আওয়ামী লীগ সম্মেলনের পোস্টমর্টেম

  03-11-2016 12:37PM

পিএনএস ডেস্ক:আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন জাঁকজমক আয়োজনে মহামিলনের মহোৎসবের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। শেষ হয়েছে দলের নতুন ওয়ার্কিং কমিটি, সংসদীয় বোর্ড, স্থানীয় সরকার নির্বাচনী বোর্ড ও উপদেষ্টাম-লীর ঘোষণা। শেষ হয়নি শুধু সম্মেলনে আসা নতুন কমিটি ও দলের আগামী দিনের কর্মকা- কেমন হবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ, পোস্টমর্টেম হচ্ছে কমিটির। কমিটিতে যারা ঠাঁই পেয়েছেন তারা মহাখুশি। ফুলে ফুলে সতীর্থরা অভিনন্দন জানাচ্ছেন। যাদের প্রত্যাশা ছিল ব্যাপক কিন্তু পাননি প্রত্যাশিত পদ, এমনকি ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যপদ। তাদের মন খারাপ। তবুও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মন্দ হয়নি, দু-এক জায়গায় ছন্দপতন ঘটলেও অনেক জায়গায় পোড় খাওয়া ত্যাগীদের মূল্যায়নও হয়েছে।

আওয়ামী লীগের এ সম্মেলনের গোটা চেহারার দিকে তাকালে যে চিত্রপট উঠে আসে তা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সাফল্যের পাল্লাকে ভারীই করেনি, ঘোষিত নতুন কমিটির কাঁধে চাপিয়েছে আগামী নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কেবল জাঁকজমকপূর্ণ, বর্ণাঢ্য, চোখ ধাঁধানো ব্যয়বহুল বর্ণিল আয়োজনই চোখে পড়েনি, স্মরণকালের বৃহত্তম এই সম্মেলনে গোটা আওয়ামী লীগ উৎসবের আনন্দে জেগে উঠেছিল। দলের জন্য নবজাগরণই ঘটেনি; নেতৃত্বেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ সাধারণ সম্পাদক থেকে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বিদায় যেমন ছিল সম্মান ও গৌরবের, তেমনি এই পদে ওবায়দুল কাদেরের নির্বাচিত হওয়ার স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস ও আনন্দ ছিল গৌরবের। এত ফুল, এত উল্লাস সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে কোনো সাধারণ সম্পাদককে ঘিরে কখনো ঘটেনি।

সম্মেলনে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নানা পর্বের ভাষণ যেমন ছিল দল ও দেশবাসীর জন্য তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক শক্তির জন্য ছিল অর্থবহ। তিনি একদিকে তার উন্নয়নের রোডম্যাপ, দারিদ্র্যমুক্তি ও স্বপ্নের রূপকল্প যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্স অবস্থান আবারও ঘোষণা করেছেন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, সুশাসন নিশ্চিতকরণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদবিরোধী বক্তব্যের মতো পরিষ্কার, দৃঢ় বক্তব্য না এলেও আগামী জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার প্রশ্নে পরিষ্কার মনোভাব তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে জনগণের হৃদয় জয় করেই দলকে ক্ষমতায় আনার জন্য কর্মীদের তাগিদ দিয়েছেন। সম্মেলন ঘিরে বারবার তিনি বলেছেন, নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনি দায়িত্ব থেকে বিদায় নিতে চান। কিন্তু তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত গোটা আওয়ামী লীগ আবেগ, অনুভূতি আর স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের মধ্য দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে দলের নেতৃত্বে তার কোনো বিকল্প নেই। দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদকের নাম যেমন তিনি বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দিয়ে প্রস্তাব করিয়েছেন। কর্মীদের জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী দিনের দল পরিচালনার সেতুবন্ধ তৈরি করবেন তার স্নেহ ও আস্থাভাজন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তেমনি কাউন্সিলরদের সামনে গভীর স্নেহে হাতটি মুঠোয় নিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন ’৭৫-এর পিতৃহারা সৈয়দ আশরাফ তার ভাই।

কাউন্সিলে চল্লিশটি জেলার অধিক নেতাদের বক্তব্য শুনেছেন। যেসব জেলায় দলীয় এমপিরা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক তাদের বক্তব্য দিতে দেননি। এমনকি সম্মেলন ঘিরে ব্যাপক আলোচনা ছিল, প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ পাচ্ছেন। কাউন্সিলরাও তাকে রাখার জন্য আকুতি জানিয়েছিলেন। হার্ভার্ড পাস আইটি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয় দেশে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব ঘটিয়ে নিজের একটি ইমেজ তৈরি করেছিলেন। সম্মেলনস্থলে তুমুল করতালিতে অভিনন্দিত জয় নিজেই বলেছেন, বিদেশে থেকে দলের পদ গ্রহণ ঠিক নয়। শেখ হাসিনাও সন্তানকে, বোনকে, তার পুত্রকে ও নিজের কন্যাকে কমিটিতে না রেখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অন্যদিকে দেশের রাজনীতিতে এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে আওয়ামী লীগ কর্মীদের অকুণ্ঠ সমর্থনে এই বার্তা চলে গেছে যে, শেখ হাসিনার উত্তরাধিকার হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয়ই আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতা, যেটি পরবর্তীকালে সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন। এমনকি সম্মেলনে জোর আলোচনা ছিল, সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠ, দক্ষ, তরুণ মন্ত্রীরা ওয়ার্কিং কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাচ্ছেন। কিন্তু সেটিও বাস্তবে রূপ নেয়নি।

প্রেসিডিয়ামে যারা নতুন অভিষিক্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে একজনকে ঘিরেই বিতর্ক রয়েছে। বাকিদের কিন ইমেজ আছে। অন্যদিকে তারা কেউ মন্ত্রিসভার সদস্য নন। সুবেহ সাদেকের সময় ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে হেঁটে এসে মন্ত্রণালয় থেকে দলের কাজে রাত পর্যন্ত পরিশ্রমী, কর্মঠ, উদ্যমী ওবায়দুল কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক করা হলেও তার পর সম্পাদকম-লীতে আর কাউকেই রাখা হয়নি, যারা মন্ত্রিসভার সদস্য। মন্ত্রীদের দলের দায়িত্বশীল পদে না রাখার মধ্য দিয়ে এই বার্তা দিয়েছেন যে, সরকারে হারিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগকে বের করে শক্তিশালী, সাংগঠনিক রূপ দিতে চান। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকারের উন্নয়ন, নেতাকর্মীদের আচরণে পরিবর্তন এনে গুণগত মান বিকাশের পথে আগামী দিনের ভোটযুদ্ধে তারা গণরায় নিতে চান। সরকার যেমন শক্তিশালী, তেমনি দলকেও শক্তিশালী করার জন্য মন্ত্রীদের সম্পাদকম-লীতে রাখা হয়নি। এমনকি ওয়ার্কিং কমিটিতেও মন্ত্রিসভার সদস্য একেবারে কম। বর্তমান মন্ত্রিসভার ৪৫ জন দলীয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর মধ্যে ৩৫ জনই কমিটিতে ঠাঁই পাননি। প্রধানমন্ত্রীসহ ১০ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবারের ওয়ার্কিং কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন। নতুন ওয়ার্কিং কমিটির ২৭ জনের মধ্যে ১৯ জনই সদস্যপদে এসেছেন। ৮১ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটির ৭৪ জনের নাম ঘোষিত হয়েছে। এদের মধ্যে মাঠের পোড়খাওয়া তরুণ কর্মী মারুফা আক্তার পপি যেমন রয়েছেন, তেমনি মৌলভীবাজারের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক রফিকুর রহমান, রাকসুর সাবেক ভিপি, রাজশাহীর ত্যাগী রাজনীতিবিদ নুরুল ইসলাম ঠা-ু, রাবি ছাত্রলীগের ’৭৫-পরবর্তী সভাপতি, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আমিরুল আলম মিলনকে স্বীকৃতি দিয়েছেন ওয়ার্কিং কমিটিতে ঠাঁই দিয়ে। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, জাকসুর সাবেক ভিপি, কর্মীবান্ধব, গণমুখী চরিত্রের এনামুল হক শামীম অসীম ধৈর্যের পর সাংগঠনিক সম্পাদক হয়ে পুরস্কৃত হয়েছেন। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ অনেক যোগ্য নেতা থাকলেও ঠাঁই হয়নি ওয়ার্কিং কমিটিতে। এ নিয়ে অনেকের মন বিষণ্ণ। তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো বিশাল দলে ওয়ার্কিং কমিটি মাত্র ৮১ জনের।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, একটি সংগঠনের সবাই সক্রিয় ও সমানভাবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারেন না। তবুও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যাদের ওয়ার্কিং কমিটিতে নিয়েছেন তিনি তার পরিকল্পনামতোই নিয়েছেন। তিনিই জানেন, কাকে দিয়ে কতটা কাজ করাবেন। দলের নেতাকর্মীদের জন্য এবারের কমিটি এই বার্তাও দিয়েছে যে, দলের প্রতি অনুগত থেকে কাজ করে গেলে এক সময় স্বীকৃতি পাওয়া যায়। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এতটাই ময়দানে যে, মন্ত্রণালয় থেকে সড়কে, সড়ক থেকে দলীয় কার্যালয়ে, দলীয় কার্যালয় থেকে সংসদ ভবন এলাকার সরকারি বাসভবনের দুয়ার সারা দেশের কর্মীদের জন্য খুলে রেখেছেন। তিনি না থাকলেও তার স্ত্রী ইসরাত উন নেসা এতটাই গণমুখী যে, মাঠ নেতাকর্মীদের আপ্যায়নে কার্পণ্য করেন না। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, খুব তাড়াতাড়ি অঞ্চলভিত্তিক টিম গঠন করে দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দ্বন্দ্ব, বিবাদ দ্রুত মিটিয়ে ফেলবেন। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতাকর্মীরা অভিন্ন কণ্ঠে একই সুরে কথা বলবেন এবং সংগঠনকে শক্তিশালীকরণই নয়, নিজেদের আচরণে মানুষের মন জয় করে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে যাতে ভূমিকা রাখতে পারেন সেভাবেই দলকে সাজানো হবে। তার সঙ্গে আলাপ করে যতদূর জানা যায়, আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি শেখ হাসিনার অভিভাবকত্বে একটি টিম ওয়ার্ক গঠনের মধ্য দিয়ে দলের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিতই নয়; ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তাদের পক্ষে গণজাগরণ ঘটাতে চান। কর্মোদ্যমী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার গতির প্রতি তাকিয়ে সবাই বলেন, অ্যারাবিয়ান ব্ল্যাক হর্সের মতো তিনি ছোটেন। ২৪ ঘণ্টার ১৮ ঘণ্টাই কাজ করেন। সরকারের পাশাপাশি সারা দেশের সংগঠনের চিত্র তার নখদর্পণে। তার সঙ্গে রানিংমেট হিসেবে মিস্টার অ্যাকশন হিসেবে পরিচিত ওবায়দুল কাদের যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ের প্রচার, সংগঠন শক্তিশালীকরণ ও জনমত পক্ষে টানার ক্ষেত্রে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে এই ওয়ার্কিং কমিটি সেদিকেই এখন পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এবারের ওয়ার্কিং কমিটি দেখার পর এটা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে যে, অনেক প্রভাবশালী, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতা, সংগঠক যারা সংস্কারের অভিযোগে ছিটকে পড়েছিলেন তাদের আর প্রত্যাবর্তন ঘটছে না। অন্যদিকে সমাজজীবনে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটা শূন্যতাও সৃষ্টি হয়েছে। যার ছায়া ওয়ার্কিং কমিটিতে কিছুটা হলেও পড়েছে। ফণীভূষণ মজুমদার থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামে এসেছিলেন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের তারকাখ্যাতি নিয়ে।

অন্যদিকে রমেশ চন্দ্র সেন ও পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য কুড়িগ্রাম ও যশোরের দলীয় রাজনীতিতে দীর্ঘপথ হাঁটলেও প্রেসিডিয়ামে ঠাঁই পেয়েছেন সংখ্যালঘু প্রতিনিধি হিসেবে। ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি আগামীতে বিভাগীয় সদরগুলো সফর করবেন। জনসভা করবেন। ওবায়দুল কাদের নিজেও জেলা সফরে বেরোচ্ছেন। সংগঠনের নেতারা টিম গঠন করে সারা দেশ সফর করবেন। ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হবে। উড়াল সেতুর কাজ দৃশ্যমান হবে। অসংখ্য সেতু, ফাইওভার ছাড়াও বিদ্যুৎ খাতসহ অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে। তার সঙ্গে নেতাকর্মীদের আচরণ ও রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন এলে তার সুফল ব্যালট বিপ্লবেই ঘরে তুলবে আওয়ামী লীগ। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এখন দেখার পালা। শেষ ভালো যার, সব ভালো তার।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডট নিউজ


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন