প্রয়োজনের-অপ্রয়োজনের বিরোধী দল

  17-01-2019 07:23PM

পিএনএস (মোস্তফা মামুন) : নির্বাচনের পর বেশ অনেক দিন হয়ে গেল। অনেক দিন হয়ে গেলে অনেক কিছু হজম হয়ে যেতে শুরু করে। নির্বাচনের ফলটাও তাই একরকম হজম করে ফেলেছে সবাই।

শুরুতে অবশ্য বদহজমের মতো অবস্থা হয়েছিল খানিকটা। বিরোধীরা যে বিরাট ঝাঁকুনি খেতে যাচ্ছে, নির্বাচনপূর্ব হাওয়ায়ই বেশ বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু এ যে একেবারে রিখটার স্কেলের সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প।

জাভেদ ভাই নির্মোহ চিন্তার মানুষ। সব কিছুতে যুক্তি দাঁড় করানোর ক্ষমতা আছে বলে কোনো কিছুতেই ভেসে যায় না। নির্বাচন ঘুরেফিরে দেখল। কিন্তু সন্ধ্যা থেকে এমন স্তম্ভিত যে নির্বাচনের ফল নিয়ে কোনো বিশ্লেষণেই আনা গেল না। টিভিতে তখন নির্বাচনী ফল দেখানো হচ্ছে, যাতে বিএনপি জোট পুরোপুরি ভূপাতিত এবং কিছু চেনা গবেষক এটা যে উন্নয়ন, নতুন ভোটারদের মন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের গণরায়—এসব অক্লান্তে বিশ্লেষণ করে চলছেন। জাভেদ ভাই সেদিকে তাকিয়ে হাসল একটু।

বললাম, ‘তোমার বিশ্লেষণ বলো। একটু শুনি।’

জাভেদ ভাই হাসে শুধু। ‘আমার এ বিষয়ে কোনো বিশ্লেষণ নেই।’

‘কেন?’

‘আমি রাজনীতি, ভোট বা ফল বিশ্লেষণ করতে পারি। ভূমিকম্প প্রলয় বিশ্লেষণ করতে পারি না। এসব করতে আবহাওয়াবিদ-পরিবেশবিদ লাগবে।’ একটু থেমে বলে, ‘তার চেয়ে বরং দু-একটা কৌতুক বলো। নির্বাচনী কৌতুক শুনি।’

মনে পড়ল আগের লেখাটা শেষ করেছিলাম তিন ভোটের মালিকদের নিয়ে। এবার নির্বাচনে সেটা দারুণ হিট হয়ে গেছে। ওই যে এক প্রার্থীর তিন ভোট পাওয়ার পর স্ত্রী বলছেন, ‘তোমাকে তিন নম্বর ভোটটা কে দিল? নিশ্চয়ই কোনো প্রেমিকা জুটিয়েছ।’ কৌতুকটা শুনিয়ে বললাম, ‘যতদূর খবর পাচ্ছি চট্টগ্রামের একজন প্রার্থীর ভাগ্যে সেই তিন ভোট দূরে থাক, কোনো ভোটই জোটেনি।’

জাভেদ ভাই টিভির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বিশ্লেষকরা হয়তো বলবেন, মানুষ আসলে সত্যিকারের ভোটের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে গেছে। তার রাজনৈতিক বোধ এতটাই উন্নত হয়েছে যে সে নিজেকেও ভোট দিচ্ছে না।’

‘একটা খবর অবশ্য পাচ্ছি যে উনি নিজে এই এলাকার ভোটার না। পাশের আসনের ভোটার।’

‘তাহলেও তার বন্ধুবান্ধব, কর্মী-সমর্থক তো আছে। কেউ ওকে ভোট দেয়নি। ভোটবোধের ব্যাপক উন্নতি।’

‘কিন্তু এটাকে তো বিরোধী দলের ভোট কারচুপির পক্ষের প্রমাণ হিসেবে ধরছে কেউ কেউ।’

জাভেদ ভাই বলে, ‘বললাম তো এই ফল বিশ্লেষণ করা আমার সাধ্যের বাইরে, বরং নির্বাচন নিয়ে কৌতুক শোনাও।’

নির্বাচনী অনিয়মের একটা কৌতুকই মনে এলো। কোনো একটা নির্বাচনের সময় এক লোক ফোন করে তার বন্ধুকে বলছে, ‘আমাদের এদিকে তো ভয়ংকর অবস্থা। আমি নিজের ভোটটাই দিতে পারিনি। তোমাদের ওদিকে কী অবস্থা?’

‘আমাদের ওদিকে তো একেবারে বিপরীত অবস্থা। সবাই নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারছে। আমি নিজেই তো গোটা দশেক ভোট দিয়ে এলাম।’

জাভেদ ভাই এবার প্রাণ খুলে হাসল। হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই বাঘ আসার গল্পটা জানো। খুবই শিশুতোষ গল্প; কিন্তু আজ আবার মনে হচ্ছে। আমাদের বিরোধী দল সব সময়, সব ভোট প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতাকে এমন কমিয়ে রাখে যে কোনো বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি থাকলেও সেটাকে সেই কথার কথা মনে হয়।’ কয়েক দিন পর যখন আবার কথা হচ্ছে তখন জাভেদ ভাই ধাক্কা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। এবারও আলোচনা শুরু হলো বিরোধী দল নিয়েই।

বলল, ‘একটা জিনিস খেয়াল করেছ, সরকার এখন খুব করে চাইছে যেন বিরোধী দল, মানে ঐক্যফ্রন্ট শপথ নেয়। সংসদে অংশ নেয়।’

‘তা তো চাইবেই। তাহলে নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে সেটা শেষ।’

‘খালি চোখে হয়তো সেটাই বোঝায়; কিন্তু সত্যি বলতে কি জানো, বিরোধী দল সরকারের জন্যই দরকার।’

‘কিছুটা বুঝতে পারছি। তবু আরেকটু বুঝিয়ে বলো।’

‘শোনো, আমি কিছুদিন একটা সংগঠনের দায়িত্বে ছিলাম। নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীরা ধুয়ে-মুছে এমন সাফ হয়ে গেল যে আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই দেখে ওরা মোটামুটি লড়াই থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিল। আমরা খুশিতে ডগমগ হয়ে ভাবলাম, যাক বেশ তো। এখন নিশ্চিন্তে কাজ করা যাবে। বিরোধীপক্ষ থাকা মানেই তো ঝামেলা। প্রতিবাদ। কিন্তু সমস্যাটা বোঝা গেল কিছুদিন পর। বিরোধী দল না থাকায় আমরা কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু জায়গায় স্বেচ্ছাচারীই হয়ে গিয়েছিলাম বলতে পারো। এতে নিজেদের মধ্যেই এক পক্ষ খেপে গেল। তৈরি হয়ে গেল উপদল। তখন ওদের সঙ্গে এসে হাত মেলাল বিরোধীপক্ষ। ভয়ংকর অবস্থা।’

‘তার মানে তুমি বলছ সরকারের স্বার্থেই বিএনপির টিকে থাকা দরকার।’

‘অবশ্যই। বিরোধী দল সরকারকে বিরক্ত করে। কাজে বাধা দেয়, এটা ঠিক; কিন্তু সঙ্গে এটাও ঠিক, ওদের সামাল দেওয়ার জন্য সরকারি দল ঐক্যবদ্ধ থাকে। নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল তৈরি হলেও সেটা বড় হতে দেয় না, পাছে বিরোধী দল ফায়দা লোটে। বিরোধী দল আসলে সরকারি দলের ঐক্যের প্রভাবক।’

‘কিন্তু বিরোধী দল সে রকম না থাকলে তো সুবিধাও হয়। সত্যি যদি বলো, তাহলে ২০১৪-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার উন্নয়ন কাজগুলো এগিয়ে নিতে পেরেছে সবচেয়ে মসৃণভাবে। হরতাল-আন্দোলন নেই বলে স্বস্তিকর জনজীবন। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকাটা তাই সরকারি দলের রাজনৈতিক সমস্যার কারণ হতে পারে। কিন্তু মানুষের জন্য তো সমস্যা নয়।’

‘না ব্রাদার। তোমার-আমারও সমস্যা আছে। বিরোধী দল যেকোনো কিছুতে রাজনীতির রং দেয় বলে আমরা ওদের গালাগাল করি। কিন্তু আবার বিরোধী দল না থাকলে, রাজনীতি করার লোক না থাকলে মানুষের কোনো সমস্যার পক্ষে আওয়াজ ওঠে না। ধরো, তুমি রাস্তায় প্রহৃত হলে, বিরোধী দলের সঙ্গে হয়তো তোমার কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু ওরা করবে কী, সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য, আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা যে খারাপ সেটা প্রমাণের জন্য ইস্যু জিইয়ে রাখবে। ঝামেলা করবে। তাদের লক্ষ্য তোমার কল্যাণ হয়তো নয়; কিন্তু শেষ বিচারে তোমারও কিছু লাভ হচ্ছে। এখন ধরো, বিরোধী দল না থাকলে তুমি সমস্যায় পড়লে সেটা সমাধান তোমাকেই করতে হবে। পুলিশের কাছে যাবে, সরকারের কাছে যাবে; কিন্তু সেখানে তুমি একা। আর বিরোধীদের চাপ না থাকলে তোমাকে খুশি করার খুব ব্যাপারও কর্তৃপক্ষের থাকবে না। এভাবেই বিরোধী দল প্রয়োজনীয়। বিরোধী দল হচ্ছে ইংরেজি ওই কথাটার মতো ‘নেসেসারি এভিল’। ‘প্রয়োজনীয় শয়তান।’ থাকলেও সমস্যা। না থাকলে আরো বেশি সমস্যা।’

‘বুঝলাম। কিন্তু সংসদে তো একটা বিরোধী দল আছে। জাতীয় পার্টি। অন্য শরিকরাও এবার বিরোধী ভূমিকায় নামবে।’

জাভেদ ভাই আবার হাসে। বলে, ‘বিরোধী দল নিয়ে তুমি একটা কৌতুক শুনিয়েছিলে কিছুদিন আগে। মনে আছে?’

মনে আছে। বিরোধী দল খুব আন্দোলন করছে। এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন, ‘কেন আপনারা এই সরকারের পতন চান?’

‘চাইব না? সরকারি লোকজন দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। সম্পদের পাহাড় গড়ছে।’

‘আপনারা তাহলে এগুলো দূর করার জন্যই সরকারে যেতে চান?’

‘আরে দূর। আমাদের বুঝি টাকা-গাড়ি-বাড়ি করতে ইচ্ছা করে না!’

জাভেদ ভাই বলল, ‘আমাদের নতুন বিরোধী দলের সঙ্গে মিল পাচ্ছ না! তারা সরকারের অংশই থাকতে চাচ্ছিল।’

‘বুঝলাম। কিন্তু তোমার সত্যিকারের বিরোধী দলের অবস্থাও তো খুব ভালো নয়। তারা সরকারে থাকার সময় দুর্নীতি-অপকর্মে বর্তমান সরকারের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে ছিল। তাই না?’

জাভেদ ভাই হতাশ ভঙ্গিতে বলে, ‘অবশ্যই এগিয়ে ছিল। কিন্তু আমাদের কপালটা দেখো। তবু তাদের জন্যই হাহাকার করতে হয়। সত্যিকারের বিরোধী দল যে লাগেই। প্রয়োজনীয় শয়তান।’

প্রয়োজনীয় শয়তান। থাকলেও সমস্যা। না থাকলেও সমস্যা।

রাজনীতি-নির্বাচন ইত্যাদি সব অঙ্কের শেষেই দেখি একটা জিনিসই পাওয়া যায়। সমস্যা। সমাধান কখনো কোথাও মেলে না।

লেখক : সাংবাদিক, কথাসহিত্যিক ( কালের কণ্ঠের সৌজন্যে)

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন