অস্থিরতা কাটছে না তৃণমূল আওয়ামী লীগে

  28-02-2017 09:08AM


পিএনএস ডেস্ক: তৃণমূলের অস্থিরতা কোনোভাবেই কাটাতে পারছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কেন্দ্র থেকে নানা হুমকি-ধমকি দিয়েও কার্যকরী কোনো ফল আসছে না। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে দল ক্ষমতায় আসার পর থেকে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দল গোছানোর পরিবর্তে বেড়ে চলেছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। প্রতিনিয়ত টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সাথে নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে। মূল দলের সাথে তাল মিলিয়ে দলটির সহযোগী ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরাও নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে গণমাধ্যমে শিরোনাম দখল করছেন। আধিপত্য বিস্তারে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে নিজেদের মধ্যেই খুনোখুনি ঘটাচ্ছেন তারা। কখনো কখনো ক্ষমতাসীনদের সংঘর্ষের বলি হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। গতকালও সিলেটের নবগঠিত ওসমানী নগর উপজেলায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে কিশোর সাইফুল ইসলাম নিহত হয়েছেন।

জানা গেছে, আগামী ৬ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আতাউর রহমান ও বিদ্রোহী প্রার্থী আক্তারুজ্জামান চৌধুরীর সমর্থকেরা গতকাল সকালে মিছিল বের করেন। মিছিল দু’টি মহাসড়কে মুখোমুখি হলে দুই গ্রুপের সমর্থকদের মধ্যে বাগি¦ত-া শুরু হয়। একপর্যায়ে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে সাইফুল ইসলাম নিহত হন। এ দিন মাগুরার বেঙ্গাবেরইল ও জাঙ্গালিয়া গ্রামেও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে উভয় পরে ২৫ জন আহত হয় এবং বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। রাঘবদাইড় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মোহন মুন্সী গ্রুপের নেতা আসলাম লস্কর ও সাধারণ সম্পাদক আবুল বাসার নান্নু গ্রুপের নেতা খবির জোয়াদ্দারের সমর্থকদের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়। এর আগে ২০ ফেব্রুয়ারি মহম্মদপুরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন আহত হয়। একই দিনে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে কমপক্ষে সাতজন আহত হয় এবং নোয়খালীর হাতিয়া উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক পক্ষ আরেক পক্ষের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত ২৪ জন আহত হয়। গত ২ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ভিপি রহিম ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পৌরমেয়র হালিমুল হক মিরুর সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়। ওই সময় কর্তব্য পালন করতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ওই দিন রাতে শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান মডেল কলেজের অধ্য গোলাম হাসান খানকে কুপিয়ে আহত করে নিজ দলের লোকজন। এর এক দিন পর শুক্রবার কুষ্টিয়া সদরের জিয়ারখালী ইউনিয়নে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আফজাল হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় ইদ্রিস আলী নিহত হন। তার আগে বুধবার রাতে খুন হন নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্রবিলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রভাষ রায়। গত ২২ ফেব্রুয়ারি টেন্ডার নিয়ে চট্টগ্রাম নগরভবনে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষে সাতকানিয়া উপজেলার সদাহা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত নিহত হন।

এর আগে ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার নিজামপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক নুরুল আমিন মুহুরী নিহত হন। গত ১২ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় একটি জলমহাল দখলকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও স্থানীয় এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মতিউর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে রক্তয়ী সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন নিহত হন। এর আগের দিন সোমবার রাতে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিরোধের জের ধরে বড়মাছুয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কাইয়ুম হোসেনকে কুপিয়ে জখম করেন প্রতিপরে নেতাকর্মীরা। একই দিনে রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে সিট ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এর আগে ১০ জানুয়ারি আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজ সিকদার এবং সাবেক চেয়ারম্যান শফিউদ্দিনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হোসেন খাঁ নিহত হন। গত ৩ জানুয়ারি বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক কাজী মজিবুর রহমানের বাসভবনে হামলা চালায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এর আগের দিন কক্সবাজারের চকরিয়ায় ইয়াবার টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ইটের আঘাতে আহত হন এক প্রবীণ শিক্ষক। নতুন বছরের শুরুতেই গণমাধ্যমের শিরোনামে আসে খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ। মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জেড এ মাহমুদকে ল্য করে প্রতিপক্ষের গুলি ল্যভ্রষ্ট হয়ে এক পথচারী নারী নিহত হন। এ ঘটনায় জেড এ মাহমুদ অভিযোগ করেন, মাদক ব্যবসার বিরোধিতা করায় তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এর আগে গত বছর ৩১ জুলাই খুলনায় ছাত্রলীগ নেতা সৈকতকে খুন করে প্রতিপরে নেতাকর্মীরা। ১৭ জুলাই একই গ্রুপের সদস্য আল আমিন ওরফে তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নতুন বছরের শুরুতেই স্থানীয় পর্যায়ে নেতাকর্মীরা অনেকটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মাঝে কিছুটা বিরতি দিলেও এ মাসের শুরুতে আবারো মারামারি ও সংঘর্ষ শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম মুখপাত্র ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। তৃণমূল পর্যায়ে সব সময় ছোটখাটো মতদ্বৈধতা থাকে। তিনি বলেন, দল যেহেতু টানা দুইবার ক্ষমতায় আছে সেহেতু আমাদের দলে কিছু স্বার্থান্বেষী লোক প্রবেশ করেছে বলে আমরা মনে করি। ওই মহলই এসব কর্মকা- ঘটাচ্ছে। যারা এ ধরনের নেতিবাচক কর্মকা-ের সাথে যুক্ত থাকবে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনায় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূলের অস্থিরতা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে এখন এক ধরনের সুবিধাবাদিতা কাজ করছে। সিনিয়রদের পাশাপাশি জুনিয়ররাও আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, আর্থিক সংশ্লিষ্টতার ক্ষেত্রে একে অপরের কাছে ভাগ বসাতে চায়। তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও রয়েছে। দলের মধ্যে শৃঙ্খলা কম থাকায় কেউ কাউকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের ব্যস্ততা সম্পূর্ণরূপে রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে সিলেটে তারা যথাযথভাবে মনোযোগ দিতে পারছেন না। শুধু সিলেট নয়, সারা দেশের চিত্র এ রকমই। ফলে এসব কর্মকা- ঘটছে। সূত্র: নয়াদিগন্ত

পিএনএস/আনোয়ার


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন