চীনকে এখনও চেনার অনেক বাকি!

  14-10-2016 12:22PM



পিএনএস ডেস্ক: এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখন চীনের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশে তার রাষ্ট্রীয় সফর করছেন। ততক্ষণে হয়তো বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অনেকগুলো বাণিজ্যিক ও পারস্পরিক সহযোগিতার চুক্তিও সই হয়ে যাবে। কিন্তু দু’দেশের মধ্যেকার গভীরতর সম্পর্ক নিয়ে তারপরও অনেক কিছুই আলোচনার থেকে যায় এবং ভবিষ্যতে এসব আলোচনা অত্যন্ত জরুরি বলেও মনে করি। কারণ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব চীন কিংবা ভারতের মতো না হলেও, দক্ষিণ এশিয়ার গেটওয়ে হিসেবে ভূ-রাজনৈতিক ভাবেই বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম এবং সে হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও চীন, দু’টি দেশের সম্পর্কই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আজকের লেখায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে না থাকলেও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের প্রসঙ্গও আসবে, তাই আগে থেকেই পাঠকের কানকে ভারত বিষয়ে একটু জানিয়ে রাখতে চাইলাম।

বিশ্ব রাজনীতির পণ্ডিত থেকে শুরু করে একটি সাধারণ কিশোর বালকও আজকে একথা স্বাভাবিক বাস্তববোধ থেকেই বুঝতে পারে যে, চীন আজকের বিশ্বে অন্যতম প্রধান আলোচনার বিষয়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হয়তো ততটা নয়, কারণ চীনের রাজনীতি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও প্র্যাকটিসকে সমর্থন করে না। কিন্তু তারপরও চীনে এক ধরনের নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, পশ্চিম তাকে সমর্থন না করলেও বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিচারে চীনকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কারোরই নেই। এমনকি একক সুপার পাওয়ারের এই ভয়ঙ্কর সময়ে যখন চীন, ভারত, রাশিয়া, ব্রাজিল ও সাউথ আফ্রিকার মতো দেশগুলো মিলে একটি নতুন সংঘ (ব্রিকস) গঠন করে তখন স্বাভাবিক ভাবেই পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষেরা তাতে সমর্থন দেয় এবং ধরেই নেয় যে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই পৃথিবী এই একক সুপার পাওয়ারের দৌরাত্ম থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক সম্পর্কিত আলোচনায় সে বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়া উচিত এ কারণে যে, যে কোনও সময় হয়তো বাংলাদেশও এই সংঘে জায়গা করে নিতে পারে। চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর শেষ করে যাবেন ভারতে অনুষ্ঠিত ব্রিকস-এর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে, সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আমন্ত্রিত। আশ্চর্য হবো না যদি এই সম্মেলনেই বাংলাদেশকে সেই সম্মানে ভূষিত করা হয়।

কিন্তু একথাতো সত্যি যে, বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বহুদিন ধরেই যে তিনটি দেশের প্রভাব ও প্রতিপত্তি নিয়ে আলোচনা হয় তার মধ্যে চীন অন্যতম, বাকি দু’টি দেশ হচ্ছে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা অর্থনীতির চেয়ে রাজনীতিতেই বেশি আলোচিত হয় কারণ এই দেশটির স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা বা খবরদারি করা। সেদিক দিয়ে চীনকে আমরা সেভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে দেখিনি কখনও, কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চীন অনুপস্থিতও থাকেনি, বরং পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের বেরিয়ে আসার সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে চীন পাকিস্তানের পক্ষে থেকে আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অপেক্ষা করেছে বাঙালি জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা পর্যন্ত। এবং তার পরেই বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসনামলে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে চীনের সামরিক ও রাজনৈতিক মিত্রতার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। জেনারেল জিয়াউর রহমান যে রাজনৈতিক দলটি গঠন করেছিলেন তা মূলতঃ বাংলাদেশের চীনপন্থী বামদের সহযোগিতায় এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মতোই একক কর্তৃত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠনের আদলেই। সে কারণেই চীনের সঙ্গে বিএনপি’র সম্পর্ক নিয়ে অনেকেই এমন ভাবে কথা বলেন যে, যেন তারা দু’টি সহোদর রাজনৈতিক দল সম্পর্কে কথা বলছেন। কিন্তু চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও যে বিরাট পরিবর্তন এসেছে সে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়টি অনেকেই ভুলে যান উল্লেখ করতে। যে কঠোর ও বদ্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতি চীন নব্বইয়ের দশকের আগ পর্যন্ত লালন করেছে তা গত দেড় দশকে অনেকটাই বদলে গেছে, বাণিজ্যিক প্রসারের কারণেই হোক কিংবা অর্থনৈতিক তাড়ণাতেই হোক, চীন এখন বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে পারষ্পারিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককেই মূল্য দেয় সর্বাধিক এবং দেশটির অভ্যন্তরেও একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনব্যবস্থা বজায় থাকলেও তারা বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণে তাদের সাবেক ‘বাম-সংস্কৃতি’-কে ততটা আর প্রাধান্য দেয় না। যার সর্ব-সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে আমরা পাকিস্তানের কথা বলতে পারি। সপ্তাহখানেক আগে যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উরি হামলা নিয়ে প্রায় যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে তখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্ব-প্রণোদিত হয়েই বলতে শুরু করলেন যে, পাকিস্তান যদি ভারত দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে চীন তাদের পাশে থাকবে। কিন্তু পাক-পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই বক্তব্যের একদিন যেতে না যেতেই চীনের পক্ষ থেকে জোরালো ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়েছিল যে, চীন এরকম কোনও বক্তব্যকে সমর্থন করে না এবং চীনের পক্ষ থেকে এরকম কোনও বক্তব্য দেওয়া হয়নি। আশির দশকে চীনের কাছ থেকে এমন কোনও বক্তব্য আশা করা যেতো কি? যেতো না। বরং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান এই স্বপ্নেই বিভোর ছিল যে, যে কোনও মুহূর্তে অরুণাচল প্রদেশ দিয়ে চীনা সৈন্য ভারত আক্রমণ করবে এবং বাংলাদেশ পাকিস্তানের হাতছাড়া হবে না। বলাই বাহুল্য যে, তখনও সে সাহায্য পাকিস্তান পায়নি। তারপরও পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের মৈত্রীকে অনেক ক্ষেত্রেই উদাহরণ হিসেবে দেখা হতো এতোদিন, কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনায় যখন চীন ঘি না ঢেলে পানি ঢেলে দেয় তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, এই অর্থনৈতিক সম্পর্কের যুগে চীন আসলেই কোনও অযাচিত ঝামেলায় জড়াতে চায় না বিশেষ করে পাকিস্তানের মতো এরকম ‘অর্বাচীন’ রাষ্ট্রের জন্যতো নয়ই।

ওপরের এতো কথা এ কারণেই বলা যে, যারা মনে করেন যে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের যে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে তাতে চিড় ধরার আশঙ্কা থাকতে পারে যদি বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে অতিরিক্ত মিত্রতা করে। এই আশঙ্কা এ কারণেই সত্যি হওয়ার নয় যে, যে কোনও বিচারেই বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন বিচক্ষণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিদ তথা ‘স্টেটসম্যান’হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং দ্বিতীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশও তার স্বতন্ত্র অবস্থান নির্দিষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমীকরণে। ফলে চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার জনগণের স্বার্থকে অক্ষুণ্ন রেখে যতটা গভীরে যাওয়া প্রয়োজন বোধ করবে ততটুকু যেতে পারার সামর্থ অর্জন করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। সে জন্য ভারত বা চীন কোনও দেশেরই ‘চোখ রাঙানি’ বা ‘অভিমানকে’ গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু একথাও সত্য যে, প্রতিটি দেশই তার ঘনিষ্ঠ মিত্র নির্ণয়ে ভৌগলিক অবস্থান ও সম্পর্কের ঐতিহাসিক সূত্রকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বাংলাদেশও রাষ্ট্র হিসেবে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, সুতরাং মিত্রতার পারা নির্ধারণে কে কতোটুকু গুরুত্ব লাভ করবে সে জ্ঞানও তার যথেষ্ট হয়েছে। তাই এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তবে চিন্তার বিষয়টি আসলে কী? সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েই আজকের লেখার ইতি টানবো।

আগেই বলেছি যে, চীনের প্রেসিডেন্ট কেন এতো গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসছেন, তার উত্তরের মধ্যেই রয়েছে আজকের লেখার সারসত্য। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি যে, বাজার অর্থনীতিতে চীন যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে তাতে দেশটির নেতৃত্ব একথা স্পষ্টই বুঝেছে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভাবে যে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেছে তাতে এই দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক দৃঢ় না হলে তার সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। উন্নয়নের যে সম্ভাবনা বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে তাতে বাজার হিসেবে বাংলাদেশ অত্যন্ত উপযোগী ও উৎকৃষ্ট মানের। কাজেই এই উন্নয়নে চীন ‘ইনভেস্টর’ বা লগ্নিকারী হিসেবেতো বটেই, সেই সঙ্গে সহযোগী হিসেবেও থাকতে চাইছে। আর সে কারণেই পুরোনো সিল্ক রুট-এ বাংলাদেশকে সংযুক্ত করার ওপর জোর দিচ্ছে চীন। বাংলাদেশও এই কানেক্টিভিটিকে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই মূল্যায়ন করছে। আর বর্তমান ও ভবিষ্যতের এইসব গগণচুম্বি সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই চীনের প্রেসিডেন্ট তার ব্যস্ততম সফরসূচিতে বাংলাদেশকে অর্ন্তভূক্ত করেছেন। আরও বড় কথা হলো, ২০০৯ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যেকার সম্পর্ক যেন অতীতের সমস্ত আড়ষ্টতাকে পেছনে ফেলে এক নতুন মাত্রা লাভ করেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর ছিল এই নতুন মাত্রার নতুনতর ও শক্তিশালী অধ্যায়। লক্ষ্য করা যায় যে, এরপর থেকে দুদেশ যে কোনও বিচারেই সম্পর্ককে সম্মান দেখাতে কোনও প্রকার কার্পণ্য করেনি কিংবা এই সম্পর্ক নির্ভরও করেনি তৃতীয় কোনও পক্ষের নির্দেশনা কিংবা পরামর্শের ওপরও। একথা এখন আর ধারণা নয় যে, চীনের প্রেসিডেন্টের এই সফর শেষে চীন ও বাংলাদেশ সম্পর্ক আরেক মাত্রায় উন্নীত হবে যেখানে প্রাধান্য পাবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং কেবলমাত্র উন্নয়নজনিত অর্থনীতিই, এর বাইরে বাকি সবকিছুই গৌণ হয়ে পড়বে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে খুব ভীত বোধ করছি এই ভেবে যে, সম্পর্কের নতুনতর এই মাত্রায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের সাবেক চীনপন্থী রাজনীতিবিদগণ ও তাদের প্রিয় জিয়াউর রহমানের করা রাজনৈতিক দল বিএনপি। চীনের প্রেসিডেন্টের এই সফর যদি বাংলাদেশের জনগণ, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য একটি উৎসব হয়ে থাকে তাহলে এই সফর নিশ্চিত ভাবেই এই সাবেক চীনা-বামদের জন্য একটি ব্যর্থতম দিন। রাজনীতির খেলায় তাদের পরাজয়ের বার্তা বয়ে আনলেও বাংলাদেশের জন্য এই সফর নিশ্চিত ভাবেই অতীব আনন্দের ও সফলতার ইঙ্গিতবাহী। আর সে কারণেই বলতে চাই যে, চীনকে এখনও অনেকটাই চেনার বাকি আছে আমাদের, বিশেষ করে সাবেক চীনপন্থী বামদের, যারা এখন চরমভাবে ডানে পতিত হয়েছেন।
লেখক: মাসুদা ভাট্টি, কলামিস্ট

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন