প্রকাশ্যে কোন্দল বিএনপিতে, আড়ালে দ্বন্দ্ব আ. লীগে

  19-07-2018 07:54AM


পিএনএস ডেস্ক: নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই সরগরম হয়ে উঠছে নগরের ভোটের মাঠ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার ওয়ার্ডগুলোর অলিগলি চষে বেড়াচ্ছেন প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকরা। স্থানীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি কেন্দ্রের নেতাদেরও নিয়মিত উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো দলগুলোর প্রার্থীদের প্রচারকাজে। কিন্তু দুই দলের ভেতরের চিত্র অন্য রকম। গৃহদাহে পুড়ছে দুই দলই।

বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর পাশাপাশি নিজ দলের (বহিষ্কার করা হয়েছে) নেতা বদরুজ্জামান সেলিম এবং ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতের নেতা এহসানুল মাহবুব জুবায়ের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। সে কারণে বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন জোটের ভেতরকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো চিত্র। কেন্দ্রের নির্দেশে স্থানীয় নেতাদের অনেকে প্রকাশ্যে মেয়র পদপ্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের পক্ষে প্রচারকাজে অংশ নিলেও আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দলের ভেতর রয়েছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ। নগর আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা এখনো মাঠে নামেননি। দুই দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ক্ষমতায় থাকাকালে কামরান দলের নেতাকর্মীদের ন্যায্য কোনো সুযোগ-সুবিধা দেননি। বরং তাঁর সময় সুবিধা ভোগ করেছেন বিপরীত মেরুর নেতারা। দলের স্বার্থরক্ষায় আন্তরিক না হয়ে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকাসহ নেতাকর্মীদের নানা অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে।

অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীদের সুবিধা না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে দলের নেতা সদ্য বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে। বিদ্রোহী প্রার্থী বদরুজ্জামান সেলিম এ অভিযোগ তুলে আরিফকে দলের মনোনয়ন দেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন।

বিএনপি : মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন নিয়েই বিএনপির মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। আরিফুল হক চৌধুরী ছাড়াও দলের চার নেতা মেয়র পদে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তাঁরা হলেন মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম, সাবেক কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাবেক কাউন্সিলর আব্দুল কাইয়ূম জালালী পংকী। দল আরিফুল হককে মনোনয়ন দিলে বাকিরা নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ালেও বদরুজ্জামান সেলিম মাঠে থেকে যান। এরই মধ্যে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

দলের কেন্দ্রের নির্দেশে মেয়র পদে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অনেকে আরিফুল হকের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নামলেও তা অনেকটা নিয়মরক্ষার মতোই। তাঁদের অনেককেই নিয়মিত দেখা যাচ্ছে না মাঠে। তবে আরিফুল হককে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় ফেলেছেন দলের সদ্য বহিষ্কৃত নেতা ও মেয়র পদপ্রার্থী বদরুজ্জামান সেলিম। তিনি নিজের নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে আরিফুলকে দোষারোপ করছেন। তাঁর বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি তুলে ধরে বক্তব্য দিচ্ছেন। এতে করে দলের নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত হচ্ছে। আবার মহানগরের কয়েকজন নেতাও বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে এখন প্রচারে নামেননি। আরিফুল হকের সমর্থক কয়েকজন নেতা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘সবাই মাঠে না নামলে নিশ্চিত বিজয় হাতছাড়া হতে পারে।’ এক নেতা বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে মহানগরের নেতারা উদ্বিগ্ন, তাই জরুরি সভা ডেকেছেন গতকাল বুধবার। বিষয়টি নিয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হবে। যেন বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামে।’ ওই নেতার দাবি, নিজ দলের মধ্যেই নয়, ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে নিয়ে বেকায়দায় আছে বিএনপি। কারণ জামায়াতের নিজস্ব একটি ভোটব্যাংক আছে। জোটগতভাবে নির্বাচন হলে ওই সব ভোট আরিফুলের বাক্সে পড়ার কথা। কিন্তু এখন ভোট ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এতে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়ছে বিএনপি প্রার্থীর জন্য।

দলের বিরোধ এবং নেতাকর্মীরা মাঠে না নামা প্রসঙ্গে মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন বলেন, ‘যারা মাঠে এখনো নামেনি তাদের সংখ্যা একেবারেই কম। এসব বিষয়ে নগরের নেতাকর্মীদের আমরা ডেকেছি। বুধবার রাতে তাদের নিয়ে বসছেন। সব ক্ষোভ-হতাশা ভুলে দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে বলব।’

জানতে চাইলে বদরুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘আমি এখন মরহুম বিএনপি নেতা। আমাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে বিএনপির নেতাকর্মীরা আমাকে ভুলে যায়নি। আমি যখনই গণসংযোগে নামি তখনই নেতাকর্মীদের ঢল নামে।’ প্রচারকাজ সম্পর্কে বলেন, ‘বহিষ্কার হওয়ার ভয়ে নেতাকর্মীদের অনেক প্রকাশ্যে মাঠে না নামলেও গোপনে গোপনে আমার জন্য কাজ করছে। আরিফুল হকের ওয়ার্ডের সভাপতি আমার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বে আছেন। এতেই প্রমাণিত হয় আরিফের অবস্থা কী।’ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদীর বলেন, ‘দল যাঁকে মনোনয়ন দিয়েছে তাঁর পক্ষে আমরা সবাই কাজ করছি। দলের মহানগর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা বিদ্রোহী প্রার্থীও আমাদের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।’

আওয়ামী লীগ : তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের বিরুদ্ধে। প্রথমে সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান, পরে সিটি করপোরেশনের দুইবারের মেয়র ছিলেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছিল—নিজস্ব অফিসের জন্য জায়গার ব্যবস্থা করা গেলে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ভবন করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। প্রায় ১৭ বছর কামরান পৌর চেয়ারম্যান ও পরে মেয়র ছিলেন। কিন্তু দলের কার্যালয়ের জন্য এই নগরে এক টুকরো জায়গাও খুঁজে বের করতে পারেননি তিনি। এটা কি তাঁর ব্যর্থতা নাকি দলের প্রতি আন্তরিকতার ঘাটতির কারণে হয়নি?’ তাঁরা আরো বলেন, অর্থমন্ত্রী বরাবরই সিলেটের উন্নয়নের বিষয়ে আন্তরিক। কিন্তু নিজের সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও কামরান নগর উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেননি।

নগর আওয়ামী লীগের ওই সব নেতা বলেন, নিজ দলের লোক না হওয়ার পরও মেয়র আরিফকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে সরকার। আরিফুল হক যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশংসিত হচ্ছেন, সেই টাকার জোগান দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। যদি অন্য দলের মেয়র কাজ করতে পারেন, তাহলে কামরান পারলেন না কেন?

তবে মহানগর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীই দাবি করছে, কামরানের প্রতি ক্ষোভ আর কষ্ট থাকলেও বঙ্গবন্ধুকন্যার নির্দেশে সবাই নৌকা প্রতীককে বিজয়ী করতে মাঠে নেমেছে। যারা নামেনি তারা দু-এক দিনের মধ্যে মাঠে নামবে।

এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে বলেন, ‘বড় দলে নানা কারণে মান-অভিমান থাকে। কিন্তু নেত্রীর নির্দেশের পর আমরা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে দিন-রাত কাজ করছি।’ এরই মধ্যে ৮০ শতাংশ নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন দাবি করে আসাদ বলেন, ‘কিছুদিনের মধ্যে বাকিদেরও আমরা ঐক্যবদ্ধ করে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।’

নগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক শামসুল ইসলাম, ২২ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সভাপতি ফলিক চৌধুরী, ৯ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সভাপতি কামাল আহমদ, ১৭ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রাজা এবং নগর শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলিম তুষারও একই কথা বলেন।

ফুরফুরে মেজাজে প্রচার চালাচ্ছে জামায়াত : মামলাসহ নানা কারণে সারা দেশে জামায়াতের নেতাকর্মীরা গাঢাকা দিলেও সিলেটের নির্বাচনী মাঠে তারা প্রকাশ্যে প্রচার চালাচ্ছে। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে তারা হঠাৎই রাজনীতির ময়দানে সরব হয়েছে। জামায়াতের মেয়র প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়েরসহ দলের নেতাকর্মীরা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নগরের অলিগলি চষে বেড়াচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনহীন দলটির সিলেট নগর শাখার আমির জুবায়ের নাগরিক ফোরামের ব্যানারে মেয়র পদে নির্বাচন করছেন। আত্মগোপনে থাকা দলের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানসহ বিভিন্ন মামলার আসামিরাও নির্বিঘ্নে ফুরফুরে মেজাজে প্রচার চালাচ্ছে। মেয়র পদে যতটা সম্ভব বড় অঙ্কের ভোট সংগ্রহ এবং অন্তত চার থেকে পাঁচটি ওয়ার্ডে নিজেদের সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচিত করে দলটি নিজেদের শক্তির জানান দিতে চাইছে। সূত্র: কালের কণ্ঠ

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন