সমর্থনেরও প্রমাণ।’

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও বলছেন, এবারের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরালোভাবে শুরু হলো। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘একটি বর্ণাঢ্য ও সুশৃঙ্খল সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কাউন্সিলররা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে প্রবীণ ও নবীনের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটির লক্ষ্য আগামী নির্বাচনে দলকে বিজয়ী করা। ওবায়দুল কাদেরের মতো একজন উদ্যমী নেতা দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। এটি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জন্য একটি ভালো খবর। নতুন কমিটির নেতারা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে সরকারের সফলতা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জনগণের সামনে তুলে ধরে তাদের মন জয় করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনবেন।’

নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও জানান, নতুন কমিটি আগামী নির্বাচনে জয়লাভের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে। তিনি বলেন, ‘আমরা দুটি এজেন্ডা হাতে নিয়েছি। এক সাম্প্রদায়িক পরাশক্তিকে পরাজিত করা, দুই আগামী নির্বাচনের জন্য দলের প্রস্তুতি নেওয়া। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে আমরা নির্বাচনে জয়লাভ করব। বেশি এজেন্ডা হাতে নেওয়া উচিত নয়, এতে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে যায়। অনেক ডিম একসঙ্গে এক ঝুড়িতে রাখলে ভেঙে যেতে পারে।’

দলে গুণগত পরিবর্তনের জন্য কাজ করবেন জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আরো গুণগত পরিবর্তন হবে। এই চেঞ্জমেকার দেশরত্ন শেখ হাসিনা। দলের নেতাকর্মীদের আচার-আচরণ বদলাতে হবে। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। সর্বোপরি তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে। নিজেদের বদলাতে না পারলে আমরা দেশকে পরিবর্তন করতে পারব না। আমাদের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে।’

আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন,‘বিএনপি একটি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে খেসারত দিচ্ছে। সংসদে কিংবা সংসদের বাইরে কোথাও বিরোধী দলের স্ট্যাটাস নেই। আবার যদি তারা ভুল করে তবে ভুলের চোরাবালিতে আটকে থাকতে হবে তাদের।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখনই কোনো কমিটি গঠন করেছে সে কমিটি মানুষের কল্যাণে কাজ করেছে। এবারের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আমাদের সামনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি—এই তিন ধরনের লক্ষ্য পূরণের কাজ করতে বলেছেন। স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য হলো ২০১৯ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ। মধ্যমেয়াদি লক্ষ্য হলো ২০২১ সালে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা। আর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। এ তিনটি লক্ষ্য পূরণে নতুন কমিটি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করবে। কেন্দ্রীয় কমিটি এখনো পূর্ণাঙ্গ হয়নি। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হলে তারা অতীতের যেকোনো কমিটির চেয়ে ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করবে বলে মনে করি।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন