বিবাদ বাড়ছে সরকারি জোটে

  24-05-2017 07:09AM


পিএনএস ডেস্ক: নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন জোটের সংসারে বিবাদ দেখা দিয়েছে। ১৪ দলের শরিক দলগুলোর সংসদ সদস্য ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। কোথাও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দলীয় ফোরামে শরিকদের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়ছে, কোথাও আবার হামলা চালিয়ে এ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। গত কয়েক দিনে নরসিংদীতে জাসদ নেতার ওপর হামলা হয়েছে। চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দলীয় ফোরামে শরিক দল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে এ দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করছে জোট শরিকরা।

জানতে চাইলে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১৪ দলের ঐক্য অটুট রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। আমরা মনে করি এটাই হওয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ঐক্য আরো দৃঢ় করতে হবে। এখন আওয়ামী লীগের কোনো জেলা বা মহানগর যদি দাবি করে সে জেলার সব আসন তাদের দিতে হবে তাহলে ধরে নিতে হবে তারা আসলে ১৪ দলের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চায়। এর মধ্য দিয়ে তারা জামায়াত-বিএনপিকেই লাভবান করবে। আমি মনে করি, ১৪ দলের শরিকদের মর্যাদা ও আসন বুঝিয়ে দেওয়া আওয়ামী লীগের দায়িত্ব। তাদের মনে রাখতে হবে এ ঐক্যের কারণেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব হয়েছে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন। এ ঐক্য যদি ব্যর্থ হয় তাহলে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ঐক্য ভাঙার কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। ’

জাসদ (আম্বিয়া) সভাপতি শরিফ নুরুল আম্বিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছেন। এ নির্বাচন ১৪ দলগতভাবে করার কথা হয়েছিল বেশ আগেই। এখন কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এগুলো হয়তো বা নির্বাচনকেন্দ্রিক সমস্যা। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তা শেষ হয়ে যাবে। ’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১৪ দলের এক বাম নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নির্বাচন এলেই তৃণমূলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শরিকদের ওপর হামলা চালিয়ে কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের দাবিয়ে রাখতে চায়। এটা নতুন কিছু নয়। তবে সিদ্ধান্ত যা হওয়ার কেন্দ্র থেকেই হবে। নির্বাচনী এলাকায় শরিক দলের নেতাকর্মীদের মারধর করে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। ’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, ‘ওসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এগুলো আমাদের ঐক্যে কোনো প্রভাব ফেলবে না। জাতীয় পর্যায়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি। ’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নরসিংদীর পলাশে জাসদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে। সেখানে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। সম্প্রতি নরসিংদী-২ (পলাশ) আসনে এলাকাবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ও দোয়া চেয়ে পোস্টার লাগান নরসিংদী জেলা জাসদের সভাপতি জায়েদুল কবির। তিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন নরসিংদী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও পলাশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল আশরাফ খানের ছোট ভাই কামরুল আশরাফ খান। সম্প্রতি জায়েদুল কবিরের পোস্টার লাগানোর ঘটনায় ক্ষিপ্ত হন কামরুল আশরাফ খান। এর জেরে শুক্রবার রাতে দাঙ্গা ইউনিয়নে নিজ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হন জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশীদ। এ সময় তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও ভাঙচুর করা হয়। আহত হারুন-অর-রশীদকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এ হামলার ঘটনার মধ্যেই আজ বুধবার সদর উপজেলার পাঁচদোনা মোড়ে জাসদ ও শ্রমিক লীগ পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডেকেছে। সমাবেশস্থলে জাসদের মঞ্চ তৈরিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এতে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর প্রধান অতিথি থাকার কথা রয়েছে।

জানতে চাইলে নরসিংদী জেলা জাসদের সভাপতি জায়েদুল কবির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এমপি কামরুলের ঘনিষ্ঠ সদর উপজেলার মেহেরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান আমাদের মঞ্চ তৈরিতে বাধা দিচ্ছেন। এমপির লোকরা জাসদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ’

হারুন-অর-রশীদের ওপর হামলার ঘটনা প্রসঙ্গে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নামধারী একদল চিহ্নিত গুণ্ডা এর আগেও নরসিংদীতে জাসদ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমরা আওয়ামী লীগ নামধারী এই গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। ’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য ও জাসদ নেতা রেজাউল করিম তানসেনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এর জেরে কিছুদিন আগে কাহালু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র হেলাল উদ্দিন কবিরাজ উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভা বয়কট করেন। এ সময় তানসেনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্লোগান দেয়। পরে পুলিশ পাহারায় ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন সংসদ সদস্য।

কাহালু উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, তানসেনের নানা কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ কাহালু ও নন্দীগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। গত দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য থাকাকালে তানসেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে রেখেছেন। তাঁর নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। ফলে আগামী নির্বাচনে তিনি যাতে বিজয়ী হতে না পারেন সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থেকে নির্বাচিত জাসদ (আম্বিয়া) সংসদ সদস্য মঈন উদ্দীন খান বাদলের ওপর ক্ষুব্ধ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। গত ২২ এপ্রিল উত্তর জেলা ও ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন। সভায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মঈন উদ্দীন খান বাদলের নানা কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করে। তাদের অভিযোগ, বোয়ালখালীতে নেতাকর্মীরা কোণঠাসা। ফলে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নেতারা আগামী নির্বাচনে বোয়ালখালী থেকে আওয়ামী লীগের যোগ্য ও ত্যাগী কোনো নেতাকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান।

রাজশাহী মহানগর এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশার সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দূরত্ব বাড়ছে। এ আসনে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার দুজনেরই নির্বাচন করার আগ্রহ রয়েছে। রাজশাহীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসনটিতে নিজেদের সংসদ সদস্য না থাকার কারণে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করে সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। তারা লিটন ও ডাবলু দুজনকেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে। নেতাকর্মীরা দলীয় বিভিন্ন ফোরামে বাদশার বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে।

১৪ দলের শরিক জাতীয় পার্টি-জেপির নেতা রুহুল আমিন বিগত সংসদ নির্বাচনে কুড়িগ্রাম-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাকির হোসেনকে পরাজিত করেন। তবে হাল ছাড়েননি জাকির হোসেন। তিনি আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরেই এমপিকে এড়িয়ে চলছেন জাকির হোসেন। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে এই দূরত্ব ও বিরোধ আরো বেড়ে যাবে বলে মনে করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

জানা যায়, বরিশাল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা টিপু সুলতানের বিরুদ্ধেও সক্রিয় হয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি একাধিক বৈঠকে তারা বরিশালের সব আসনে মূল দল থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানায়। জোটগত কারণে আসন ছেড়ে দেওয়ায় সেখানে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মত তাদের।

সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা মুস্তফা লুত্ফুল্লাহ এবং নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা শেখ হাফিজুর রহমানের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে। এসব এলাকার জোটের মূল দলের নেতাকর্মীরা সংসদ সদস্যদের প্রায় সব কাজেরই বিরোধিতা করে চলেছে।

জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার, জাসদ (আম্বিয়া) সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধানের নির্বাচনী এলাকাতেও আওয়ামী লীগের একটি অংশ তীব্র বিরোধিতায় নেমেছে। তারা এসব সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ জানাচ্ছে। প্রসঙ্গত, ক্ষমতাসীন ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আছে চারটি দলের। ওয়ার্কার্স পার্টির ছয়টি, জাসদের পাঁচটি, তরীকতের দুটি, জাতীয় পার্টি-জেপির দুটি।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন