খালেদা-তারেকের সাক্ষাৎ নিয়ে রাজনীতিতে উত্তাপ, কী বলছেন আ.লীগ-বিএনপি নেতারা?

  21-07-2017 12:45PM


পিএনএস ডেস্ক: বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর ঘিরে রাজনীতিতে উত্তাপ ক্রমেই বাড়ছে। বিএনপি নেতারা এটাকে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত তথা চিকিৎসার জন্য সফর বললেও আওয়ামী লীগ তা মানতে নারাজ। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

এদিকে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই খালেদা জিয়ার এই লন্ডন সফরের গুরুত্ব নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনা চলছে। চলছে নানা হিসেব নিকেশ। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান বেশ কয়েক বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে বিএনপির রাজনীতিতে তিনি যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেন বলেও শোনা যায়।

বেগম জিয়ার এই সফরে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সহায়ক সরকারের রূপরেখা এবং আন্দোলনের ছক তৈরি, লন্ডন থেকে ফিরেই আন্দোলনের কর্মসূচি, দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্তকরণসহ জাতীয় রাজনীতির ইত্যাদি বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে বলে এরই মধ্যে বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।

বিএনপির অধিকাংশ নেতা এসব খবরকে গুজব বলে উড়িয়ে দিলেও সরকারি মহলে এ নিয়ে রয়েছে এক ধরনের টেনশন। যা ইতোমধ্যেই তাদের বক্তব্য বিবৃতি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

সফরটি একান্তই খালেদার ব্যক্তিগত ও চিকিৎসার জন্য হলেও তা রাজনীতিতে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। ক্রমেই আলোচনা-সমালোচনার ডালপালা গজাচ্ছে। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় এসেছে খালেদার সফরটি।

বৈঠক সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে যা বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশ নেয়া একজন মন্ত্রী অনির্ধারিত আলোচনায় বলেন, উনি (খালেদা) গেছেন, কিন্তু আসবেন কি না, কেউ জানে না। মন্ত্রীর এমন উক্তি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেখেন ফিরে আসেন কি না?’

শুধু তাই নয়, খালেদা জিয়া লন্ডন যাওয়ার একদিন পরই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বলছেন মামলার ভয়ে খালেদা জিয়া পালিয়ে গেছেন। তিনি আর দেশে ফিরবেন না বলেও তারা সন্দেহ প্রকাশ করছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মামলার ভয়ে খালেদা জিয়া পালিয়ে লন্ডন চলে গেছেন। মামলার ভয়ে খালেদা জিয়া আর ফিরে আসবেন না বলেও সন্দেহ প্রকাশ করেন ওবায়দুল কাদের।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরকে ইঙ্গিত করে কাদের এও বলেন, আমাদের শক্তির উৎস বাংলাদেশের জনগণ। বিদেশে বসে শেখ হাসিনাকে হটানোর ষড়যন্ত্র সফল হবে না।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, দেশে বন্যা হচ্ছে অথচ খালেদা জিয়া তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে মানি লন্ডারিং মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতে ও তার মামলার রায় বিলম্ব করতেই লন্ডনে গেছেন। বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র করে কোনো লাভ হবে না।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসা করাতে নয়, ষড়যন্ত্র করতে লন্ডনে গেছেন বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ।

হাছান মাহমুদ বলেন, খালেদা জিয়া লন্ডনে গেছেন। বিমানবন্দরে মা-ছেলে কান্নাকাটি করেছেন। মা-ছেলে কান্নাকাটি করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে তার দলের ছোড়া পেট্রলবোমার আগুনে শত শত মানুষ পুড়ে মরেছে। তাদের জন্য আকাশ-বাতাস কেঁদেছে। তিনি তো একবারও চোখের পানি ফেলেননি।

খালেদা জিয়াকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বমহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছ।

তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, ‘ওবায়দুল কাদের সব সময়ই মিথ্যা বলতে পটু। সত্য বলার রেকর্ড তার কমই। বিএনপি নেতাকর্মীসহ দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতেই খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে ওবায়দুল কাদের এমন মিথ্যাচার করছেন। তারা এও বলছেন, খালেদা জিয়া পালিয়ে লন্ডন যাননি। এটা তার পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল। যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে কয়েক হাজার নেতাকর্মী তাকে বিদায় জানিয়েছেন। তার নেত্রীরই বরং পালিয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে। খালেদা জিয়া জীবনের চেয়ে দেশকেই বেশি ভালবাসেন।’

অন্যদিকে খালেদা জিয়া যাতে দেশে ফিরতে না পারে এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো চক্রান্ত হচ্ছে কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিএনপি নেতারা। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা একই সঙ্গে এই বিষয়টির অবতারণা করাতে এ ব্যাপারে তাদের সন্দেহ সংশয় ঘনীভূত হয়েছে। তবে সরকার এমনটা করতে চাইলেও সম্ভব হবে না বলেও বিশ্বাস করেন তারা।

খালেদা জিয়ার লন্ডন গমনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কর্তৃক তার দেশে ফিরে আসা নিয়ে সংশয় প্রকাশের পর বিএনপি নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়া অবশ্যই ফিরবেন। দেশে ফিরে তিনি আগামী দিনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেতৃত্বও দেবেন।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এমন কথা বলা তার উচিত হয়নি। ২০১৫ সালে যখন খালেদা বিদেশ গিয়েছিলেন, তখনও আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছিলেন, তিনি আসবেন না। কিন্তু তিনি ফিরেছিলেন। এবারও বিএনপির চেয়ারপারসন দেশে ফিরবেন।’

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আওয়ামী লীগের স্বরূপ মিথ্যা দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘গণমানুষের নেত্রী খালেদা জিয়া আপোষহীনভাবে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনে তিনি এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। এখন তো ফ্যাসিবাদী শাসন চলছে। ফলে এই সময়ে তিনি দেশ ও জনগণকে ফেলে সেখানে থাকবেন, এটা বিশ্বাস করা যায় না।’

রিজভী বলেন, ‘যে নেত্রী শত-শত নির্যাতনের মধ্যে লড়াই করছেন, তিনি ফিরে আসবেন না, এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। তিনি অবশ্যই তার চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরবেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন।’

এছাড়াও বিএনপির সিনিয়র এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আওয়ামী লীগ তথা সরকারের লোকজন যাই অপপ্রচার করুক না কেন, ম্যাডাম জিয়া নতুন মেসেজ নিয়েই দেশে ফিরবেন। তিনি দেশে ফিরেই দলকে চাঙ্গা করে সুষ্ঠু নির্বাচন আদায়ে সরকার বিরোধী আন্দোলনে যেতে পারেন। সেজন্য সরকারী মহলে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার হচ্ছে। কেননা, দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান খুবই তীক্ষ্ণ জ্ঞানের অধিকারী, ফলে ক্ষমতাসীনরা এটাকে কিছুটা ভয় পাচ্ছে।

তবে বিএনপির মধ্যম সারির নেতারা দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন। কেননা, দলের সারাদেশের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সেটাই প্রত্যাশা করে এবং এর মাধ্যমে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হবেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন, সফরটি ব্যক্তিগত হলেও দলের দুই শীর্ষ নেতৃত্বের সাক্ষাতে রাজনীতি নিয়ে সার্বিক আলোচনা হওয়া আর এতে ভবিষ্যতের কর্মকৌশলও ঠিক হওয়ার মানুষের ধারণা করার বিষয়টি একেবারে অমূলক নয়। কেননা, সবার কাছে এটা পরিষ্কার যে তারেক রহমান একজন তীক্ষ্ণ রাজনীতিবিদ।

অবশ্য এই নেতার বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি গত বুধবার লন্ডনে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই শীর্ষ নেতা জানান, বর্তমানে যুক্তরাজ্য সফরে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারেকের সব বিষয়ে কথা হবে। সবকিছু নিয়ে তারা আলোচনা করবেন।

প্রসঙ্গত, ১৫ জুলাই যুক্তরাজ্য সফরে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর যুক্তরাজ্যে খালেদা জিয়ার এটি তৃতীয় সফর। এর আগে ২০১৫ সালে ১৬ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন। এছাড়া ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে ফেরার পথে লন্ডনে গিয়েছিলেন। ওই সময়ে লন্ডনে বড় ছেলে তারেক রহমানসহ তার পরিবারের সঙ্গে দুই মাসেরও অধিক সময় কাটিয়েছিলেন। এবারো সেখানে প্রায় দুমাসই কাটাতে পারেন বলে জানা যাচ্ছে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন