মন ভরেনি শরিকদের

  10-12-2018 08:56AM


পিএনএস ডেস্ক: বিএনপি মিত্র দলগুলোকে অর্ধশতাধিক আসন ছেড়ে দেওয়ার পরও খুব একটা খুশি হতে পারেননি সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নেতারা। ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে তাঁদের এমন মনোভাবের কথা জানা গেছে। মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন গতকাল রবিবারও বিএনপির ৯ জন প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়েছে; যার মধ্যে দুটি আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে শরিকদল এলডিপি এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে। অন্যদিকে রংপুর-৫ আসনে নাগরিক ঐক্যের প্রার্থী মোফাখখারুল ইসলামকে পরিবর্তন করে বিএনপির মো. গোলাম রব্বানীকে চূড়ান্ত প্রার্থী করা হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন দলটির আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। তবে ২০ দলীয় জোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক দল জামায়াত শেষ পর্যন্ত ২২টি আসনে ছাড় মেনে নিতে রাজি হয়েছে। দলটিকে এর আগে ২৫টি আসনের জন্য চিঠি দিয়েছিল বিএনপি।

শেষ মুহূর্তে প্রার্থী পরিবর্তন প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমি এ ঘটনায় হতবাক ও বিস্মিত। কারণ আমাকে না জানিয়ে এটি করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ওই আসনের মনোনয়ন দিয়ে আমাদের তো চিঠি দেওয়া হয়েছিল। রাজনীতিতে এমনটিও যে হয় এটি আমার জানা ছিল না।’

জামায়াতের নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরোয়ার বলেন, ‘২৫টি আসনে মনোনয়নের চিঠি আমাদের দেওয়া হয়েছিল। এর সবটাই আশা করেছিলাম। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এর মধ্যে তিনটি চিঠি আমাদের দেওয়া হয়নি। বিএনপি তাদের শীর্ষপর্যায়ের অনুরোধের কথা আমাদের জানিয়েছে। ফলে জোট রক্ষার্থে এখন ২২টি আসনই আমরা মেনে নিয়েছি।’ তাঁর মতে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক কিছু মানতে হয়!

অন্যদিকে দলগত মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। কেউ বলছেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে এর চেয়ে সুষ্ঠুভাবে আসন বণ্টন ও মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব ছিল না। আবার কারও মতে, আরো সুন্দরভাবে মনোনয়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যেত।

শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে জোটে রাখা নিয়েও কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে জোটের শরিক দু-একটি দল। কারণ জামায়াতের কারণে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের নিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালানো কঠিন হবে। এ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্ট নেতারা জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক করতে রাজি হননি।

নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এবং গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তালা লাগানো ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে মনোনয়নবঞ্চিত পাঁচ নেতার সমর্থকরা। মনোনয়নবঞ্চিত ওই নেতারা হলেন এহসানুল হক মিলন (চাঁদপুর-১), সেলিমুজ্জামান সেলিম (গোপালগঞ্জ-১), তৈমুর আলম খন্দকার (নারায়ণগঞ্জ-১), মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী (কুমিল্লা-৪) ও শেখ আবদুল্লাহ (মুন্সীগঞ্জ-১)। এঁদের বাইরে বিএনপির হেভিওয়েট বা প্রভাবশালী প্রার্থীদের সেলিমা রহমান, শামসুজ্জামান দুদু ও ব্যারিস্টার জিয়াউর রহমান খান মনোনয়নবঞ্চিত হলেও তাঁরা বিক্ষোভ দেখাননি। তবে দলের মধ্যে এ নিয়ে সমালোচনা আছে। বিএনপির আটজন সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে ময়মনসিংহের এমরান সালেহ প্রিন্স ও বরিশালের বিলকিস জাহান শিরিন মনোনয়ন পাননি। দুজনই ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে। তবে তাঁরা এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি যে ২৯টি আসনে জয়লাভ করেছিল তার তিনটিতেই প্রার্থী ছিলেন খালেদা জিয়া। নির্বাচিত বাকি ২৬ জনের মধ্যে এবার চারজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আসন বণ্টন করতে গিয়ে বাদ দেওয়া হয়েছে তিনজনকে। তাঁরা হলেন লক্ষ্মীপুর-১ আসনের নাজিম উদ্দিন (মনোনয়ন পেয়েছেন এলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম), লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের আশরাফউদ্দিন নিজান (মনোনয়ন পেয়েছেন জেএসডির আ স ম রব) এবং বগুড়া-২ আসনের হাফিজুর রহমান (মনোনয়ন পেয়েছেন নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না)। এ ছাড়া চাঁদপুর-৪ আসনের সাবেক এমপি লায়ন হারুনার রশীদকে বাদ দিয়ে বিএনপির এম এ হান্নানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থায় বিএনপিকে চলতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত সরকার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। কোনো ঘটনা না থাকার পরও উসকানির জন্য তারা নিজেরা বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে মন্তব্য করছে। তিনি বলেন, ‘বিএনপির মনোনয়ন ও আসন বণ্টন নিয়ে তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে নানা কথা বলছে। অথচ আমরা তাদের বিষয়ে এত কথা বলছি না। অর্থাৎ বোঝা যায়, তারা নিজেদের মনোনয়ন নিয়ে যতটা চিন্তিত তার চেয়ে বেশি বিএনপিকে নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু তার পরও তারা উসকানি দিয়ে কিছু করতে পারেনি। মনোনয়ন ও আসন বণ্টন দুটিই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘যে পরিস্থিতির মধ্যে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে তাতে ভালোই হয়েছে বলতে হবে। কারণ একদিকে ২০ দলীয় জোট অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলোকে বিএনপির ছাড় দিতে হয়েছে। ফলে বিএনপির অনেক যোগ্য প্রার্থীকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু তবুও বৃহত্তর স্বার্থে আমরা ছাড় দিয়েছি।’

২০ দলীয় জোটের শীর্ষনেতা এলডিপির চেয়ারম্যান ড. অলি আহমদ বলেন, ‘আমরা প্রথমে ২০টি পরে ১০টি আসনে ছাড় চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে মাত্র পাঁচটি দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির নিজ দলের পাশাপাশি ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট—এই তিনভাগে মনোনয়ন সম্পন্ন করতে গিয়ে অনেক সময় লেগেছে। তা না হলে মনোনয়ন আরো ভালো হতে পারত। সময়ের অভাবে হয়তো মাঠপর্যায়ের সবাইকে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তার পরও আমরা মেনে নিয়েছি।’

নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বিএনপি জোটের সবার মনোনয়ন পর্যালোচনা করে এখনো দেখিনি। কিন্তু সব যে ভালো হয়েছে এমন নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘এবারের নির্বাচনটা প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ! ফলে ভোটে এবার কমিটেড হয়ে কাজ করতে হবে। প্রার্থী নিজেই যদি সিপাহসালার হয়ে মাঠে নামতে না পারেন তাহলে তো ভোটে জেতা যাবে না। আমার মনে হয়, এই জায়গাটাতে আরেকটু সমন্বয় হলে ভালো হতো।’

জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, ‘জেএসডির অনেক ভালো প্রার্থী বাদ পড়েছে। দু-তিনবার এমপি ছিলেন এমন প্রার্থীও মনোনয়ন পাননি। বিএনপি জোটের মনোনয়ন আরো ভালো হতে পারত। তার পরও এর মধ্যে সমঝোতা করতে হয়েছে, মেনে নিতে হয়েছে।’

কল্যাণ পার্টির সভাপতি মেজর জে. (অব.) ইব্রাহিম অবশ্য বলেন, একটি আসন পেয়েও তিনি সন্তুষ্ট আছেন।

৯টি আসনে প্রার্থী বদল বিএনপির : গতকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে ৯টি আসনে দলের প্রার্থী পরিবর্তন করার কথা জানান। পরিবর্তনগুলো হলো মানিকগঞ্জ-১ আসনে খোন্দকার আবদুল হামিদ ডাবলুর বদলে এস এ জিন্নাহ, রংপুর-৫ আসনে মোফাখখারুল ইসলাম নবাবের পরিবর্তে মো. গোলাম রব্বানী, সিরাজগঞ্জ-৬ আসনে মো. কামরুদ্দিন এহিয়া খান মজলিশের বদলে এম এ মুহিত, গোপালগঞ্জ-৩ আসনে এস এম আফজাল হোসেনের পরিবর্তে এস এম জিলানী, নওগাঁ-১ আসনে মোস্তাফিজুর রহমানের বদলে মো. ছালেক চৌধুরী, রাজশাহী-৫ আসনে অধ্যাপক নজরুল ইসলামের বদলে মো. নাদিম মোস্তফা, শেরপুর-২ আসনে মো. মুখলেছুর রহমান রিপনের বদলে মোহম্মদ ফাহিম চৌধুরী, নাটোর-১ আসনে কামরুন্নাহারের (প্রয়াত ফজলুর রহমান পটলের স্ত্রী) বদলে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের মুনজুরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম-৭ আসনে কুতুব উদ্দিন বাহারের বদলে এলডিপির মো. নুরুল আলম।

নুরুল আলমকে নিয়ে এলডিপিকে মোট পাঁচটি আসনে ছাড় দিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে দলটির সভাপতি ড. অলি আহমদ ছাতা মার্কায় নির্বাচন করলেও বাকি চার প্রার্থী ধানের শীষে নির্বাচন করবেন বলে গতকাল ইসিকে দেওয়া চিঠিতে জানান মির্জা ফখরুল।

অন্যদিকে মুনজুরুল ইসলামসহ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে বিএনপি ছেড়ে দিল মোট চারটি আসন। শরিক অন্য দলগুলোর মধ্যে গণফোরাম ৭, জেএসডি ৪, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ৩, খেলাফত মজলিস ২, জাতীয় পার্টি (জাফর) ২ এবং বিজেপি, এনপিপি, পিপিবি, জমিয়তে ওলামা (ওয়াক্কাস) ও কল্যাণ পার্টিকে ১টি করে আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে নিবন্ধন না থাকা নাগরিক ঐক্যকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ৪টি আসন। সব মিলিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলোকে ২০টি এবং ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোকে ৩৯টি অর্থাৎ মোট ৫৯টি আসন মিত্রদের ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। বিএনপি একক প্রার্থী দিয়েছে ২৪১টিতে।

তিনটি কমে ২২টি আসনে সমঝোতা মেনে নিল জামায়াত : এদিকে আগে ২৫টি আসনে ছাড় পেলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপির অনুরোধে গতকাল তিনটি কমিয়ে সমঝোতা করতে রাজি হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। আগের দিন রাতে চূড়ান্ত দর-কষাকষি শেষে জামায়াত ওই ছাড় দিতে রাজি হয় এবং গতকাল তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেয়। জামায়াতের যাঁরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেন তাঁরা হলেন রবিউল বাশার (সাতক্ষীরা-৩), ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী (সিলেট-৫) ও হাবিবুর রহমান (সিলেট-৬)।

জামায়াতের চূড়ান্ত হওয়া আসনগুলো হলো ঠাকুরগাঁও-২ মাওলানা আবদুল হাকিম, দিনাজপুর-১ মাওলানা মোহাম্মদ হানিফ, দিনাজপুর-৬ মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম, নীলফামারী-২ মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান মন্টু, নীলফামারী-৩ মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম, রংপুর-৫ অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, গাইবান্ধা-১ মাজেদুর রহমান সরকার, সিরাজগঞ্জ-৪ মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, পাবনা-৫ মাওলানা ইকবাল হুসাইন, ঝিনাইদহ-৩ অধ্যাপক মতিয়ার রহমান, যশোর-২ আবু সাঈদ মুহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন, বাগেরহাট-৩ অ্যাডভোকেট আবদুল ওয়াদুদ, বাগেরহাট-৪ অধ্যাপক আবদুল আলীম, খুলনা-৫ অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, খুলনা-৬ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, সাতক্ষীরা-২ মুহাদ্দিস আবদুল খালেক, সাতক্ষীরা-৪ গাজী নজরুল ইসলাম, পিরোজপুর-১ শামীম সাঈদী, ঢাকা-১৫ ডা. শফিকুর রহমান, কুমিল্লা-১১ ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, চট্টগ্রাম ১৫ আ ন ম শামসুল ইসলাম ও কক্সবাজার-২ হামিদুর রহমান আজাদ। সূত্র: কালের কণ্ঠ

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন