পূর্ণ গেরিলাযুদ্ধের পথে কাশ্মির : মার্কান্ডে কাটজু

  16-10-2016 08:11AM


পিএনএস ডেস্ক: সাহসী ও স্পষ্ট উচ্চারণের জন্য বারবার সারা ভারতের গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন মার্কান্ডে কাটজু। গরু জবাই ও গরুর গোশত খাওয়া নিয়ে যখন ভারতে মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে একের পর এক, তখন তিনি বলেছেন- ‘আমি গরুর গোশত খাই। গরু একটি প্রাণী। এটা কারো মা হতে পারে না। আমাকে কারা মারতে চাও, আমার সামনে এসো। লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছি।’ উরি সেনাঘাঁটিতে হামলায় ১৯ ভারতীয় সেনা নিহতের পর কাশ্মির নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যখন যুদ্ধের মুখোমুখি অবস্থায়, কাটজু তখন পাকিস্তানের উদ্দেশে বলেছেন- আমরা তোমাদেরকে কাশ্মির নেয়ার প্রস্তাব করছি। তবে একটি শর্ত আছে। সাথে বিহারও নিতে হবে। এটা একটা প্যাকেজ ডিল। নিলে পুরো প্যাকেজ নিতে হবে, নইলে নয়। বিহারের দুর্নীতি-নৈরাজ্যে অতিষ্ঠ কাটজু এ কথা বলেছেন বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। তার কঠোর সমালোচনা থেকে রেহাই পাননি মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মাদার তেরেসা পর্যন্ত। মহাত্মা গান্ধীকে তিনি ব্রিটিশের আর সুভাষ চন্দ্র বসুকে জাপানের এজেন্ট আখ্যায়িত করে সমগ্র ভারতে তীব্র সমালোচনার ঢেউ তুলেছেন। ১৯৯৩ সালের মুম্বাই হত্যাকাণ্ডের জন্য ফাঁসি হওয়া ইয়াকুব মেমনের রায়ের পর তিনি বিচারের সমালোচনা করে বলেছিলেন, যে প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তা খুবই দুর্বল। সম্প্রতি কাশ্মির নিয়ে মন্তব্যের কারণে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনার দাবি জানিয়েছে বিজেপিসহ অনেক সংস্থা ও ব্যক্তি। কাটজুর তীব্র সমালোচনা থেকে রেহাই পায়নি ভারতের গণমাধ্যমও। কে এই কাটজু? লক্ষ্ণৌতে জন্ম নেয়া কাটজু মোটেই কোনো সাধারণ ব্যক্তি নন। তিনি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারক।। প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার সাবেক চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি দিল্লি হাইকোর্ট, মাদ্রাজ হাইকোর্ট ও এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। কাটজুর এ লেখাটি ৩ অক্টোবর ভারতের বিখ্যাত আউটলুক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। ভাষান্তর করেছেন মেহেদী হাসান

আমি মনে করি- ভারতের জনগণ, সরকার ও সেনাবাহিনীকে প্রকৃত সত্য জানানো উচিত। আর তা হলো কাশ্মির একটি পূর্ণ গেরিলাযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। গেরিলাযুদ্ধ পূর্ণ রূপ লাভ করতে যাচ্ছে সেখানে। এটি এখন বিকাশমান পর্যায়ে রয়েছে এবং খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। আরেকটি সত্য জানানো উচিত ভারতের জনগণ, সরকার ও সেনাবাহিনীকে। আর সেটি হলো, ভারতের উগ্র দেশপ্রেমিক গণমাধ্যম দ্বারা আমরা বিপথে পরিচালিত হচ্ছি। এসব গণমাধ্যমকে আমি ডন কুইক্সোট (স্পেনের বিখ্যাত কল্প উপন্যাস), লর্ড হ হ এবং ড. গোয়েবলস হিসেবে বিবেচনা করি।

বাস্তব সত্য হলো, আমরা কাশ্মিরের বেশির ভাগ যুবককে পর করে দিয়েছি এবং তারা এখন প্রচণ্ডভাবে ভারতবিরোধী।
একটি গেরিলাযুদ্ধকে সফল করতে অবশ্যই জনসমর্থন থাকতে হয়। ‘জনগণ হলো সমুদ্র, আর আমরা হলাম সে সমুদ্রের মাছ, যেখানে আমরা সাঁতার কাটি।’ চীনা রেড আর্মির একজন বিখ্যাত নেতার মন্তব্য এটি। জনসমর্থন ছাড়া কোনো গেরিলাযুদ্ধ দীর্ঘ দিন টিকতে পারে না। চে গুয়েভারা বলিভিয়ায় এটি অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলেন।

কিন্তু কাশ্মিরে যোদ্ধাদের প্রতি অবশ্যই জনসমর্থন রয়েছে। এ সত্য আমরা লুকিয়ে রাখতে পারি না। এটাও সত্য যে, কাশ্মিরি যুবসমাজ প্রশিক্ষিত নয় এবং সশস্ত্রও নয়। এ মুহূর্তে এ সংখ্যাটি খুবই কম। কিন্তু যোদ্ধাদের প্রতি কাশ্মিরের যুবসমাজ সহানুভূতিশীল। তারা যোদ্ধাদের সব ধরনের তথ্য, আশ্রয় ও খাদ্য দিয়ে সহায়তা করবে। বুরহান ওয়ানির নামাজে জানাজায় জনসমাগম থেকে এ চিত্রই পাওয়া যায়।

বলা হচ্ছে, কাশ্মিরের সব যোদ্ধা সীমান্তের ওপার থেকে এসেছে। আমি আবার বলছি, এটা সত্য নয়। যোদ্ধাদের বিরাট অংশ স্থানীয়। যেমন বুরহান ওয়ানি স্থানীয়। তবে তারা চীন ও পাকিস্তান থেকে অস্ত্র পাচ্ছে।

কাশ্মিরের গেরিলাযুদ্ধ আগামী দিনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। ব্যাখ্যা করছি এর কারণ। আমার অনেক আত্মীয়স্বজন রয়েছেন, যারা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তারা কাশ্মিরে অথবা বিদ্রোহী অধ্যুষিত সেভেন সিস্টারে নিয়োজিত ছিলেন। তারা আমাদের সৈন্যদের মানসিক অবস্থার বিবরণ দিয়েছেন। যেমন ধরা যাক, ১০ অথবা ২০ জনের একটি সেনা দল কাশ্মিরে টহল দিচ্ছে। এমন সময় যদি যোদ্ধাদের হামলায় দু-তিনজন সৈন্য মারা যায়, তখন বেঁচে থাকা সৈন্যরা বেপরোয়াভাবে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে নিহত সঙ্গীদের জন্য। তারা তখন হয়তো কোনো পার্শ্ববর্তী গ্রামে প্রবেশ করে। তারা মনে করে, এরা যোদ্ধাদের আশ্রয় দেয় (অবশ্যই দেয়)। তাই সৈন্যরা গুলি করে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করে। অথচ ওপর থেকে এ ধরনের কাজের বিষয়ে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অনেক সময় কর্মকর্তারাও এসব সৈন্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।

ভারতের অনেক সৈন্যকে দীর্ঘ দিন ধরে বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকায় নিয়োজিত থাকতে হয়। একজন সেনা যখন দীর্ঘ দিন এসব এলাকায় নিয়োজিত থাকে, তখন তারা মানসিকভাবে আর স্বাভাবিক থাকে না। মনে করে, যেকোনো সময় তার মৃত্যু হতে পারে। তখন সে মাঝে মধ্যে বেপরোয়া হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের প্রতি গুলি চালায়। ভিয়েতনামে মার্কিন সৈন্যদের অভিজ্ঞতা এটারই সাক্ষ্য দেয়।

এসবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যা ঘটে তা হলো, প্রচণ্ড ঘৃণা। যখন কারো প্রিয়জন সৈন্যদের গুলিতে মারা যায় তখন সে প্রতিশোধ নিতে যোদ্ধায় পরিণত হয়। এভাবেই গেরিলাযুদ্ধ সম্প্রসারিত হয় আর গেরিলাদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। তাদের শুধু অস্ত্র ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু চীন ও পাকিস্তান সে ঘাটতি পূরণ করে যাচ্ছে। এমনকি, আমরা পাকিস্তানকে এ থেকে বিরত রাখতে পারলেও চীনকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। কারণ সে সুপার পাওয়ার। তারা ভারত ধ্বংস করতে চায় এবং বাজার দখল করতে চায়। কোনো সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে (জনক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে শুধু চিহ্নিত লক্ষ্যবস্তুতে সামরিক আক্রমণ। এটা বিমান হামলা হতে পারে অথবা বিমান থেকে সৈন্য অবতরণ করিয়ে বা ঝটিকা স্থল আক্রমণও হতে পারে) কোনো কাজ হবে না। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে অনেক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছে, কিন্তু কোনো ফল হয়নি।

একজন সৈন্য কেবল আরেকজন সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে, কিন্তু জনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে না। একটি বাঘ বড় কোনো শিকারিকে আক্রমণ করতে পারে, কিন্তু মশার ঝাঁকে সে আক্রমণ চালাতে পারে না। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে আমরা ক্রমাগত দম্ভ করে যেতে পারি। কিন্তু এটা কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। কাশ্মিরে আমাদের সৈন্যদের ওপর একের পর এক গেরিলা আক্রমণ চলতেই থাকবে। সম্প্রতি বারামুল্লা সেনাক্যাম্পে যেভাবে ‘হিট অ্যান্ড রান’ আক্রমণ হয়েছে, সেভাবে এ আক্রমণ হতে থাকবে।

গেরিলাদের চমকপ্রদ সুবিধা রয়েছে। কখন কোথায় কত সময় ধরে হামলা চালাবে, সে সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারে। আর তাদের পেছনে যদি থাকে জনসমর্থন, তবে তারা দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্স এর মুখোমুখি হয়েছিল। কাশ্মির পরিস্থিতি নিয়ে এ ধরনের ভয়ানক দৃশ্য অঙ্কন করায় আমি দুঃখিত। কিন্তু সত্য অবশ্যই সব ভারতীয়কে জানাতে হবে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন