জৌলুস আর আলোকছটার কাউন্সিল প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

  27-10-2016 08:01AM


পিএনএস ডেস্ক: কাউন্সিল শেষে নবগঠিত প্রেসিডিয়াম সদস্যদের যে তালিকা ঘোষিত হয়েছে তা অনেককেই খুশি করেনি। কারণ এ প্রেসিডিয়ামে এমন কয়েকজনের নাম আছে যারা প্রবলভাবে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। এছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে অপরিচিত ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তিও কর্মীদের, সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, হতাশ করেছে। অবশ্য এটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বড় দলগুলোকে বিভিন্ন কারণে এমন সব ব্যক্তিকে দলীয় পদ দিতে হয় যা কর্মীদের সন্তুষ্ট করে না, বরং বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তাই আগামী দিনে বোঝা যাবে কর্মীরা নতুন নেতৃত্ব নিয়ে কতখানি সুখী।

চোখ ধাঁধানো জৌলুস, লাখ লাখ ‘মরিচা বাতির’ আলোকছটা এবং কঠোর শৃংখলা ও নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শেষ হল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অধিবেশন। আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করেছেন, এটা তাদের দলের বৃহত্তর সম্মেলন। এ দাবির পেছনে সত্যতা আছে। সারা দেশ থেকে আসা ত্রিশ হাজারের বেশি কাউন্সিলর ও ডেলিগেটের উপস্থিতি, বিদেশী অতিথিদের পদধূলি- সব মিলিয়ে ঢাকা শহর প্রায় থমকে গিয়েছিল দু’দিন। এবং এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত।

ক্ষমতাসীন দল হলে আমাদের মতো দেশগুলোতে যে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অথচ বিরোধী, বিশেষ করে বিএনপি দাবি করেছে, প্রায় সাত মাস আগে অনুষ্ঠিত তাদের কাউন্সিল সভার সময় তারা এসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেননি। বিরোধী পক্ষ হলে এ বঞ্চনার জন্য তৈরি থাকাই বাঞ্ছনীয়।

কাউন্সিল শেষে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, তা একইসঙ্গে প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত। ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হবেন এমন একটা খবর ২০ অক্টোবর চাউর হয়েছিল এবং বাস্তবেও তা-ই ঘটেছে। ওবায়দুল কাদেরের জন্য এ প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে তৃপ্তির- কেননা ছাত্রজীবন থেকেই যে দলের সঙ্গে তিনি একাÍ হয়ে আছেন পথপরিক্রমায় সে দলের দ্বিতীয় শীর্ষ পদে পৌঁছা বিভিন্ন দলে বিভিন্ন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হয় না। তার রাজনৈতিক জীবনে মন্ত্রিত্ব এবং দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ- দুটিই চরম পাওয়া। বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তিনি কখনও দলের প্রধান হতে পারবেন না।

শেখ হাসিনা যতদিন কর্মক্ষম থাকবেন ততদিন এটাই স্বাভাবিক। যদিও দু-একটি গণমাধ্যমে ভিন্ন কথা বলা হয়েছিল। তিনি নিজেও কয়েকদিন আগে যে মন্তব্য করেছিলেন তাতে ক্লান্তির একটা ইঙ্গিত ছিল। সেটা স্বাভাবিক। কেননা ৩৫ বছর ধরে দলীয় নেতৃত্ব এবং প্রায় ১৩ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্ব একজনের জীবনীশক্তিকে ক্ষয় করে দিতে পারে। তিনি অতীতেও একবার দৃঢ়তার সঙ্গে রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সে কথা রাখতে পারেননি। চৌকাঠ পেরিয়ে ক্ষমতার অন্দরমহলে প্রবেশ করলে সেখান থেকে ফিরে আসা যায় না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ক্ষমতার মোহ পিছু ছাড়ে না।

দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কেন অব্যাহতি পেলেন, তা অনুমান করা কঠিন নয়। যদিও শেখ হাসিনা তাকে আপন ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মিডিয়ার চোখে পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি সৈয়দ আশরাফ জীবনযাপনে দলীয় অনেক ঝামেলায় নিজেকে জড়াননি। এমনকি দলীয় কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় ছিলেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। যারা গত কয়েক বছরে দলের বক্তব্য শুনেছেন, তারা মুখপাত্র হিসেবে ভিন্ন চেহারা দেখেছেন। অবশ্য এর আগেও আকস্মিকভাবেই সৈয়দ আশরাফকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছাড়তে হয়েছিল। তার পরিবারের একাংশ প্রবাসে বসবাস করেন। সম্ভবত দলীয় সমীকরণে কোথাও একটা ঝামেলা আছে, যা হয়তো সৈয়দ আশরাফ নিজেও জানেন না।

কাউন্সিল শেষে নবগঠিত প্রেসিডিয়াম সদস্যদের যে তালিকা ঘোষিত হয়েছে তা অনেককেই খুশি করেনি। কারণ এ প্রেসিডিয়ামে এমন কয়েকজনের নাম আছে যারা প্রবলভাবে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। এছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে অপরিচিত ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তিও কর্মীদের, সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, হতাশ করেছে। অবশ্য এটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বড় দলগুলোকে বিভিন্ন কারণে এমন সব ব্যক্তিকে দলীয় পদ দিতে হয় যা কর্মীদের সন্তুষ্ট করে না, বরং বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তাই আগামী দিনে বোঝা যাবে কর্মীরা নতুন নেতৃত্ব নিয়ে কতখানি সুখী। দলীয় নেতৃত্বের নতুন কাঠামোয় দলের অনেক প্রবীণ সদস্য ছিটকে পড়েছেন। এ প্রবীণরা যে গুরুত্ব হারাচ্ছেন, তা অনেক দিন থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।

পদপ্রাপ্তির পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নতুন সাধারণ সম্পাদক কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন- যা তাকে মোকাবেলা করতে হবে। এসবের মধ্যে আছে- জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল এবং আগামী নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করে ক্ষমতায় যাওয়া। এছাড়াও রয়েছে দল গোছানো, কর্মীদের সঙ্গে আরও বেশি যোগাযোগ ইত্যাদি। নির্বাচনের বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। অনেক আগেই টকশো’তে বলেছি, ২০১৯ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবেই হোক এ নির্বাচনে তারা জয়লাভ করতে চাইবেন ২০২১ সালে অনুষ্ঠিতব্য অনুষ্ঠানমালার পৌরোহিত্য করার জন্য। সে বছর উদযাপিত হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এমন একটি বছরে আওয়ামী লীগ অন্য কাউকে দেশের ক্ষমতায় মেনে নেবে না। এ অবস্থায় ২০১৯ সালের নির্বাচনী ফলাফলকে করায়ত্ত করতে হবে।

গত কয়েক মাস ধরে আওয়ামী লীগের নেতারা বলে আসছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতবে, অন্য কাউকে জিততে দেয়া হবে না। এখানে অন্য কেউ মানে বিএনপি। কাউন্সিলের বক্তৃতা ও রিপোর্টেও বিএনপি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় সব বিষোদ্গারই করা হয়েছে। যখন বলা হয় জিততে হবে, তখন বোঝা যায় এটা একাধিপত্য স্থাপনের সুপ্ত বাসনার বহিঃপ্রকাশ। রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জয়লাভের জন্য, হেরে যাওয়ার জন্য নয়। কিন্তু সে অংশগ্রহণ যদি হয় জয় ছিনিয়ে নেয়ার জন্য, তাহলে তা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত হয়ে যায়।

সম্মেলনে দলীয়প্রধানের বক্তৃতায় উল্লেখিত দুটি উচ্চাকাক্সক্ষা সম্পর্কে মন্তব্য করা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, প্রত্যেক নাগরিককে ঘর দেয়া হবে এবং বিশ বছর পর দেশে কেউ গরিব থাকবে না। দুটি প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়নের অযোগ্য। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দেশ হলে প্রত্যেক নাগরিককে ঘর দেয়ার প্রশ্ন উঠত- কিন্তু এ জনবহুল দেশে জমির সীমিত আয়তনে প্রত্যেককে ঘর দেয়া যাবে না। আর গরিবি হটাও কর্মে সফল হতে হলে আলাদিনের চেরাগ প্রয়োজন হবে। অগ্রগতির চরম পর্যায়ে পৌঁছেও চীন এখনও গরিবি হটাতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য উন্নত দেশও এখন পর্যন্ত গরিবি হটাতে পারেনি। সমাজ যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারা তাদের স্বার্থেই গরিবি টিকিয়ে রাখেন।

সম্মেলনের প্রাপ্তি সম্পর্কে এখনই পুরো মন্তব্য করার সময় আসেনি। কারণ, বিগত সাত বছর ধরে জনগণের অনুমোদন না নিয়ে ক্ষমতায় থাকার ফলে দল এখন সরকারে লীন হয়ে গেছে। এটা স্বাভাবিক। ক্ষমতায় থাকলে যেসব সুবিধা পাওয়া যায়, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভোগ করা যায়, দলে থেকে সেটা সম্ভব হয় না। তাই দল ক্ষমতায় গেলে সবাই সরকারের অংশীদার হতে চায়। এই হতে চাওয়ার প্রক্রিয়ায় গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগ যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়েছে, সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়েছে, নতুন সম্পাদক সে অবস্থা থেকে দলকে উদ্ধার করতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। দল ক্ষমতায় থাকলে প্রত্যেকে নিজেকে যোগ্য মনে করেন, মনে করেন তিনি না থাকলে দল থাকবে না। দলগুলোতে রাজনৈতিক চর্চার অভাবেই এমনটা ঘটে।

প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে তার মতান্তর হতে পারে, মতভেদ হবে না। শুধু সৈয়দ আশরাফ নয়, অন্যদের সঙ্গেও তার মতান্তর আছে। এই মতান্তর মতান্তরে সীমাবদ্ধ থাকলেই তিনি হয়তো দল গোছাতে পারবেন। সৈয়দ আশরাফ তার বক্তৃতায় বলেছেন, তার আমলে দলে কোনো ইজম হয়নি। কিন্তু ইজমের অনুসারীরা নিশ্চুপও থাকেনি।

সবশেষে যা বলা প্রয়োজন তা হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকে ওবায়দুল কাদের দলীয় কর্মকাণ্ডের প্রতি সুবিচার করতে পারবেন কিনা সে প্রশ্ন থেকে যায়। যদিও তিনি তা মনে করেন না। অবশ্য এর জবাব মিলবে ভবিষ্যতে। তবে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির যে বন্ধ্যত্ব চলছে, তার অবসান ঘটানো নতুন সাধারণ সম্পাদকের এখতিয়ারে পড়বে না। এটা দলীয় প্রধানের একক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।

কাউন্সিলের ভাষণে শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচন চান না। এটা করতে হলে সব দলের মতামতের ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। অপ্রিয় হলেও, প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। আগামী নির্বাচনে অতীতের পুনরাবৃত্তি হলে তা সবার জন্যই বিপর্যয় ডেকে আনবে। কারণ সংখ্যার হিসাবে মাইনরিটির ক্ষমতা দিয়ে মেজরিটিকে দীর্ঘদিন শাসন করা যায় না।

মাহফুজ উল্লাহ : সাংবাদিক ও শিক্ষক


পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন