‘জীব হত্যা মহাপাপ’এই শিক্ষা এখন বড় বিবর্ণ

  24-11-2016 10:21AM


পিএনএস ডেস্ক: অহিংসা পরম ধর্ম, জীব হত্যা মহাপাপ-মহামতি গৌতম বুদ্ধের এই শিক্ষা বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারে এখন বড় বিবর্ণ। নীপিড়ন সহ্য করাই দেশটির রোহিঙ্গাদের নিয়তি। সেই ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারে আবারো সহিংসতা-বর্বরতার শিকার এই মুসলিমরা। প্রতিবার একেকটা গুজব বা রটনা তুলেই তাদের কচুকাটা করা হয়। এবারো বর্বরতা চালানো হয়েছে ধর্ষণের গুজব রটিয়ে। খবরটি ছড়িয়ে দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। এক বৌদ্ধ নারীকে ধর্ষণের গুজব ছড়িয়ে মুসলিমদের দোকানপাট, বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা। বাদ যায়নি মসজিদও। এ সময় সংঘর্ষে অন্তত বেশকজন নিহত ও অনেকে আহত হয়।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সহিংসতায় তরুণদের অংশগ্রহণই দেখা গেছে বেশি। মান্দালায় এলাকায় সংখ্যালঘু মুসিলম সম্প্রদায়ের অন্তত দুই লাখ মানুষের বসবাস। আমাদের দেশের পুলিশের মতোই মান্দালায়ের পুলিশপ্রধান জ উইন অং বলেছেন, দাঙ্গার ঘটনায় তদন্ত চলছে। ব্যবস্থা নেওয়া হবে জড়িতদের বিরুদ্ধে। ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধ করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট সাবেক সেনা কর্মকর্তা থেইন সেইন। যাকে মিয়ানমারে নাটকীয় সংস্কার শুরুর কৃতিত্ব দেওয়া হয়। সাবেক জান্তা সরকার ২০১১ সালে একটি নামমাত্র বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। কিন্তু জাতিগত সহিংসতার কারণে সেই সরকার এবং গণতন্ত্রে উত্তরণের উদ্যোগ বেশ ঝুঁকিতে পড়েছে। মিয়ানমারে ধর্মীয় উসকানি ছড়ানোর জন্য কট্টর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দায়ী করা হয়। ইসলামের কারণে বৌদ্ধধর্ম হুমকির মুখে পড়েছে বলে তাঁরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

মিয়ানমারে মুসলিমদের ওপর গত তিন বছরে অধিকাংশ সহিংসতার কেন্দ্র ছিল পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্য। সেখানে ২০১২ সালে এক বৌদ্ধ নারীকে ধর্ষণের গুজব ছড়ানোর পর মূলত বৌদ্ধ-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। এতে নিহত হয় অন্তত ২৫০ জনেরও অধিক এবং কয়েক লাখ মানুষ গৃহহীন হয়। সহিংসতামুক্ত ছিল না দেশটির মধ্যাঞ্চলও। ২০১৩ সালে মুসলমানদের ওপর হামলা হয়েছে মিকিতা ও কানবুলা শহরে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগের বসবাস রোহিং এলাকায়। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দের অর্থ নৌকার মানুষ। সমুদ্রে নৌকায় মৎস্য সম্পদ আহরণ করে জীবিকা চালানোর কারণেই এমন নামকরণ। আবার কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, আরবি শব্দ ‘রহম’ (দয়া করা) থেকে রোহিঙ্গা শব্দের উদ্ভব। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আরবের বাণিজ্য জাহাজ রার্মবি দ্বীপের তীরে এক সংঘর্ষে ভেঙে পড়ে। তখন তারা ‘রহম! রহম’ বলে আল্লাহর কাছে দয়া ভিক্ষা করে। আলল্লাহতায়ালা রহমতে তাঁরা বেঁচে যায়। সে থেকেই তারা রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর নাম ‘রোহিঙ্গা।মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা নিজ দেশে আজ পরবাসী। অতীতের সামরিক জান্তা তাদের নাগরিক অধিকারই শুধু কেড়ে নেয়নি, সমাজের মূল¯্রােত থেকে বিচ্ছিন্ন করে শিবিরের বন্দিজীবন বেছে নিতে বাধ্য করেছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই বলে রোহিঙ্গাদের দারিদ্রতা চরমে। শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে। সর্বশেষ সহিংসতায় অনেক রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে, তাদের আরো অসংখ্য সদস্য প্রাণভয়ে সাগরে ভাসছে। নিজভূমিতে পরবাসী হওয়া কতটা কষ্টের সেটা আমরা জানি। বিনা কারণে শাস্তি পাওয়ার যন্ত্রনা কেমন হয়-সেটা আমরা বুঝি। পাকিস্থানি হায়েনারা যখন আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল, আমাদের মা-বোনকে ধর্ষণ করেছিল, আমাদের সঞ্চিত সম্পদ লুটপাট করে নিয়েছিল তখন আমরা বুঝেছি উদ্বাস্তু হওয়া কতটা বেদনার। লাঞ্চনার তীব্র দহনে আমাদেরকে যখন পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল তখন আমরা অনুভব করেছি জীবন কতটা মূল্যবান। প্রাণের আকুতি কতটা বিষাদময় হয়ে থাকে। এই জীবনকে বাঁচানোর জন্য, স্বাধিকার আদায়ের জন্য আমাদের মন কতটা ব্যাকুল হয়েছিল! চারপাশে ধ্বংসস্তুপ আর লাশ পোড়া গন্ধ দেখে আমরা কতটা ছটফট করেছিলাম-সেটা ইতিহাস স্বাক্ষী হয়ে আছে।

রোহিঙ্গা সূত্রগুলো বলছে, সেনাবাহিনী সেখানে অধিবাসীদের হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণও করছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। বার্মা সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়ে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশ এবং প্রায় ৫ লাখ সৌদি আরবে চলে যাওয়ার একটি পরিসংখ্যান উইকিপিডিয়া তুলে ধরেছে। তাদের ওপর নির্যাতনটা মূলত ধর্মীয় কারণেই। নামাজে বাধা দেওয়াসহ নির্বিচারে হত্যা ও নারীদের ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে। তাদের সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। তাদের সংখ্যা যাতে বাড়তে না পারে সে জন্য বিয়ে করার অনুমতিও নেই তাদের। বৌদ্ধ রাখাইনদের টার্গেট হলো নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতনের মাধ্যমে নির্মূল করা।

এমন অশান্তিময় মিয়ানমারে শান্তিতে নোবেলজয়ী একজন অং সান সুচি আছেন। রাজনীতি-কূটনীতিতে যার পরিচিতি গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী নামে। সুচি বলেছেন, মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সহিংসতায় বোঝা যাচ্ছে, এখানে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং গণতন্ত্রায়ন করাটা কঠিন কাজ। সুচি একটি ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ ইউনিভার্সিটির একটি দলের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে এসব কথা বলেছেন। শান্তিতে এই নোবেলজয়ীর দল ক্ষমতায় আসায় বিশ্ববাসীর আশা ছিল, বঞ্চিত রোহিঙ্গারা অধিকার ফিরে পাবে, বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। কিছুদিন আগে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে প্রধান করে রোহিঙ্গা কমিশন গঠন এই প্রত্যাশা আরো জোরালো করেছিল। কিন্তু একের পর এক সন্ত্রাস দমনের নামে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর সেনাবাহিনীর নির্বিচার হামলার সব আশা দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। সহিংসতার শিকার হয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা আমাদের দেশের জন্য নানা সমস্যার কারণ হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়াচ্ছে, মিথ্যা পরিচয়ে নাগরিকত্ব নেওয়ারও চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক সহিংসতার পরও অনেক রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে শরণার্থীদের চাপ আরো বেড়ে যাবে। ইতিমধ্যেই জাতিসংঘ বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে নমনীয় হতে বলেছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই করে এসেছে। মিয়ানমার নির্বিকার। সু চির সরকার বিদ্রোহী কিছু গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিষ্ক্রিয়।

অং সান সুচির নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার দাবিতে অনলাইনে চলছে স্বাক্ষর আবেদন। চেঞ্জ ডট অর্গে এই আবেদনে এরইমধ্যে সই করেছে লক্ষাধিক মানুষ। ধারণা করা হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া থেকে এই আবেদনটি জানানো হয়েছে। মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার ব্যাপারে কোন অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার আহবান জানানো হয় এই আবেদনে। এতে বলা হয়েছে, "আন্তর্জাতিক শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ববোধ রক্ষায় যারা কাজ করেন, তাদেরকেই নোবেল শান্তি পুরস্কারের মতো সর্বোচ্চ পুরস্কার দেয়া হয়। সুচির মতো যারা এই পুরস্কার পান, তারা শেষ দিন পর্যন্ত এই মূল্যবোধ রক্ষা করবেন, এটাই আশা করা হয়। যখন একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী শান্তি রক্ষায় ব্যর্থ হন, তখন শান্তির স্বার্থেই নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির উচিত এই পুরস্কার হয় জব্দ করা নয়তো ফিরিয়ে নেয়া।

সু চির দীর্ঘ সংগ্রাম, গৃহবন্দি জীবন, তার আন্তর্জাতিক সম্মান আমাদের সব সময় আকর্ষণ করেছে। তিনি পড়েছেন ভারতের দিল্লি¬তে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। বিয়ে কিউবায় জন্মগ্রহণকারী আধা-ইংরেজ, ইতিহাসের অধ্যাপক মাইকেল অ্যারিসের সঙ্গে ১৯৭২ সালে। বাবা নিহত হওয়ার পর থেকে প্রথমে মায়ের সঙ্গে ভারতে ও পরে স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে প্রবাস জীবন থেকে ১৯৮৮ সালে সু চি অসুস্থ মায়ের দেখাশোনার জন্য ইয়াংগুনে ফেরেন। তখন জড়িয়ে পড়েন মিয়ানমারের সামরিক শাসনবিরোধী জনগণের সংগ্রামে। তার পর আর যাননি। রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) সাধারণ সম্পাদক হন। স্বামী কয়েকবার মিয়ানমারে এসেছেন। দুই সন্তান বাবার কাছে। ১৯৯৫ সালে ইয়াংগুনে স্বামী-স্ত্রীর শেষ দেখা। অ্যারিসের ক্যান্সার ধরা পড়লে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বহু আন্তর্জাতিক বড় বড় নেতার অনুরোধ সত্ত্বেও তাকে মিয়ানমারে যাওয়ার ভিসা দেয়নি। সু চিকে বলেছিল, আর ফিরে না আসার শর্তে দেশ ত্যাগ করতে পারেন। সু চি তার জনগণকে ত্যাগ করে যেতে রাজি হননি। অ্যারিসের মৃত্যু হয় ১৯৯৯ সালে অক্সফোর্ডে, সু চি যখন ইয়াংগুনে গৃহবন্দি। ৫০ বছর ধরে বার্মা বা পরে মিয়ানমার ছিল বিশ্ব বলতে একমাত্র চীনের প্রভাবাধীন নিষ্ঠুর সব সামরিক জান্তার শাসনাধীনে এক আবদ্ধ রাষ্ট্র। ছাত্রসমাজ ও বৌদ্ধভিক্ষুদের কত সংগ্রাম, কত রক্ত, কত আত্মদান। ১৯৮৯ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ২১ বছরের মধ্যে ১৫ বছর সু চি ছিলেন নিঃসঙ্গ গৃহবন্দি। মাঝেমধ্যে ছেড়ে অনেক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রেখেও জান্তা আবার ধরে গৃহবন্দি করত। আন্দোলনের কারণে নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেও জান্তা ক্ষমতা ছাড়েনি। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে সু চির দল পার্লামেন্টের ৮১ শতাংশ আসন পেয়েও ক্ষমতা পায়নি। ২০১০-এর নির্বাচনে সু চিকে লড়তে দেওয়া হয়নি এবং এনএলডি বর্জন করে। কিন্তু ২০১২ সালে ৪৫টি আসনের উপনির্বাচনে ৪৩টিই এই দল পায় এবং সু চি নিজে পার্লামেন্ট সদস্য হন। প্রবল আন্তর্জাতিক চাপে ও পরিবর্তনের বাস্তবতায় মিয়ানমার ২০১০ থেকেই ধীরে ধীরে বিশ্ববাজারে নিজেকে উন্মুক্ত করতে থাকে, অর্থাৎ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য দরজা খুলতে থাকে।

সমকালীন ইতিহাসে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধী, পাকিস্থানের বেনজির ভুট্টো, বাংলাদেশের শেখ হাসিনা ও মিয়ানমারের অং সান সু চি প্রমুখ নারী নেতা আমাদের গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। তারা একাধারে দুঃখিনী রাজকন্যা ও সম্রাজ্ঞী। জনগণবন্দিতা। দু'জন আততায়ীর হাতে নিহত, দু'জনের পিতা ও একজনের স্বামী নিহত। সু চি নোবেল শান্তি পুরস্কার (১৯৯১), সাখারভ পুরস্কার, জওয়াহেরলাল নেহারু পুরস্কার, সাইমন বলিভার পুরস্কার, ওলফ পাম পুরস্কার, কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডালসহ কত আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছেন। এমন ধার ও ভারের গণনন্দিত নেত্রীকে নিয়ে আজ বিশ্বব্যাপী সমালোচনা। ভাবতে আফসোসই লাগে।

লেখক: রিন্টু আনোয়ার, সাংবাদিক-কলামিস্ট
ই-মেইল: [email protected]

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন