‘ভিন্ন কৌশলে’ নির্বাচনী প্রস্তুতি বিএনপির

  27-05-2017 09:52AM


পিএনএস ডেস্ক: নির্দলীয় সহায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়, এমন অবস্থান আপাতত বিএনপিতে দৃশ্যমান হলেও ভেতরে ভেতরে তাদের ভোট-প্রস্তুতিও চলমান। তবে তা চলছে কিছুটা ‘ভিন্ন কৌশলে’ অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক বা কাগজে-কলমে নয়। কাউকে ডেকে অথবা কেউ সাক্ষাৎ করতে গেলে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাঁকে মনোনয়নের সবুজ সংকেত দিচ্ছেন। এ ছাড়া লন্ডনে বসবাসকারী দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সম্ভাব্য প্রার্থীদের কাউকে কাউকে ‘আশ্বাস’ দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে ২০ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে আসন বণ্টন বিষয়ে কোনো কথা না হলেও তাদেরও মূল্যায়ন করবে বিএনপি। এর প্রধান কারণ হলো, শত প্রতিকূল অবস্থায়ও গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। এ ছাড়া সরকারি জোটের বাইরে থাকা দলগুলোকে বেশ কিছু আসনে ছাড় দিয়ে ‘সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট’-এর ব্যানারে নির্বাচনে যাওয়ার চিন্তাও রয়েছে বিএনপির; যদিও মনোনয়ন বা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এ পর্যন্ত দলটির মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক হয়নি। তবে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলেন, সহায়ক সরকারের প্রস্তাবনা উপস্থাপনার পর তৃতীয় ধারার ওই দলগুলোর প্রতিক্রিয়া দেখে জোট গঠনের বিষয়ে আলোচনা শুরু হবে। বিকল্প ধারা, গণফোরাম, জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, নাগরিক ঐক্যসহ প্রগতিশীল দলগুলোকে কাছে টেনে বেশ কিছু আসনে ছাড় দিতে চায় বিএনপি। সূত্র মতে, এ দলগুলো যাতে সাড়া দেয় সেদিকে লক্ষ রেখেই সহায়ক সরকারের প্রস্তাবনা আগামী ঈদের পর উপস্থাপন করবে বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন অবশ্য মনে করেন, সহায়ক সরকার বাস্তবায়িত না হলে তাঁদের নির্বাচনে যাওয়া একরকম অনিশ্চিত। এর পরও নির্বাচনের প্রস্তুতি এমন বড় কিছু নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বিএনপিতে কে কোথায় এমপি ছিলেন এবং কার কী অবস্থান সেটি চেয়ারপারসনের অজানা নয়। এমনকি আমরাও এ দলের সাবেক এমপিদের চিনি। চেয়ারপারসন প্রায় সবার নাম জানেন। ফলে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলে অংশগ্রহণ কোনো কঠিন বিষয় নয়। ’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বৃহত্তর ঐক্য করার প্রস্তাব বিএনপি চেয়ারপারসন দিয়ে রেখেছেন। ঈদের পরে সহায়ক সরকারের প্রস্তাব উপস্থাপনের পর রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতে, ‘নির্বাচনে যাওয়ার জন্য বিএনপির প্রস্তুতি কোনো ব্যাপার নয়। কারণ দলে এমন কোনো নেতাকর্মী নেই যাঁকে ম্যাডাম চেনেন না। তা ছাড়া গত দুটি নির্বাচনের প্রার্থী ও ফলাফল আমাদের সামনে আছে। ’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনা না হলেও জোটের শরিকদের অবশ্যই যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। কারণ শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা আমাদের পাশে ছিল। বৃহত্তর স্বার্থে আগ্রহী সব দলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনের চিন্তা আমাদের আছে। ’

বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ মনে করেন, দুর্দিনে বিএনপির পাশে থাকা জোটের শরিকদের মূল্যায়নের বিষয়টি পুরোপুরি বিএনপি চেয়ারপারসনের এখতিয়ার। তবে জোটভুক্ত দলগুলোর আশা-আকাঙ্ক্ষায় কিছুটা যৌক্তিকতা থাকা দরকার। বিশেষ করে নির্বাচনী আসন নেই বা বিজয় নিশ্চিত নয় এমন প্রার্থীদের একটু হিসাব করে মনোনয়ন চাওয়া উচিত। তিনি আরো বলেন, ‘অনেক বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে এলডিপি থেকে অলি আহমদ এবং বিজেপি থেকে আমি জয়লাভ করেছি। জোটেও কেউ আগে, কেউ পরে এসেছে। সব মিলিয়ে জোটভুক্ত দলগুলোর হিসাবও সমান নয়। ’

বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি বিএনপির সব সময়ই আছে। ভিশন ২০৩০ রূপকল্প নির্বাচনে যাওয়ার জন্যই উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলেও বিএনপি তাতে অংশ নেবে। ’

প্রসঙ্গত, ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে জামায়াতকে ৩১টি, বিজেপিকে সাতটি এবং ইসলামী ঐক্যজোটকে ছয়টি আসনে ছাড় দেয় বিএনপি। আর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জামায়াতকে ৩৫টি, বিজেপিকে দুই, ইসলামী ঐক্যজোটকে দুই এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামীকে দুটিসহ শরিকদের মোট ৪১টি আসন ছেড়ে দেওয়া হয়। আগামী নির্বাচনে নিবন্ধন না থাকা জামায়াতকে অত বেশি আসনে ছাড় দিতে হবে না বলে মনে করে বিএনপি।

সূত্র আরো জানায়, আসন বণ্টন বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য এবং কেন্দ্রীয় একজন ভাইস চেয়ারম্যান সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপারে প্রতিবেদন তৈরি করছেন। তাঁদের সামনে রয়েছে গত তিনটি নির্বাচনের ফলাফল। তাতে প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোট, সম্ভাব্য প্রার্থীর দলে ভূমিকা ও তত্পরতা বিবেচনায় নিয়ে একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন খালেদা জিয়াকে দেওয়া হবে। যেসব আসনে বিএনপির প্রার্থী বা সাবেক এমপি মারা গেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের অগ্রাধিকার দেওয়ার চিন্তা আছে।

ভিন্ন কৌশলে প্রস্তুতি খালেদার

গুলশান কার্যালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মনোনয়ন বা আসন বণ্টন প্রশ্নে বিএনপিতে এ পর্যন্ত কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে ‘নির্বাচনের প্রস্তুতি রাখা দরকার’—এ ধরনের পরামর্শ সিনিয়র বেশ কয়েকজন নেতা খালেদা জিয়াকে দিয়েছেন। জবাবে চেয়ারপারসন বলেছেন, ‘৩০০ আসনের অন্তত আড়াই শ প্রার্থী বা সাবেক এমপিকে আমি নিজেই চিনি। আপনারাও তাঁদের চেনেন। মনোনয়নে কোনো সমস্যা হবে না। ’ ইতিমধ্যে দু-একজন প্রার্থীকে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় কাজ করার সবুজ সংকেতও তিনি দিয়েছেন বলে জানান খালেদা।

সাম্প্রতিককালে গুলশান কার্যালয়ে এ ধরনের আলোচনার প্রেক্ষাপটের খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনে কাজী নাজমুল হোসেন তাপসকে ডেকে খালেদা জিয়া তাঁর মনোনয়ন নিশ্চিত করেন। তাপস ওই আসনের সাবেক এমপি সদ্যঃপ্রয়াত কাজী আনোয়ার হোসেনের ছেলে। জানতে চাইলে কাজী তাপস মনোনয়নের ব্যাপারে সবুজ সংকেত পাওয়ার কথা স্বীকার করেন।

সর্বশেষ গত ২৩ মে মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ-৫ আসনের মনোনয়ন নিয়ে খালেদা জিয়া কথা বলেন জেলার দুই নেতা কলিমউদ্দিন আহমেদ মিলন ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে। সুনামগঞ্জ জেলার সভাপতি হতে আগ্রহী ওই দুই নেতাকে ‘অপশন’ দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, একজনকে জেলা সভাপতি এবং অন্যজনকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। গুলশান কার্যালয়ে সুনামগঞ্জ জেলা কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেন। তবে সাবেক এমপি কলিমউদ্দিন মিলন দাবি করেন, সুনামগঞ্জ জেলা কমিটি নিয়ে বৈঠকে ম্যাডাম কেবল বলেছেন, আপনারা যান, নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কমিটি পৌঁছে যাবে। এর বেশি কিছু তিনি বলেননি।

সূত্র মতে, এ ছাড়া বিভিন্ন আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেতে আগ্রহী একাধিক নেতা সাম্প্রতিক সময়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁদের মধ্যে নীলফামারী-১ আসনে মরহুম মশিউর রহমান যাদু মিয়ার মেয়ে রিটা রহমান, বগুড়া-৭ আসনে সাবেক ছাত্রনেত্রী সেলিনা আক্তার, নেত্রকোনা-৩ আসনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ আলমগীর ও কেন্দুয়া উপজেলা চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দুলাল, নেত্রকোনা-১ আসনে এলডিপি নেতা (বিএনপির সাবেক হুইপ) আবদুল করিম আব্বাসী, কিশোরগঞ্জ-৪ আসনে ড্যাব নেতা ডা. ফেরদৌস আহমেদ লাকী, ময়মনসিংহ-৩ আসনে ড্যাব নেতা ডা. আবদুস সেলিম ও কৃষক দলের নেতা ফয়সাল আমিন খান পাঠান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে আশুগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান আবু আসিফ আহমেদ, কিশোরগঞ্জ-১ আসনে মনোনয়নের জন্য সাবেক জেলা জজ রেজাউল করিম খান চুন্নুসহ অনেকের কথা জানা গেছে। সূত্র মতে, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার লন্ডনে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও দেখা করেছেন।

জানতে চাইলে আবদুল করিম আব্বাসী বলেন, ‘এলডিপির প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে বৈঠক করতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। জোটভুক্ত দল থেকে মনোনয়ন চাই আমি। তবে এ ব্যাপারে চেয়ারপারসন আমাকে কিছু বলেননি। ’

সরকারে গুরুত্বহীন হবে বিতর্কিতরা

গত ১০ মে উপস্থাপিত ভিশন ২০৩০ নামের রূপকল্পে ‘বিএনপি দুর্নীতির সঙ্গে কোনো আপস করবে না’ বলে খালেদা জিয়া অঙ্গীকার করায় বিগত জোট সরকারের সময়ে দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত নেতারা মনোনয়ন পাবেন কি না তা নিয়ে দলটির মধ্যে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে খবর নিয়ে জানা গেছে, হাওয়া ভবনের নাম ভাঙিয়ে চলা বিতর্কিত নেতাদের মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তবে মনোনয়ন এবং সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় তাঁরা যে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বেন সে বিষয়টি নিশ্চিত বলে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, যেসব নেতার কারণে তারেক রহমানের ভাবমূর্তি খারাপ হয়েছে, তাঁদের মনোনয়ন পাওয়া কঠিন হবে। তাঁর মতে, বিকল্প শক্তিশালী প্রার্থী না থাকায় কিছু আসনে হয়তো তাঁদের কেউ কেউ মনোনয়ন পেলেও সরকারে অর্থাৎ মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হবে না, এটি নিশ্চিত।

উল্লেখ্য, বিগত জোট সরকারের সময়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে একজন পূর্ণ মন্ত্রীর সঙ্গে কোথাও একজন, আবার কোথাও দুজনকে (প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যাঁদের অনেকের ভূমিকার কারণে হাওয়া ভবন তথা তারেক রহমানের ব্যাপারে জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে বলে বিএনপিতে আলোচনা আছে। এ ছাড়া তারেকের নাম ভাঙিয়ে চলা অপেক্ষাকৃত তরুণ কিছু সংসদ সদস্যের ভূমিকাও এ জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। ফলে আগামী নির্বাচনে ওই নেতাদের মনোনয়নের ব্যাপারে বিএনপি সতর্ক থাকবে বলে জানা গেছে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন