দিল্লির দৃষ্টিতে খালেদা জিয়ার দণ্ড ও ঢাকার রাজনীতি

  20-02-2018 10:03AM


পিএনএস ডেস্ক: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডাদেশকে নয়া দিল্লির সরকার কিভাবে দেখছে তা নানাভাবে বিশ্লেষণ করছেন ভারতীয় বিশ্লেষক ও মিডিয়াগুলো। এরই মধ্যে কয়েকজন প্রভাবশালী বিশ্লেষক এ নিয়ে নিবন্ধ লিখেছেন।

তাদের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে দিল্লির উদ্বেগের কথা। বিশেষ করে ঢাকার রাজনীতির ভবিষ্যতকে দিল্লি কিভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আর ভারতের কি করণীয় তাও তুলে ধরা হয়েছে ওইসব নিবন্ধে। নিম্নে সেসব নিবন্ধের বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো-

ভারতীয় শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডাদেশ লাভের ঘটনাকে আইনের শাসনের দিক থেকে নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে মূল্যায়ন করেছে। মিডিয়া পরিষ্কার করেছে যে, খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ সত্ত্বেও দিল্লি আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ দেখতে আগ্রহী।

ভারতীয় মিডিয়া সাধারণভাবে বলেছে, মিসেস জিয়ার দণ্ডাদেশকে সরকারিভাবে দিল্লি ‘পাথুরে নীরবতা’য় উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু তারা বেশি উদ্বিগ্ন এই ভেবে যে, এই মামলার কারণে যদি খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, আর তার পরিণতিতে বিএনপি যদি নির্বাচন বয়কট করে, তাহলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ একটি ‘কম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে’ রূপান্তরিত হতে পারে। বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়া এবং ইসলামী রেডিক্যালদের মনোভাব বিবেচনায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, আওয়ামী লীগের কোনো কোনো অংশের আপত্তি অগ্রাহ্য করে যে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, সেই তথ্যও প্রকাশ করা হয়েছে।

গত ৯ই ফেব্রুয়ারি ‘একটি সংকীর্ণতম মাঠ’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলেছে, ‘দুর্নীতি মামলায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নেতা বেগম খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর জেল হয়েছে। কিন্তু জনসাধারণের দৃষ্টিতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, খালেদা জিয়ার কারাবরণের ঘটনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপক রাজনৈতিক ক্ষমতা আরো বেশি সংহত করার পথ তৈরি করে দেবে।

চলতি বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি নেত্রী ও তার দলকে যদি অংশগ্রহণ করতে না দেয়া হয়, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ অনুরূপ অবাধ ক্ষমতা আরো সুসংহত করতে পারে। অনেকের মতে, এমনকি তিনি বাংলাদেশকে একটি কম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে আগ্রহী হতে পারেন।’

এক্সপ্রেস লিখেছে, ‘অবশ্যই সেই দিনটি এখনো বেশ দূরে। কিন্তু বাস্তবতা এটাই রয়ে গেছে যে, ১৯৭৫ সালে আততায়ীর বুলেটে তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যরা নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে একজন তেজদ্দীপ্ত সাহসী নারী হিসেবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকারীর ভাবমূর্তি থেকে দ্রুত সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। একটি রক্তস্নাত যুদ্ধ থেকে জন্ম নেয়া দেশটি তখনো পর্যন্ত তারুণ্য উদ্দীপ্ত ছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশিরা ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কারণ এটা প্রতীয়মান হয়েছে যে, তিনি স্বজনপ্রীতি-দুর্নীতি এবং উপদলীয় কোন্দলকে মার্জনা করেছেন এবং তার ক্রমশ অজনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে এসব অবদান রেখেছে। সার্বিক বিচারে মিসেস জিয়ার বিরুদ্ধে তিনি নিজকে তার ভয়ানক ব্যক্তিগত বৈরিতার ঊর্ধ্বে উঠাতে সক্ষম হননি। তিনি বিশ্বাস করেন যে, জামায়াতে ইসলামী, যে দলটির কিছু সদস্য স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানি শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, তাদের সঙ্গে বিএনপির আঁতাত রয়েছে। এর কিছু অভিযোগের সত্যতা থাকতে পারে। শেখ হাসিনার ব্যাপক মানসিক আঘাত এবং প্রতিশোধের জন্য তার একটি ব্যক্তিগত অভিপ্রায় হয়তো বোধগম্য। কিন্তু একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, যার হাতে দেশটির নেতৃত্ব, তিনি যদি ঘৃণার বেদিতে দেশটির ভবিষ্যৎ সমর্পণ করেন, তাহলে তা শুধুই তাকে ম্লান করতে পারে এবং তার দেশকে অধঃপতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

শেখ হাসিনা একটি গণতান্ত্রিক স্পেস বা স্থান সৃষ্টি করতে অসামর্থ্যের পরিচয় দিচ্ছেন। যেখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলকে বাংলাদেশের জনগণ বিচার করতে পারবে। আর এর ফলে এমন একটি ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে, যাতে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ওই স্বাধীনতা যুদ্ধে খালেদা জিয়ার স্বামী তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান, যিনি ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন, তিনিসহ অধিকাংশ বাংলাদেশি, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। শেখ হাসিনা যদিও সন্ত্রাসী এবং ইসলামী উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তদুপরি তাকে দেখা হবে এমন একটি পরিস্থিতি তিনি সৃষ্টি করছেন, যা মিসেস জিয়াকে টেনে নামানোর এবং যাতে প্রকারান্তরে একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের বীজ বপন করা হবে। দুর্নীতির দায়ে বেগম জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত ভালোই করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে আরো গভীরভাবে তলিয়ে দেখা দরকার যে, আজ তার দরকার একটি গণতান্ত্রিক এবং সহানুভূতিপ্রবণ জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে নেতৃত্ব দেয়া।’

উল্লেখ্য যে, দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গত ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের দিনেই পত্রিকাটির কনসাল্টিং এডিটর জ্যোতি মালহোত্রা লিখেছিলেন, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর জেল হওয়ার কারণে ঢাকা ঝড়ের মধ্যে পড়েছে। দিল্লিকে করেছে উদ্বিগ্ন। জিয়ার দণ্ডাদেশ লাভে দিল্লিতে চলছে পাথুরে নীরবতা। দিল্লি বিশ্বাস করে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন আরো অধিকতর ক্ষমতার পরিধি বিস্তার করার ঝুঁকি নেবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ শাসনে শেখ হাসিনাই ‘বেস্ট বেট’ (শ্রেষ্ঠ বাজি) রয়ে গেছেন। মালহোত্রা মনে করেন, খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বাংলাদেশকে একটি ঝড়-তুফানের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তার আশঙ্কা, আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে।

দুই নেত্রীর মধ্যে তিক্ততার গভীরতার দিকে আলোকপাত করতে গিয়ে মালহোত্রা উল্লেখ করেছেন যে, ‘দেশটির সবচেয়ে দুই ক্ষমতাধর নারীর মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেন, “তিনি আজ কোথায়”? মালহোত্রা অবশ্য স্পষ্ট করেছেন যে, মিসেস জিয়াকে যদি আগামী নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় এবং এর আগের নির্বাচনের মতো বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে, তাহলে শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ কোনো প্রকৃত বিরোধী দল ছাড়াই দেশ শাসন করবে। কিন্তু সেটা হবে দিল্লির অসন্তোষের কারণ। তার কথায়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দিল্লিতে ঢাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী একটি স্টাবলিশমেন্ট, তারা ইসলামী উগ্রপন্থিদের তরফের চাপ এবং টানাপড়েনে মনোযোগী এবং একটি দ্রুত প্রভাবশালী হয়ে ওঠা চীন কর্তৃক ঢাকার প্রতি আর্থিক সহায়তা প্রদানের ঘটনাবলী সত্ত্বেও তারা এটা স্পষ্ট করেছে যে, ভারত শেখ হাসিনার ‘‘গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগের’’ প্রতি সমর্থন দেবে। কিন্তু দিল্লি একইসঙ্গে শান্তভাবে শেখ হাসিনার প্রতি এই আহ্বান রেখেছে যে, বিরোধী দল বিএনপি, যার সঙ্গে তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে দ্বন্দ্বে লিপ্ত রয়েছেন; সেই দলটি যাতে দৃষ্টিগোচরভাবে আসন্ন নির্বাচনে ন্যূনতম অংশগ্রহণ করে, যাতে তা তিনি নিশ্চিত করেন। এ বিষয়ে দিল্লির যুক্তি হলো, একটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশটির গণতান্ত্রিক ভিন্নমত সিস্টেমের মধ্যে থেকে উত্তমরূপে মোকাবিলা করতে পারবে, বিরোধী দলকে বাইরে রেখে নয়।

মালহোত্রা আরো লিখেছেন, এটি একটি যুক্তি যে, যদিও শেখ হাসিনা তার প্রধানমন্ত্রিত্বের গত চার বছরে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, বেসামরিক স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর উপস্থিতি সম্প্রসারণ এবং বাংলাদেশে চীনাদের স্বাগত জানানোর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠলেও দিল্লির ওই পরামর্শের প্রতি সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচারণ করবে না। মালহোত্রার মতে, দিল্লি নির্দিষ্টভাবে ২০১৫ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফর থেকে দ্রুত চীনা প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি নজর রাখছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার সফরকালে ২৬ বিলিয়ন ডলারের একটি চেক কেটে শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশিরা চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন কিনেছেন এবং চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় চীনা কোম্পানিগুলোকে কিছু অবকাঠামো গড়ে তুলতে দিয়েছেন। দিল্লি এসব বিষয়কে একটি ‘পয়েন্ট’ হিসেবে নিয়েছে। সেকারণে ২০১৭ সালের অক্টোবরে ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ মিসেস জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। যদিও আওয়ামী লীগের একটি অংশ বলেছিল, মিসেস জিয়ার সঙ্গে সুষমা স্বরাজের সাক্ষাৎ করা ঠিক হবে না।

মালহোত্রা তার উপসংহার টেনেছেন এই বলে যে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় মিসেস জিয়ার দণ্ডাদেশ এবং যে মামলায় ২১ মিলিয়ন টাকা তছরুপের দায়ে তার ছেলে তারেক রহমানকে দশ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়, সেসব ঘটনাকে শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা আরো সংহত করার পথ হিসেবে নেবেন। তিনি এবং তার আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্বাস করেন যে, দুর্নীতি দমন আদালত থেকে মা ও তার ছেলে উপযুক্ত শাস্তিই পেয়েছে। আদালত ব্যাখ্যা করেছে যে, বিদেশি অনুদান লাভ করার ঠিক আগে কেন ওই ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছিল?

এছাড়াও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি নিয়ে একটি চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন ভারতের সনামধন্য সাংবাদিক ভরত ভূষণ। বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন,‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়, এমন কোনো হস্তক্ষেপ করার মতো কাজ ভারত আবার করবে বলে মনে হয় না। ২০১৪ সালের মতো, আওয়ামী লীগের নেওয়া কৌশলকে সমর্থন দেওয়া ঠিক হবে না। প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে—কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না ভারতের। যদি কোনো পরামর্শ চাওয়া হয়, তবে ভারতের উচিত এমন পদক্ষেপ নেওয়া, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করবে এবং জনগণের ইচ্ছার মূল্যায়ন করবে।’

ঢাকার রাজনৈতিক বিষয়ে নয়াদিল্লির নাক গলানো উচিত হবে না বলেও মন্তব্য করেন এই খ্যাতিমান সাংবাদিক। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের সংবাদমাধ্যম ডেকান ক্রনিকলে প্রকাশিত বিশ্লেষণধর্মী এক নিবন্ধে তিনি এ মন্তব্য করেন। বৃহস্পতিবার নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে।

প্রকাশিত নিবন্ধে নয়াদিল্লির সাংবাদিক ভরত ভূষণ বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না। তিনি লিখেছেন, ‘সাধারণ নির্বাচনের বছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির দায়ে সাজা দিয়েছেন আদালত। পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের এই আদেশ যদি না বদলায়, তবে হয়তো খালেদা জিয়াকে ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য হবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া না দেখানোর নীতি নিয়েছে। আর এ বিষয়টিকে দেখা হয়, শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন হিসেবে।’

এর আগে হিন্দুস্থান টাইমসের অনলাইন সংস্করণে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ভারতকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিতে হবে, তবে তা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাশ কাটিয়ে নয়।

২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনকে ‘একপেশে’ আখ্যা দিয়ে ভরত ভূষণ তার নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। কিন্তু ভারত তাতে অঘোষিত সমর্থন দিয়েছিল। সেই নির্বাচনে সংসদের প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। কম ভোট পড়লেও ভারতের সমর্থনে ওই নির্বাচন বৈধতা পেয়েছিল।’

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সাংসদেরা। ওই নির্বাচনে ৪৩ শতাংশ ভোট পড়েছিল বলে দাবি করে নির্বাচন কমিশন। যদিও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ নির্বাচনে মাত্র ৫ শতাংশ ভোট পড়েছে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যে অগ্রগতি হয়েছে, বিএনপির শাসনামলে তা হয়নি। এমন মন্তব্য করে ভরত ভূষণ আরও বলেন, ‘আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে আওয়ামী লীগ যে কৌশল নিয়েছে, ভারত তাতে সমর্থন দিতে পারে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উন্নতির ধারা বজায় রাখার আশাতেই এ অবস্থান নিতে পারে ভারত। কিন্তু এ কাজ করলে, নির্দিষ্ট দল বা নেতাকে সমর্থন দেওয়ার একই ভুল করবে ভারত। নেপাল ও মালদ্বীপে এই একই কাজ করে ফলাফল ভালো হয়নি।’

নিবন্ধে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করেন ভরত ভূষণ। তিনি লিখেছেন, ১৯৯১ সালের ঘটনার প্রায় ১৭ বছর পর মামলা হয়। খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতেই নির্বাচনের আগে আগে বিচার ত্বরান্বিত করা হয়। ২০০৭ সালে ক্ষমতায় আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই মামলা করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো আদালতে নিষ্পত্তি হয়। সব মামলা থেকেই মুক্ত হন তিনি। যদিও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো চলতে থাকে, যোগ হয় আরও নতুন মামলা।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এখন ৩৪ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তাঁর পাঁচ বছরের জেল ও জরিমানা হয়েছে। বর্তমানে এখন তিনি নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে সাজা ভোগ করছেন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচারকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ মামলাটি বর্তমানে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন পর্যায়ে রয়েছে।

বিএনপি আসন্ন সাধারণ নির্বাচন বর্জন করবে না বলে মনে করেন ভরত ভূষণ। এই ভারতীয় সাংবাদিক লিখেছেন, ‘এখনো পর্যন্ত পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য সুবিধাজনক বলে মনে হচ্ছে। প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ অভাবিত উন্নতি করেছে। দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে ৭ শতাংশের বেশি আছে। বেড়েছে আয় ও ব্যয়ের মাত্রা। বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধিতেও দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।’

তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ফলাফল অনিশ্চিত হতে পারে বলে মনে করেন ভরত ভূষণ। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ওপর সরকারের নির্ভরতা বেড়ে যাওয়া, গণমাধ্যমের ওপর সরকারের কড়াকড়ি, সুশীল সমাজ ও বাক্স্বাধীনতার প্রতি হুমকি, অনেক নাগরিকের গুম হওয়া—এসব ঘটনা জনগণের মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক করছে। সুতরাং সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলাফলে অনিশ্চয়তা থাকতে পারে।’

ভরত ভূষণ বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ভারত বেজায় খুশি। তিনি আরও বলেন, ভারত এই সরকারকে আবার ক্ষমতায় দেখতে চাইতেই পারে। বিএনপি এর আগে ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়ায় এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের বিরুদ্ধে পাকিস্তান-সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ থাকাই এর কারণ। তার মতে, ‘বাংলাদেশের অনেক মানুষ বিশ্বাস করে যে ভারত চায় খুঁড়িয়ে চলা বিএনপি যেন নির্বাচনে অংশ নেয়। এতে করে আরও বেশি বৈধতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরতে পারবেন শেখ হাসিনা।’

নিবন্ধের শেষে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের করণীয় নিয়ে লিখেছেন ভরত ভূষণ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়, এমন কোনো হস্তক্ষেপ করার মতো কাজ ভারত আবার করবে বলে মনে হয় না। ২০১৪ সালের মতো, আওয়ামী লীগের নেওয়া কৌশলকে সমর্থন দেওয়া ঠিক হবে না। প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে—কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না ভারতের। যদি কোনো পরামর্শ চাওয়া হয়, তবে ভারতের উচিত এমন পদক্ষেপ নেওয়া, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করবে এবং জনগণের ইচ্ছার মূল্যায়ন করবে।’

অন্যদিকে ভারতীয় প্রভাবশালী দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমসে লেখা এক বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাশ কাটিয়ে তা নয়।

সাবেক এই কূটনীতিক এও বলেন, ‘খালেদা-তারেক শাসনামলের কথা মাথায় রেখেই শেখ হাসিনা সরকারকে সমর্থন চালিয়ে যেতে হবে। যদিও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসন নিয়ে একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। তাই ভবিষ্যতে বিএনপি-জামায়াত সরকারের মোকাবিলা করার জন্য ভারতকে অবশ্যই প্রস্তুত হতে হবে।’

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গলবার অনলাইন সংস্করণে নিবন্ধটি প্রকাশ করা হয়েছে।

সাবেক কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় একটি বিশেষ আদালত কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ মামলায় তার ছেলে তারেক রহমানসহ আরো চারজনকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তারেক এখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। বিএনপির অভিযোগ, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।’

বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমল নিয়ে পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘বিএনপির সমর্থকেরা হয়তো এ দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করবেন যে ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান একটি দুর্নীতিপরায়ণ ও চাঁদাবাজ সরকারের প্রধান ছিলেন। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে তারেক রহমান ও তার ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকো চাঁদাবাজির একটি সংঘবদ্ধ জোট এবং একটি সমান্তরাল সরকারব্যবস্থা চালিয়েছেন। চাঁদা নেওয়ার অভিযোগে তারেক রহমানের ব্যবসায়িক অংশীদার সাজা পেয়েছিলেন এবং এখন কারাগারে আছেন। উলফার জন্য পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসার ব্যবস্থা করার অভিযোগে খালেদা জিয়ার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (লুৎফুজ্জামান বাবর) এখন কারাগারে রয়েছেন। এমনকি সৌদি আরবও বলেছে, খালেদা ও তার ছেলেরা সেই দেশের আবাসন খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন।’

২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হিসেবে ঢাকায় কর্মরত ছিলেন পিনাক রঞ্জন। নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়, ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ধ্বংস করার জন্য বাংলাদেশ ও পাকিস্তান হাত মিলিয়ে ছিল। পাকিস্তান ও তারেক চক্রের সমর্থনে বেশ কিছু ইসলামি মৌলবাদী দল বিখ্যাত হয়ে ওঠে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকেও সমর্থন দেওয়া হয়। তারেক রহমান এসব মৌলবাদীকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। আর পাকিস্তান এদের ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেয়েছিল।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার কথা উল্লেখ করে পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী লিখেছেন, ওই হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতির (মো. জিল্লুর রহমান) স্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী নিহত হন। এ হামলার মামলায় কয়েকজন বিএনপি নেতা অভিযুক্ত হয়েছেন। এই মামলায় অভিযুক্তের তালিকায় তারেক রহমানও রয়েছেন। অভিযোগ আছে, গ্রেনেড হামলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল তারেক রহমানের বাড়িতে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এ মামলায় তারেকের মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছেন।

বর্তমানে ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন ফেলো হিসেবে কর্মরত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। ১৯৯০ সালে এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। তিনি মনে করেন, নির্বাচন বর্জনের মতো কোনো পদক্ষেপ বিএনপি হয়তো নেবে না। নিবন্ধে তিনি বলেন, গত নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। কিন্তু এবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেওয়া হলেও বিএনপি সেই ভুল আর করবে না। একদিকে বিদেশ থেকে ফিরে দলের নেতৃত্ব দিতে পারবেন না তারেক রহমান। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিএনপির নির্বাচনী মিত্র জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। ফলে দুর্বল শক্তির বিএনপি হয়তো আগামী নির্বাচনে খুব বেশি লড়াই করতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই কূটনীতিক।

নিবন্ধের শেষের দিকে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকারের করণীয় কী, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। সাবেক এই কূটনীতিক লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারকে ভারত সমর্থন দিয়ে আসছে। খালেদা-তারেক শাসনামলের কথা মাথায় রেখেই এটি চালিয়ে যেতে হবে। যদিও হাসিনা সরকার দেশটিতে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত নানা উন্নয়ন করেছেন, কিন্তু বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসন নিয়ে একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। তাই ভবিষ্যতে বিএনপি-জামায়াত সরকারের মোকাবিলা করার জন্য ভারতকে অবশ্যই প্রস্তুত হতে হবে। আশা করা যায়, ভারতের সঙ্গে একই ভুল তারা (বিএনপি-জামায়াত) আর করবে না।’

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন