লন্ডনে তারেক রহমানকে যেমনটি দেখেছি

  22-11-2016 01:18PM


পিএনএস ডেস্ক: বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও আপসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান। বাবা-মা আদর করে ডাকেন পিনো নামে। চঞ্চল প্রকৃতির পিনো ছোটবেলা থেকেই তার দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। বাগানের গাছে পানি দেয়ার পাইপ দিয়ে খেলতেন আর পানি ছিটিয়ে শত্রু ধ্বংস করতেন। সুপারম্যানের মতো গলায় চাদর বেঁধে যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করতেন। আজ আর খেলাচ্ছলে নয়, বাস্তবেই দুঃখিনী বাংলাদেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে তারেক রহমানের মতো সুপারম্যানের কোনো বিকল্প নেই। তাকে আজ বড় প্রয়োজন। এটা আজ সময়ের দাবি।

উচ্চশিক্ষার্থে লন্ডনে আসার পর ২০১২ সালের পয়লা বৈশাখে হঠাৎই দেখা হয় তারেক রহমানের সাথে। লাঠিতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। তখনো পুরোপুরি সুস্থ হননি। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই স্মিত হেসে সালামের উত্তর দিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। আমার চোখ চলে যাচ্ছিল সোফায় বসা পাশের কিশোরীর দিকে। তারেক রহমান বললেন, ও আমার মেয়ে জাইমা। এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। এই কি সেই! দাদী বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরে থাকা ছোট্ট জাইমা। বিস্ময় লুকাতে পারলাম না। কিন্তু সময় বহমান। এরই মাঝে কেটে গেছে অনেক বছর।

যুক্তরাজ্যে চিকিৎসাধীন তারেক রহমানের সার্বণিক সঙ্গী হয়ে আছেন তার সহধর্মিণী প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং অত্যন্ত সদালাপী ডা: জুবাইদা রহমান। নিয়ম করে ফিজিওথেরাপি দেয়া, খাওয়া-দাওয়া, ব্যায়াম, সঠিক চিকিৎসা সম্পর্কে রয়েছে তীক্ষ্ণদৃষ্টি। প্রেমময়ী স্ত্রীর সেবা তার দ্রুত সুস্থতায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

লন্ডনে কষ্টকর এই প্রবাসজীবনে তারেক রহমান শারীরিক চিকিৎসা নেয়ার পাশাপাশি গণতন্ত্রের সূতিকাগার যুক্তরাজ্যের গণতন্ত্র, নির্বাচনপ্রক্রিয়া, রাজনৈতিক দলীয় কাঠামো, গঠনতন্ত্র ইত্যাদি খুব কাছ থেকে পর্যবেণ করার পাশপাশি উন্নত বিশ্বের শিানীতি, যোগাযোগব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা, আইনের কাঠামো সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়েছেন আর এই বিষয়গুলো নিয়ে অনেক পড়াশোনাও করছেন। এমনকি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছেন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতার কথা। সব শুনে বলেন, এ রকম আমাদের দেশেও রয়েছে যেমনÑ হেলথ ভিজিটর বা স্বাস্থ্যকর্মী। তারা এখানকার (মিডওয়াইফদের) মতোই কাজ করে কিন্তু তাদের সেবার পরিধি অনেক কম আর সুযোগ-সুবিধা ও অপ্রতুল। উন্নত প্রশিণ আর আধুনিক প্রযুক্তি সহায়তা দিতে পারলে আমাদের এই হেলথ ভিজিটর বা স্বাস্থ্যকর্মী রাই পৃথিবীর বুকে মডেল হিসেবে বিবেচিত হবে।

বিদেশে থাকলেও মনটা পরে থাকে মাতৃভূমি বাংলাদেশে। সব ভাবনাচিন্তা জুড়ে থাকে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ। তার পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর। বর্তমান অন্তসারশূন্য ঘুণে ধরা শিাব্যবস্থা তাকে আহত করে। তিনি বলেন, ছোট শিশুরা নিজেদের ওজনের চেয়ে বেশি ওজনের বইয়ের ভারে ভারাক্রান্ত। দেশের ভবিষ্যৎ এইসব কোমলমতি শিশুদের মেরুদণ্ড সোজা রাখতে হবে। পুঁথিগত শিার পরিবর্তে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও কারিগরি শিার ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। আর জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি শিশুদের দিতে হবে দায়িত্বশীলতা, সততা ও নৈতিকতার শিা। শিশুদের শুদ্ধ বাংলাভাষা চর্চার পাশাপাশি ইংরেজি শিার ওপরেও গুরুত্ব দেন তিনি। শিশুরা যেন স্কুলে যেতে ভয় না পায় তাদের কাছে স্কুলের পরিবেশ এবং পাঠদান যেন আকর্ষণীয় হয়। তাদেরকে একটা আনন্দময় শৈশব দিতে হবে। তারেক রহমান শিশুদের খুবই স্নেহ করেন। ছোট শিশুদের পেলে তিনি নিজেও তাদের সাথে ছেলেমানুষিতে মেতে ওঠেন। তাদের দুষ্টামি হাসিমুখে সহ্য করেন। বলেন, কোকো ছোটবেলায় শুধু বিছানা থেকে পড়ে যেত আর মাথায় ব্যথা পেত। মাথায় লেগে লেগে মাথাটাও হয়ে গিয়েছিল নারকেলের মতো শক্ত। একবার আমার ছেলেকে আমি নিজে চুল কেটে দিয়েছিলাম। উনি দেখে বললেন, ছোটবেলায় আম্মাও এভাবে নিজে কোকোর চুল কেটে দিতেন সবসময়। খুব মিস করেন আদরের ছোট ভাইকে।

আরাফাত রহমান কোকো আর তারেক রহমান দুইজনেই ছিলেন ভাই-অন্তঃপ্রাণ। ছোট ভাই মারা যাওয়ার পর খুব ভেঙে পড়েন তিনি। কিন্তু শিগগিরই নিজেকে সামলে নিয়ে পারিবারিক কর্তব্য পালনে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন। বুকের ভেতর একমাত্র ছোট ভাইয়ের জন্য হাহাকার চেপে রেখে গায়েবানা নামাজে জানাজায় যাওয়ার সময়েও তিনি তার অসুস্থ বৃদ্ধা প্রতিবেশীর খোঁজ নিতে ভোলেননি। তার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়েছেন। সুস্বাস্থ্য কামনা করেছেন।

আমার দেখা প্রায় চার বছরের মধ্যে তারেক রহমানকে সবচেয়ে খোশমেজাজে দেখেছি মা বেগম খালেদা জিয়া লন্ডনে আসার পর। প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বারবারই আসছিলেন মায়ের কাছে। পাশে বসে কথা বলছিলেন আর মোবাইলে প্রিয় মুহূর্তগুলোকে ক্যামেরাবন্দী করে রাখছিলেন। দীর্ঘ দিন পর পুরো পরিবারকে তিনি একসাথে কাছে পেয়েছেন। পুরো বাড়িতে তখন উৎসবের আমেজ। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই মা তাদের দুই ভাইকে স্নেহ-মমতা দিয়ে আগলে রেখেছেন। তাই মায়ের সাথে আত্মার বন্ধনটাও অনেক দৃঢ়।

দেশে থাকতে মা বেগম খালেদা জিয়া তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো কাজে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সফর করতে হয়েছে কিন্তু সারা দিন শেষে মা ছেলের কথা বলা চাই-ই চাই। একসঙ্গে রাতের খাবার শেষে মায়ের বিছানার পাশে বসে তারেক রহমান পত্রিকাগুলো মাকে পড়ে শুনাতেন। মা-ছেলে রাজ্যের গল্প করতেন। দেশ নিয়ে, দেশের মানুষকে নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা মাকে বলতেন।

একবার বগুড়া থেকে ঢাকায় আসছিলেন তারেক রহমান। শীতকাল, প্রচণ্ড কুয়াশার কারণে রাস্তায় গাড়ি চালাতে অসুবিধা হচ্ছে। ঘন কুয়াশায় সামনের গাড়ির হেড লাইট পর্যন্ত ঢাকা পড়ছে। রাস্তার পাশে একজায়গায় একটি দোকান দেখে গাড়ি থামালেন। ধোঁয়া ওঠা গরম চা খেতে খেতে শুনতে পাচ্ছিলেন অন্ধকার থেকে বেশ অনেকণ ধরে থেমে কাশির শব্দ ভেসে আসছে। শব্দের উৎস খোঁজ করে জানতে পারলেন একজন অ্যাজমা রোগী ঠাণ্ডা বেড়ে যাওয়ায় কষ্ট পাচ্ছে। তৎণাৎ তিনি সেই ব্যক্তির চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন আর প্রতিষ্ঠা করলেন অ্যাজমা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। শুধু তা-ই নয়, তিনি জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন, বিনা মূল্যে চুশিবির করেছেন আর নাম না প্রকাশ করে চিকিৎসাসহায়তা দিয়েছেন শত শত মানুষকে। উত্তরাঞ্চলের পানির অভাব মেটাতে করেছেন ‘কমল পানি প্রকল্প’। কৃষকদের সহায়তায় করেছেন ‘কমল বীজ প্রকল্প’।

তার চিন্তা শুধু বর্তমানকে ঘিরে নয়, তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো এক একটা শিরা-উপশিরা ধমনী। কিন্তু পরাক্রমশালী প্রতিবেশীর একতরফা পানি প্রত্যাহারে এক দিকে বাংলাদেশের প্রাণবহমান নদীগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে, আরেক দিকে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ঢুকে বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলের পরিবেশ বদলে দিচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে ফসলি জমি, বিপন্ন হচ্ছে বন ও বন্যপ্রাণীর জীবন চক্র। এই ভয়াবহ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সঠিক মডেল ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য তারেক রহমান যুক্তরাজ্যের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী গবেষকদের আহ্বান জানান।

আজ সুন্দরবন ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে। শিল্পের নামে বন উজাড় করা হচ্ছে। তারেক রহমান ঠিকই অনুধাবন করেছিলেন বনাঞ্চলের প্রয়োজনীয়তার কথা। তাই জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দেশব্যাপী দলীয় নেতাকর্মী সমর্থকদের নিয়ে সারা দেশে লাখ লাখ নিমগাছের চারা রোপণ করেন। বৃরোপণবিষয়ক কর্মশালা করে নেতাকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেন।

তারেক রহমানের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা যেমন সুচিন্তিত, তেমনি সুবিন্যস্ত। সব কাজ গুছিয়ে করতে পছন্দ করেন তিনি। নিয়মানুবর্তিতা আর সময়ানুবর্তিতা করাকে খুবই গুরুত্ব দেন। সব সময় নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করেন তারেক রহমান।

আর যত কাজই থাকুক না কেন নিয়মিত নামাজ আদায় করেন তিনি। আর কিছু দিন তার সাথে কেউ থাকলে সেও নিয়মিত নামাজে অভ্যস্ত হয়ে যায়।

বর্তমান বাংলাদেশের ভূলুণ্ঠিত গণতন্ত্র আর মানবাধিকার পরিস্থিতি তাকে বিচলিত করে। ভাবনার অনেকটা জুড়ে থাকে দেশে আন্দোলনরত নির্যাতিত নেতাকর্মীরা। নিয়মিত তিনি ত্যাগী নেতাদের খোঁজখবর রাখেন। যারা সরকারি বাহিনী দ্বারা হত্যা, গুম, খুন, মিথ্যা মামলা হামলার শিকার হচ্ছেন। তার মতে তৃণমূল কর্মীরাই বিএনপির প্রাণ। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী কোটি মানুষের ভালোবাসাই তার রাজনীতির প্রেরণা।

অহঙ্কার করার মতো তারেক রহমানের অনেক কিছুই রয়েছে। যার পিতা ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, রাষ্ট্রপতি, সেনাবাহিনী প্রধান আর মা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী অহঙ্কার করা তাকেই মানায়। কিন্তু তারেক রহমানকে দেখেছি নিরহঙ্কার অতি সাধারণ। সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত তারেক রহমানের নেই কোনো বিলাসী জীবন, খাওয়া-দাওয়ায় নেই কোনো বাহুল্য, পোশাক-পরিচ্ছদে নেই কোনো চাকচিক্য।

ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় সবসময় তারেক রহমানকে দেখেছি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একজন ক্রিটিকের দৃষ্টিতে। কিন্তু দূরবীণের অপর প্রান্তের মানুষটিকে কাছ থেকে দেখার পর আমার সব ভ্রান্তি দূর হয়ে যায়। অনুধাবন করতে পারি কী মিথ্যাচারই না হয়েছে তাকে নিয়ে। অপপ্রচার আর মিথ্যা মামলা দিয়ে সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে।

১/১১-এর কুশীলবেরা তারেক রহমানের নেতৃত্বকে ভয় পেয়ে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিপে করে। একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে জর্জরিত করে। রিমান্ডের নামে অমানুষিক নির্যাতন করে আজীবনের জন্য পঙ্গু করে দেয়ার চেষ্টা করে।
তারেক রহমানকে নিয়ে বিরোধীদের মিথ্যা প্রচারণা দেখে আজ বেঁচে থাকলে গোয়েবলসও লজ্জা পেয়ে বলত- ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি, এরা তো আমাকেও হার মানিয়েছে।’
লন্ডনপ্রবাসী লেখক, সাংবাদিক
মাহবুবা জেবিন

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন