খাদিজা থেকে আনু মুহাম্মদ: নিরাপত্তাহীনতায় বাংলাদেশ

  24-10-2016 01:45PM


পিএনএস ডেস্ক: ‘স্মৃতির খাতায় ময়লা জমলেও অক্ষর গুলি একেবারে অস্পষ্ট হয়ে যায়না। সময়ের ধুলা ঝেড়ে সে আবার ভেসে উঠে। সম্প্রতি সিলেটে এক কলেজ ছাত্রীকে বদরুল নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী চাপাতি দিয়ে কোপানোর সময় অনেক মানুষ দূরে দাড়িয়ে সে দৃশ্য দেখেছে। কেউ কেউ আবার ভিডিও করেছে। কিন্তু চরম সত্য হলো বদরুলকে কেউ বাধা দেয়নি; বা দিতে সাহস করেনি। এ ব্যাপারে সংসদের দ্বাদশ সমাপনী দিবসে প্রধানমন্ত্রীর একটি ‘ব্যাথিত’ বক্তব্য ইতোমধ্যেই মিডিয়াতে প্রচারিত হয়েছে। আবার জনতা কর্তৃক বদরুল তাৎক্ষণিকই গ্রেফতারও হয়েছে। কিন্তু দেশে বিচার প্রক্রিয়ায় যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে তাতে কিন্তু বিচার কার্য যে কতটুকু আগাবে সে প্রশ্ন নিশ্চয় থেকেই যাচ্ছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিষ্ট্রটল রাষ্ট্রকে নৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে উল্লেখ্য করেছেন। তিনি বলেছেন, সর্ব সাধারণকে সৎ ও সুন্দর পথে পরিচালনা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যে শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়ে ঐ বর্বর দৃশ্য দেখেছে তাদের শুধু ধরটাই আছে; মাথা নেই। প্রতিনিয়ত তাদের মাথা কাটা হয়েছে, হচ্ছে। যারা দাঁড়িয়ে দেখেছে তারা নিশ্চয় নিতান্তই সাধারণ মানুষ নয়; এরা জাতীর ভবিষ্যৎ কর্নধার। এরা সাহসিকতা এবং নৈতিকতার প্রতিক। যাদের কাছে সাধারণ জনগণের আশা আকাঙ্খা অনেক বেশী, আর সেই তারাই আজ সাহস ও নীতি-নৈতিকতাহীন।

২০১২ সালে জানুয়ারী মাসে বদরুল এই খাদিজাকেই লাঞ্ছিত করার অপরাধে গণধোলাইয়ের শিকার হয়েছিল। তখন বর্তমান সরকার দলীয় নেতাকর্মী ও প্রচার মাধ্যমের আর্শিবাদে বদরুল নিরুৎসাহিত না হয়ে বরং অনেক বেশী উৎসাহিত হয়ে উঠে। আর সরকারী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগতো তাকে উচ্চ পদে আসিন করে রীতিমতো সম্মানীত করে। অপরদিকে সেদিন যে মানুষগুলো প্রতিবাদ করলো পুলিশের তালিকাতে তাঁরা হয়ে গেলেন ঘাতক, সন্ত্রাসী শিবিরকর্মী।

সে দিন যে বুদ্ধিজীবীদের উচিৎ ছিল বদরুলকে প্রচন্ড ধিক্কার জানানো, তাদের মধ্যে কেউ কেউ কিঞ্চিত আফছোস করলেন মাত্র। যে সংবাদ মাধ্যমের উচিৎ ছিল প্রকৃত ঘটনার সত্য সংবাদ প্রচার করা সেখানে তাদের কেউ কেউ স্ব-ইচ্ছা মাফিক সংবাদ প্রসব করলো। যে ছাত্র সংগঠনের উচিত ছিল বদরুলকে বহিস্কার করা তারা বরং উচ্চ পদ দিয়ে তাকে সম্মানীত করলো। যেখানে সরকারের উচিত ছিল তাকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা, সেখানে সরকার ও সরকারীদল তাকে সাহায্য করার মধ্যোদিয়ে বরং পুরস্কিত করলেন। আর এভাবেই বদরুল হয়ে উঠলো বর্বর চাপাতি বদরুলে।

বিশ্বজিৎকে যেদিন কুপিয়ে হত্যা করা হয় সেদিন অগনিত পুলিশ সেখানে উপস্থিত ছিল, তারাও বিশ্বজিৎকে বাঁচানোর কোন চেষ্টাই করেনি। সেখানে সাধারণ নিরিহ জনগণ যারা কার্যত শক্তিহীন, ন্যায় বিচার প্রাপ্তির ভরসাহীন তারা কি ভাবে খাদিজাকে রক্ষা করতে এগিয়ে যাবে। উপরোন্ত জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা; তারা কি করে প্রতিবাদ করবে, বাধা দিবে?

সম্প্রতি তেল গ্যাস ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। কারণ তিনি সুন্দরবন বিধ্বংসী রামপাল কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প বিরোধীতা করছেন। সরকারের এ সুন্দরবন বিধ্বংসী রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিরোধীতা একা আনু মুহাম্মদ করেন না। আরও অনেকেই করেন। ইউনেস্কো তাদের বিশেষজ্ঞদের অনুসন্ধান রিপোর্ট ২৪ সেপ্টম্বর একাধিক পত্রিকায় লিড নিউজ হিসাবে প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা বলেছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের উপর অর্থনৈতিক চাপ অব্যাহত থাকবে, জলবায়ুরও ধ্বংসাত্মক পরিবর্তন হবে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের জন্য লাভের চেয়ে ক্ষতি অনেক বেশী। ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উচ্চতর চিমনির নির্গত গ্যাস বায়ু মন্ডলের বাতাস দূষিত করবে। প্রতি ঘন্টায় পাঁচ হাজার কিউবিক মিটার পানি নদী থেকে তোলা হবে, এবং ব্যবহারের পর দূষিত অবস্থায় সুন্দরবনের নদীতে ছাড়া হবে। এতে সুন্দরবনের নদীর পানি দূষিত হবে। জলজ প্রানীর অস্তিত্ব ধ্বংস হবে। জাহাজ চলাচলের জন্য নতুন করে নদীর নাব্যতা সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য নদীকে ড্রেজিং করতে হবে প্রায় অর্ধকোটি কিউবিক ফিট মাটি। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন হলে সুন্দর বনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। জাতীসংঘের বিজ্ঞান শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো বাংলাদেশকে সুপারিশ করেছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে। সুপারিশ মানা না হলে ২০১৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিশন-এর সভায় এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ একজন দেশ প্রেমিক। তিনি আপাদত ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করছেন না। তিনি জাতীয় জীবনের সমূহ সমস্যার সমাধান পেতে চান, জাতীয় সম্পদ রক্ষা করতে চান। আর তাই আনু মুহাম্মদকে হত্যার হুমকি সহজ ভাবে মেনে নেয়া যায়না। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ-এর মতো একজন শিক্ষক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদকে হত্যার হুমকি দাতার পিছনে নিশ্চয় বড় কোন শক্তি লুকায়িত। অতএব সরকারের উচিৎ হুমকিদাতাকে অনতিবিলম্বে খুজে বের করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচাররের মাধ্যমে উদাহরণ সৃষ্টি করা। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদসহ দেশের সকল নাগরিক ও তেল গ্যাস ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সকল আন্দোলনকারী ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধানে সরকারের নিশ্চয় অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে চলছে। আজ অবস্থাটাই এমন যেন, যে যত বড় সন্ত্রাসী সে তত বড় নেতা। রাষ্ট্র জুড়ে যেন সন্ত্রসী গডফাদারদেই কতৃত্ব। আর তাই নিরাপত্তাহীন হয়ে পরেছে গোটা বাংলাদেশ।

মনে রাখা উচিত পেশীশক্তির দাপট, বিচার বিহীন হত্যার অপরাজনীতি, দলীয়করণ, শোষনের নিপিড়ণের রাজনীতি রাষ্ট্র ও জনগণের কোন মঙ্গল বয়ে আনে না, কিংবা আনতে পারে না। ভারসাম্যহীন ক্ষমতা কিছু কাল কার্যকরি থাকে; চীর দিন নয়। কথায় আছে, সাপুড়ের মৃত্যু নাকি সাপের কামড়েই হয়। প্রকৃতির প্রতিশোধ বড়ই নির্মম। ইতিহাসে তা বার বার প্রতিফলিত হয়েছে। যেদিন নির্বোধ ঐ ধর গুলিতে আবার মাথা গজাবে, সেদিন কেউ তাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। প্রতিশোধ তারা নিবেই। সেদিন হয়তো কোন নেতারও প্রয়োজন হবে না। সময় নিজেই নেতৃত্বের ভুমিকায় অবত্তীর্ন হবে। এটাই চিরায়ত, এটাই ইতিহাস।
লেখক: আলী আকবার, কলাম লেখক। ফোন: ০১৬৭৪-৪৯৬৪১৪।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন