নির্বাচনে অংশ নেওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ বিএনপির

  15-11-2017 08:03AM


পিএনএস ডেস্ক: নির্বাচন মোটামুটি নিরপেক্ষ হলেই বিএনপি ক্ষমতায় যাবে—এমন আলোচনা ও বিশ্বাস এখন দলটির গণ্ডি পেরিয়ে বাইরেও ছড়িয়েছে। ফলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ এবার কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি নয় বিএনপি।

তবে শেষ পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে কি না সে বিষয়টি বিএনপির কাছে এখনো স্পষ্ট হয়নি। দলটির নেতাদের মতে, এ ক্ষেত্রে অনেক বাধা আছে। এমনকি উসকানিও থাকতে পারে। ফলে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়াই বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচন সামনে রেখে দলটির মধ্যে নানা শঙ্কা কাজ করছে। সবচেয়ে বেশি শঙ্কা জিয়া ট্রাস্টে দুর্নীতিসংক্রান্ত দুটি এবং ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলা নিয়ে। ওই সব মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সাজা হতে পারে বলে বিএনপির পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনেও আলোচনা চলছে। এ ছাড়া বিএনপির অন্য সিনিয়র নেতাদেরও বিভিন্ন মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার আশঙ্কা আছে। দলের নেতারা মনে করছেন, এমনটি করা হলে সেটিকে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার উসকানি হিসেবেই গণ্য করা হবে।

দেশের অন্য কয়েকটি রাজনৈতিক দলও বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে অনেক বাধা দেখছে। ওই দলগুলোর নেতারা বলছেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ফল কার পক্ষে যাবে সেটি বলা মুশকিল। তবে এটুকু বলা যায়, ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে পরাজয়ের কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাইবে বলে মনে হয় না।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। তবে বিএনপি যাতে ওই নির্বাচনে না যায় এমন কর্মকৌশল তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেও নেওয়া হয়েছিল বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে। অনেক পর্যবেক্ষক এমনও মনে করেন, বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ নিলে ফল অন্যরকমও হতে পারত। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠককালে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। বৈঠকে উপস্থিত বিএনপির একাধিক নেতা জানান, তাঁদের উদ্দেশ করে সুষমা বলেন, নির্বাচন বর্জন কেন করেছেন? বর্জন কোনো সমাধান নয়। বরং অংশ নিলে ফল তো অন্যরকমও হতে পারত।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, সার্বিক পরিস্থিতিতে বিএনপি এবার বেশ সতর্ক। একান্ত বাধ্য না হলে নির্বাচন প্রশ্নে কোনো হঠকারিতা করতে এবার রাজি নয় দলটি। গত ১২ নভেম্বরের জনসভায় খালেদা জিয়ার বক্তব্যও বেশ কৌশলগত বলে মনে করা হয়। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না, হবেও না। কিন্তু গত নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনার অধীনে এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। ’ এবার ওই রকম কঠোর কোনো কথা তিনি বলেননি। বরং ক্ষমতায় গেলে ‘প্রতিশোধ’ প্রশ্নেও তাঁর বক্তব্য ভারসাম্যমূলক ছিল। অর্থাৎ ইতিবাচক অবস্থানে থেকে বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে—এমন বার্তাই দলটি স্পষ্ট করতে চাইছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, প্রথমত দলীয় নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখার জন্য এই কৌশল। দ্বিতীয়ত নির্বাচন বর্জন করার দায় যাতে বিএনপির ওপর না বর্তায় সেটি স্পষ্ট করার জন্যই ওই সতর্কতা। তবে এ ধরনের সতর্কতা সত্ত্বেও নির্বাচন সামনে রেখে দলটির মধ্যে নানা শঙ্কা কাজ করছে।

এর বাইরে বিএনপির ‘সহায়ক সরকারে’র (এখনো রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়নি) দাবি পুরোপুরি উপেক্ষা করে বর্তমান সরকার ও সংসদ বহাল রেখে এবং সরকারি দলের ছক অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বিএনপির জন্য তাতে অংশ নেওয়া কঠিন হবে বলে মনে করেন দলের নেতারা। দলীয় সূত্র মতে, নির্বাচনের আগে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েও বিএনপিতে দুশ্চিন্তা আছে। এ জন্যই দলটি সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি তুলেছে।

সাজা হলে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে খালেদা জিয়া নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কি না তা নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। কেউ কেউ এমন আশঙ্কাও করছেন, উচ্চ আদালতে জামিন নিয়ে নির্বাচন করার বিধানও ক্ষমতাসীন মহল থেকে পরিবর্তন করা হতে পারে। তবে এমন ব্যবস্থা বা বিধান সত্যিকার অর্থে করা হলে খালেদা জিয়াকে ছাড়াই বিএনপি যাবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। আবার আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমনকি দলের নিবন্ধনও বাতিল হয়ে যাবে—এমন আশঙ্কাও বিএনপির মধ্যে রয়েছে।

অবশ্য সব কিছু বিবেচনায় নিয়েও কৌশলগত কারণে অনবরত নির্বাচনে যাওয়ার কথাই বলতে হচ্ছে বিএনপিকে। সম্প্রতি একাধিক বক্তৃতায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে যাবেই।

বিএনপিকে কেন এ ধরনের কথা জোর দিয়ে বলতে হচ্ছে জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আসলে বিএনপি যাতে নির্বাচনে না যেতে পারে এ জন্য সরকার নানা ষড়যন্ত্র করতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। যেমন তারা মামলায় সাজা দিতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে কোনো দাবিই পূরণ করলাম না; কিন্তু বললাম নির্বাচনে আসো। এমন পরিস্থিতি হলে নির্বাচনে যাওয়া কঠিন। কিন্তু তার পরও বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলছে। কারণ হলো, ন্যূনতম নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেই বিএনপি ক্ষমতায় যাবে এটি এ দেশের জনগণও এখন বোঝে। তাই আমরা নির্বাচনে টিকে থাকতে চাই। ’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে যেতে চায় এবং যাবে। তবে যাওয়ার জন্য যে পরিবেশের দরকার সেটি না থাকলে কী করব না করব তা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ’ নির্বাচনে যাবই এ কথা কেন জোর দিয়ে বলতে হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথমত নির্বাচনের ব্যাপারে নেতাকর্মী ও জনগণকে চাঙ্গা রাখতে এটি বলতে হচ্ছে। আর দ্বিতীয় কারণের কথা কৌশলগত কারণে বলা যাবে না। ’

তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সরকার অনেক উসকানি দেবে এবং বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করবে—এমন শঙ্কা আছে। কিন্তু তার পরও শেষ পর্যন্ত আমরা ধৈর্য ধরে নির্বাচনে টিকে থাকতে চাই। ’ তিনি বলেন, এটি বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ। এখন সরকার পক্ষ যদি তাদের স্বার্থে অনড় থেকে বিএনপিকে বাইরে রাখার ষড়যন্ত্র করে সে দায় বিএনপির নয়।

বিএনপি নির্বাচনে যেতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত যেতে পারবে কি না সে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে থাকা কয়েকটি দলের নেতারাও। তাঁদের মতে, এ ক্ষেত্রে অনেক বাধা আছে।

সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করতে চাইছে। দ্বিতীয়ত, অনেক রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের মতো আমারও মনে প্রশ্ন, শেখ হাসিনা কী পরাজিত হওয়ার জন্য নির্বাচন করবেন? তাই প্রশ্নবোধক রেখেই বলতে চাই, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। ’

এক প্রশ্নের জবাবে বিকল্প ধারার সভাপতি বলেন, জনমনে আলোচনা হলো, বিএনপি যাতে নির্বাচনে না যায় এমন ব্যবস্থা সরকারই তৈরি করবে। যেমন খালেদা জিয়াসহ সিনিয়র নেতাদের সাজা হলে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া কঠিন হবে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল বলে মনে করেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। তাঁর মতে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না যাওয়া বিএনপির অন্যতম বড় ভুল ছিল।

সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দর আকবর খান রনো অবশ্য মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে যাবে। তবে সব দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা অর্থনৈতিক বৈষম্য বা অর্থের খেলা। তিনি বলেন, এই খেলা বন্ধ না হলে ভালো নির্বাচন সম্ভব হবে না।

বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, ‘বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া কিছুটা কঠিন। কারণ বিএনপি বলছে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ বলছে, শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে হবে। প্রশ্ন হলো কোনটা টিকবে?’ তিনি আরো বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যদি নিরপেক্ষ সরকার মানে তাহলে তাদের নির্বাচনের আগেই ক্ষমতা ছাড়তে হয়। আরেকটি বড় প্রশ্ন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সাজা হওয়ার পরও বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না। আবার সাজা দিয়ে যদি সব দলকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয় সে ক্ষেত্রে কী হবে তাও আরেকটি প্রশ্ন। ফলে এক কথায় নির্বাচন হয়ে যাবে এমনটি ভাবার কারণ নেই। ’

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘দুই দল নিজ নিজ জায়গায় অনড় আছে। বিএনপি বলছে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে না। আওয়ামী লীগ বলছে তারা সংবিধানের বাইরে যাবে না। এখন খালেদা জিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই অবস্থানের পক্ষে মানুষকে হাত তুলিয়েছেন। ফলে বোঝা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করতে চাইবে। এ অবস্থায় আগামী দিনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা কম। তবে আওয়ামী লীগ এবারও এ ধরনের নির্বাচন হজম করতে পারবে কি না সেটি এখনো বলতে পারছি না। ’ সূত্র: কালের কণ্ঠ

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন