জোট গঠনে ফের ব্যর্থ বি চৌধুরী ও ড. কামাল

  22-11-2017 03:39AM

পিএনএস ডেস্ক: বহু বছর একসঙ্গে চলে এবারও জোট গঠন করতে পারলেন না বিকল্প ধারার সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (বি চৌধুরী) ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। উদারপন্থী বলে পরিচিত এ দুই নেতা বিকল্প একটি জোট গঠনের জন্য গত পাঁচ বছরে অন্তত ১০টি বৈঠক করেছেন।

সর্বশেষ গত শনিবার দলীয় বৈঠকে গণফোরাম ‘একলা চলার’ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ওই উদ্যোগ পুরোপুরি ভেস্তে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

যদিও গণফোরাম নেতারা বলছেন, এখনই জোট গঠন সম্ভব না হলেও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে উদারপন্থী দলগুলোকে তাঁরা সমর্থন দেবেন। তবে অন্য দলগুলো এই আশ্বাসে বিশ্বাস করতে রাজি নয়। সর্বশেষ গত সোমবার রাতে বি চৌধুরীর বাসায় জোট গঠনে আগ্রহী দলগুলোর বৈঠকেও গণফোরাম যায়নি। দলগুলোর মধ্যে আশাবাদ সত্ত্বেও বৈঠকে যাননি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও।

অবশ্য ইতিমধ্যে তৃতীয় ধারার বিকল্প একটি জোট গঠনে তৎপর অন্য চারটি দলের মধ্যে বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্প ধারা, আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য একমত হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এখনো দোদুল্যমান থাকায় সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ সম্ভাব্য এই জোটকে রসিকতা করে ‘সাড়ে তিন দলীয়’ বলে অভিহিত করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুটি দলের শীর্ষপর্যায়ের দুই নেতা জানান, কাদের সিদ্দিকী অর্ধেক এদিকে (সম্ভাব্য জোটে), অর্ধেক ওদিকে (সরকারের সঙ্গে) আছেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।

ফলে কামাল হোসেন জোটে না এলেও একে চারদলীয় জোট বলার সময় এখনো আসেনি বলে তাঁরা মনে করেন। অবশ্য চার দলের বাইরে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ভাসানী অনুসারী পরিষদ ওই জোটের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে।

ভাসানী অনুসারী পরিষদ একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির মহাসচিব শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু। তিনি বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরী সংগঠনটির চেয়ারম্যান। অন্যদের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. জসিমউদ্দিন আহমেদ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা কামরুল হুদা ও আমিনুল ইসলাম সেলিম, মুন্সীগঞ্জের সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান, কুষ্টিয়া সদরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফরুল্লাহ চৌধুরী খান লাহোরী, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক ডেপুটি মেয়র খালেকুজ্জামান চৌধুরী, বরিশালের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ফোরকান উদ্দিন আহমেদসহ প্রগতিশীল ধারার আরো অনেক ব্যক্তি সংগঠনটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়।

নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অনুরোধেই দেড় মাস ধরে জোট গঠনের প্রক্রিয়া আটকে ছিল। কারণ তিনি চেয়েছিলেন পাঁচদলীয় জোট হোক। কিন্তু হঠাৎ করে গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে কাউকে কিছু না জানিয়ে ড. কামাল হোসেন বিদেশে চলে গেলে জোটের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। কারণ এর আগে ২১ সেপ্টেম্বরই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সভায় জাতীয় পর্যায়ে নাগরিক কমিটি গঠন করে বিভাগীয় শহরে সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল; সেখানে বি চৌধুরীর সঙ্গে ড. কামাল হোসেনও উপস্থিত ছিলেন। ফলে ক্ষুব্ধ অন্য দলগুলো কামাল হোসেনকে বাদ দিয়েই ওই সময় জোট গঠনের প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু এ পর্যায়ে ড. কামাল হোসেনের দেশে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করার অনুরোধ করেন দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

গত ৮ নভেম্বর ড. কামাল দেশে ফিরলেও গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সভা ডাকা হয় ১৮ নভেম্বর। ফলে ওই পর্যন্ত স্থগিত থাকে জোট গঠনের প্রক্রিয়া। এদিকে গণফোরামের বৈঠকে দুই ধরনের মতামত উঠে আসে। দলের বড় অংশটি জোট গঠনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে বলে, জোটে না থেকে একা থাকলে রাজনীতিতে গণফোরামের টিকে থাকা কঠিন হবে। আরেক অংশ সময় নিয়ে ও সাংগঠনিকভাবে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে জোট গঠনের কথা বলে।

সূত্র মতে, নেতাদের মতামত দেওয়ার সময় ড. কামাল নিশ্চুপ ছিলেন। তবে তিনি বলেন, দলের সব পর্যায়ের বৈঠক করে আগে সাংগঠনিক শক্তি সম্পর্কে জানা যাক; এরপরে জোট গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। তবে গণফোরামের সর্বশেষ এই অবস্থানের পর বাদবাকি দলগুলো আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। ফলে গত সোমবার রাতে গণফোরাম ছাড়াই তারা বৈঠকে বসে। সূত্রমতে, গণফোরাম বৈঠকে যাবে না একথা আগেই বি চৌধুরীকে জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কাদের সিদ্দিকীর যোগদান না করার ঘটনাটি ছিল অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। তাই আগামীকাল বৃহস্পতিবার অথবা পরদিন শুক্রবার অনুষ্ঠেয় পরবর্তী বৈঠকে কাদের সিদ্দিকীর জন্য অপেক্ষা করা হবে। ওইদিন তিনি বা তার দল বৈঠকে যোগ না দিলে প্রাথমিকভাবে তিন দল নিয়েই জোট ঘোষণার সিদ্ধান্ত হবে।

এ বিষয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানান, গণফোরাম জোটে যাবে না, তারা একলা চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে বাকি দলগুলো এখন জোট গঠন করবে, এটিই স্বাভাবিক। ভাসানী অনুসারী পরিষদও জোটে থাকবে বলে জানান তিনি।

চারদলীয় জোট হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এখনো সম্মতি জানায়নি বলে শুনছি। ’ ফলে একে সাড়ে তিনদলীয় জোট বলা যায়। তবে প্রগতিশীল অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন এতে থাকবে। যোগ করেন বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা।

এদিকে গণফোরামের অবস্থান জানতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত রায় চৌধুরী জানান, ‘দলের নেতৃস্থানীয় নেতাদের বৈঠকে জোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নয়; বলা হয়েছে আগে দলের কাঠামো গুছিয়ে ও শক্তি সঞ্চয় করে জোটে যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা একটু সময় নিচ্ছি, অ্যাসেসমেন্ট করছি, এই আর কি!’

বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের অভিপ্রায় নিয়ে প্রথমে ২০১২ সালের ২১ অক্টোবর একমঞ্চে উঠে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন বি চৌধুরী ও কামাল হোসেন। ওই সময়ই আ স ম রব, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ প্রগতিশীল বেশ কয়েকটি দলের নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তি ওই উদ্যোগকে সমর্থন করেন। এরপর ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কাকরাইলের ঈসা খাঁ হোটেলে মতবিনিময়সভা করা হয়; সেখানেও উপস্থিত ছিলেন ওই দলগুলোর নেতারা। তবে পাঁচটি দল নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় চলতি বছর। এ বছর আ স ম রবের উত্তরার বাসা, পরে বি চৌধুরীর বারিধারার বাসা এবং বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নানের বাসায় দলগুলোর একাধিক বৈঠকে জোট গঠনের প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া হয়। তবে বি চৌধুরীর ব্যাপক আগ্রহ ও চেষ্টা সত্ত্বেও সব সময় ড. কামাল হোসেন কৌশলী ভূমিকা পালন করে সময়ক্ষেপণ করেছেন বলে দলগুলোর মধ্যে আলোচনা আছে। একই সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীও ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করছেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নেতারা। তবে আ স ম রব ও মাহমুদুর রহমান মান্না সব সময় জোট গঠনের পক্ষে তৎপর ছিলেন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী জানান, তাদের (গণফোরাম) হয়তো কোনো অসুবিধা আছে, এ জন্য আসবে না। কাদের সিদ্দিকীর জন্য অবশ্য অপেক্ষা করা হবে। কিন্তু জোট গঠনের প্রস্তুতি চলবে। তিনি বলেন, ‘কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও এখনো চূড়ান্ত মতামত জানায়নি। জোটে থাকবে এ কথাও জোর দিয়ে বলেনি; আবার থাকবে না এ রকমও জানায়নি। কিন্তু আমরা অপেক্ষা করে আছি। ’ কেউ না এলে আপাততো তিন দল নিয়েই শুরু করা হবে; জানান বিকল্প ধারার সভাপতি বি. চৌধুরী।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী জানান, জোট গঠনের বিষয়ে বলার মতো এখনো কিছু হয়নি।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না জানান, বিকল্প জোট গঠনের প্রস্তুতি অনেক দিন ধরেই চলছে। এখন গণফোরাম যদি না থাকে সে ক্ষেত্রেও বসে থাকা যাবে না। বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যেতে হবে।

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন