ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না ঢাকা মহানগর বিএনপি

  18-05-2019 09:13AM


পিএনএস ডেস্ক: আন্দোলনের সূতিকাগার রাজধানী ঢাকা। কিন্তু সেই রাজধানীতেই সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না বিএনপি। বারবার আন্দোলনের ডাক দিলেও গত ১২ বছরে ঢাকা মহানগরে সঙ্ঘবদ্ধ কোনো কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে এমনকি একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও সারা দেশের নেতাকর্মীরা যখন প্রবল চাপ উপেক্ষা করে মাঠে থাকার চেষ্টা করেছেন, সেখানে ঢাকা মহানগর বিএনপিকে দেখা গেছে ভিন্ন মেজাজে। কঠোর কোনো আন্দোলন এখানে গড়ে ওঠেনি। মিছিল নিয়ে রাজপথে বের হওয়ার সাহস দেখায়নি বলতে গেলে কেউ। থানা-ওয়ার্ড ভিত্তিক কর্মসূচিগুলো ছিল গলির ভেতরেই সীমাবদ্ধ। বিএনপির হাইকমান্ড ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকা মহানগরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে সংগঠনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়ার পরও কমিটি গঠন নিয়ে যে বিভক্তি বা জটিলতা তৈরি হয়, তাতে করে মহানগরীর নেতাকর্মীদের একটি অংশ দীর্ঘ সময় ধরে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছেন। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাঠেও নেতাকর্মীদের সেই নিষ্ক্রিয়তার ছাপ লক্ষ্য করা গেছে।

ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল এক মাস। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেছে দুই বছর। আংশিক কমিটি দিয়েই কোনো মতে চলছে বিএনপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই দু’টি সাংগঠনিক ইউনিট। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর মহানগরের কার্যক্রমে আরো স্থবিরতা নেমে এসেছে। এখন আবার দাবি উঠেছে নতুন করে কমিটি গঠনের।

মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল দীর্ঘ দিন ধরে কারাগারে রয়েছেন। উত্তরের সভাপতি এম এ কাইয়ুমকে সংগঠন চালাতে হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। শীর্ষ নেতার অনুপস্থিতির কারণে দক্ষিণ শাখার কার্যক্রম নেই বললেই চলে। উত্তরেরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনপ্রক্রিয়া থমকে আছে।

মামলার কারণে উত্তরের শীর্ষ নেতা কাইয়ুম বিদেশে থেকে দল পরিচালনা করছেন। কাইয়ুম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। কিন্তু ৬৬ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণার পর থানা কমিটি গঠন নিয়ে জটিলতার সূত্র ধরে ৩২ জন নেতা কমিটি থেকে নিজের সরিয়ে রেখেছেন। যাদের প্রতিনিধিত্ব মহানগর উত্তরের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে। তারা বেশ কয়েকবার দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভও করেছেন। সম্প্রতি এসব বিক্ষুব্ধ নেতা তাদের দাবি জানাতে স্কাইপিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলার সুযোগ চেয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে- এসব নেতার অনাস্থার কারণে মহানগর উত্তর বিএনপির কোনো বর্ধিত সভা এখন পর্যন্ত হয়নি। তিন-চার দিন আগে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সভায় উত্তরের মাত্র ৬-৭ জন নেতার উপস্থিতি ছিল বলে বিরুদ্ধ পক্ষ জানিয়েছে। এর পাশাপাশি দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও উত্তরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় পদহীন অবস্থায় থাকা প্রায় দেড়শতাধিক নেতা ও তাদের অনুসারীদের মধ্যে অসন্তোষ চলছেই।

তবে উত্তর বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম ভালোভাবেই এগোচ্ছে বলে জানিয়েছেন এম এ কাইয়ুম। তিনি বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে একটি মুহূর্তের জন্য উত্তর বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম থেমে থাকেনি। এক নেতার এক পদের বিধান একমাত্র উত্তর বিএনপিতে কার্যকর করা হয়েছে। ২৬টি থানার ১২১ সদস্যের এবং ৭১ সদস্যের ৫৬টি ওয়ার্ডের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২০১ সদস্যবিশিষ্টি উত্তরের কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে জমা দেয়া হয়েছে। সর্বমোট ৭ হাজার ৩২৩ সদস্যের মহানগর উত্তর কমিটি তালিকা প্রস্তুত আছে। এর মধ্যে একজন নেতাও দু’টি পদে থাকছে না।

কমিটি গঠন নিয়ে উত্তরে নেতৃত্ব পর্যায়ে অসন্তোষ ও কোন্দলের বিষয়ে কাইয়ুম বলেন, কোনো কোন্দল বা অসন্তোষ নেই। কয়েকজন নেতা আছেন যারা একইসাথে কেন্দ্র ও থানার নেতৃত্বে থাকতে চান। কিন্তু দলের বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব নয়। এ জন্য কয়েকজন নেতার মধ্যে সাময়িক ভুল বোঝাবুঝি আছে। এর বেশি কিছু নয়।

সব প্রক্রিয়া সম্পন্নের পরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি কেন আলোর মুখ দেখছে না জানতে চাইলে কাইয়ুম বলেন, কমিটি গঠনে কেন্দ্রের নির্দেশনা তারা পালন করেছেন। এবার অনুমোদনের দায়িত্ব কেন্দ্রের।

২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সভাপতি ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী আবুল বাসারকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৭০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। ২৬ জনকে সহসভাপতি, ১৯ জনকে যুগ্ম সম্পাদক, ১৮ জনকে সহসাধারণ সম্পাদক, তিনজনকে সাংগঠনিক সম্পাদক এবং দফতর সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষের নাম ঘোষণা করা হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কমিটি অনুমোদন করে এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু আজো তা গঠিত হয়নি।

দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সাত মাস ধরে কারাগারে আছেন। সভাপতির অনুপস্থিতিতে সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাসারও সংগঠনের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রেখে সামনে এগোতে পারছেন না। দক্ষিণের কর্মসূচিতে ঘোষিত কমিটির ৭০ জনের মধ্যে মাত্র ৪-৫ জনের বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না।

দক্ষিণের সাংগঠনিক অবস্থা বেহাল হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে মহানগরের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলেছেন, সাবেক ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ঢাকা মহানগরের দায়িত্ব পাওয়ার আগে মহানগরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ফলে কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা থাকলেও মহানগরের থানা কিংবা ওয়ার্ডে তার অনুসারী গড়ে ওঠেনি। ছাত্রদল কিংবা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাদের নিয়েই তাকে প্রায় চলতে দেখা গেছে। মহানগরের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে নগরের শীর্ষ নেতাদের সহযোগিতাও তিনি পাননি।

মহানগর দক্ষিণের ঘুরে দাঁড়াতে না পারার কারণ প্রসঙ্গে কমিটির একাধিক নেতা বলেন, ঘুরে না দাঁড়ানোর পেছনে অনেক কারণ আছে। এক. মহানগরের প্রভাবশালী নেতা ও তাদের অনুসারীরা মহানগর রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ সোহেলকে মেনে নিতে পারেনি। দুই. সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশারের প্রতিও দক্ষিণের একটি অংশের অনাস্থা রয়েছে। তিন. মহানগর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থের প্রয়োজন হয়, কিন্তু নতুন এই নেতৃত্ব সেই মাত্রায় অর্থের জোগান দিতে পারেননি। চার. নগরীর নেতাকর্মীদের মামলা নিষ্পত্তির কোনো খবরও রাখেনি। পাঁচ. অনেক কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহানগর দক্ষিণের অধীনে থাকা ২৪টি থানার মধ্যে একটি কমিটিও পূর্ণাঙ্গ হয়নি। তবে আংশিক কমিটি করা সম্ভব হয়েছে ১৮টি থানার। ওয়ার্ড কমিটি গঠনও সম্ভব হয়নি বললেই চলে। নগরের দায়িত্বশীল নেতাদের বেশির ভাগই বলছেন, দক্ষিণ শাখা বিএনপির সভাপতি দীর্ঘ দিন ধরে কারাগারে থাকার কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনপ্রক্রিয়া থমকে গেছে। অনেক নেতার দাবি, এই কমিটির মধ্যে যারা সক্রিয় ছিলেন, তাদের রেখে নতুন করে কমিটি করা উচিত।

দক্ষিণ শাখা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাসার বলেন, সভাপতি কারাগারে রয়েছেন। তারপরও আমি শত মামলা মাথায় নিয়ে কেন্দ্রীয় সব কর্মসূচি সফল করার চেষ্টা করেছি। সংগঠনকে সক্রিয় রেখেছি। সভাপতি মুক্তি পাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন