আমরা রাষ্ট্রদূত নই, আমাদের ব্যাগ কে খুঁজে দেবে?

  24-11-2016 11:32AM


পিএনএস ডেস্ক: তখন সন্ধ্যা। আমার এক সহকর্মী কাজ শেষে রিকশায় চেপে বাসায় যাচ্ছিলেন। হাতে অফিসের ল্যাপটপ। ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বার রোডে হঠাৎ একটি মোটরসাইকেল দ্রুতবেগে তার পাশ দিয়ে চলে যায়। কিন্তু যাওয়ার সময় মুহূর্তেই মোটরসাইকেলের পেছনে থাকা যুবক হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নেয় ল্যাপটপটি। আমার সহকর্মী কিছু বুঝে ওঠার সময়ও পাননি। দূর থেকে দুই-একজন ঘটনাটি দেখেছিলেন। তারা এগিয়ে এসে কেবল সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। তাদের কিছু করারও ছিল না।

আমার সহকর্মী দ্রুত অফিসে ফিরে আসেন। বিষয়টি জানার পর প্রশাসন থেকে জানানো হয়, থানায় গিয়ে জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করতে হবে। তিনি ধানমণ্ডি থানায় যান। ডিউটি অফিসার জানান, ‘ছিনতাই’, ‘চুরি’—এসব উল্লেখ করলে জিডি হবে না। মামলা করতে হবে। না হলে ‘হারিয়ে গেছে’উল্লেখ করতে হবে। তাকে এমনভাবে নিরুৎসাহিত করা হলো যে, তিনি জিডি করে ফিরে এলেন। সাংবাদিক হওয়ায় আমার সহকর্মী ৩২ নাম্বার সড়কের আশেপাশের বাড়িতে সিসি ক্যামেরা আছে কিনা খোঁজ করেন। যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে ঠিক তার পাশের বাড়িতেই সিসি ক্যামেরা ছিল। সেখান থেকে পুরো ঘটনার ভিডিও ফুটেজ খুঁজে পান। ফুটেজে ছিনতাইকারীর চেহারাও কিছুটা বোঝা যাচ্ছিল। সহকর্মী সিদ্ধান্ত নেন মামলা করবেন। পরদিন সেই ফুটেজ নিয়ে থানায় যান। থানার একজন অফিসার ভিডিও দেখে বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মামলা নেওয়া হবে। তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু আগের রাতের লোকজন কি সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করবে? করার কথাও নয়। এ তো একজন বোকা মানুষও বুঝবেন। তবু পুলিশ অফিসার আশ্বাস দিলেন ছিনতাইকারীকে খুঁজে বের করবেন। মামলা করার দরকার নেই। ছিনতাইকারীকে ধরার পর তারা নিজেরাই আদালতের মাধ্যমে জিডিকে মামলায় রূপান্তরিত করবেন। প্রায় দু’বছর হয়ে গেলো! আমার সহকর্মী আশা নিয়ে পুলিশের পেছন পেছন প্রথম দু’মাস ঘুরেছিলেন। আর এখন তার সেই ঘটনা মনেও পড়ে না!

আমাদের অফিসে অনেকের জীবনেই এ রকম ঘটনার অনেক উদাহরণ আছে। আছে আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও। আমি তো একবার জোর করে মামলা করেছিলাম। দু’তিনবার নিম্ন আদালতে হাজিরাও দিয়েছি। ভোগান্তির কথা চিন্তা করে সেদিকে আর পা বাড়াইনি। ভেবেছি, যে জিনিস গেছে, তা একেবারেই গেছে। পাওয়ার আশা করা একেবারেই বোকামি।

গত ২১ নভেম্বর, সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় একটি প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডস-এর রাষ্ট্রদূত। অনুষ্ঠান থেকে চুরি হয়ে যায় তার ভ্যানিটি ব্যাগ। ব্যাগে ফোনসহ আরও কিছু জিনিস ছিল। আমরা বাংলাদেশের মানুষ বিষয়টি শুনে ভীষণ লজ্জা পেলাম। উৎকণ্ঠিত হলাম। দেশের ইমেজ নিয়ে প্রশ্ন! প্রশাসনে হইচই পড়ে গেলো! চৌকস পুলিশরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা খোঁজ নিচ্ছেন। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল।

সৌভাগ্যক্রমে সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেলো। চেহারাও কিছুটা বোঝা গেলো। ২৩ নভেম্বর, বুধবারের মধ্যে অপরাধীদের ধরে ফেললো পুলিশ! আমরা সাধারণ মানুষ সত্যিকার অর্থে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু অন্যদিকে কিছু ভাবনা যোগ হলো। বোঝা গেলো—পুলিশ চাইলে পারে না, এমন কাজ বোধহয় নেই! তাদের ওপর আস্থা বহুগুণে বেড়ে গেলো। আবার এও জানি, এখন সেই একই স্থানে একজন সাধারণ মানুষ খুন হয়ে গেলেও পুলিশের আর ঘাম ঝরানোর চিন্তা নেই! কেন এ রকম ধারণা হলো?

কারণ আগেই অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলাম। এ দেশে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ার পর জিডি করতে গেলে থানা থেকে বলা হয়, ‘ছিনতাই’ শব্দটি লিখলে মামলা করতে হবে। মামলায় অনেক ঝামেলা, কোর্টে হাজিরা দিতে হবে। পারবেন এই ঝামেলা পোহাতে? তাই জিডি করুন। লিখুন, জিনিসটি হারিয়ে গেছে।

ছিনতাইকারীর কবলে পড়া মানুষটি উপায়ন্তর না দেখে সেটাই করতে বাধ্য হন। তিনিও চান না, কোনও ঝক্কি-ঝামেলায় জড়াতে। কোনও নাছোড়বান্দার মুখোমুখি হলে পুলিশ বলে, ‘চলেন ঘটনাস্থলে যাই। কী হয়েছে জেনে আসি।’ কিন্তু সাধারণ একজন মানুষ কী করে প্রমাণ করবেন, সেখানে এরকম ঘটনা ঘটেছিল? পুলিশ তখন বলে, ‘ছিনতাইয়ের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সুতরাং জিডি করলে করেন।’

বন্ধুদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কিছু ক্ষেত্রে যদি মামলা হয়—কিছু অসৎ পুলিশ জেনে-বুঝে ‘অজ্ঞাতরা’ উল্লেখ করে এই মামলায় অন্যদের হয়রানি করে। বনিবনা না হলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় অন্যকে। কখনও কখনও যিনি বাদি তার ওপর দায় পড়ে। তিনি হুমকির মুখে পড়েন। দিনের আলোর মতো সত্য এসব ছোটখাটো ঘটনা অসৎ পুলিশের ফায়দা লোটার আকর্ষণীয় সোর্স।

এই দেশে ছিনতাই করা জিনিস পুলিশ সহজে উদ্ধার করেছে—এ রকম উদাহরণ বিরল। প্রভাবশালী কেউ হলে অথবা প্রভাবশালী কারও মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাউকে ফোন করানো গেলে কখনও কখনও ব্যতিক্রম ঘটনার খোঁজ পাওয়া যায়।

রাষ্ট্রদূতের ভ্যানিটি ব্যাগ উদ্ধারের আগে আমাদের এক সাংবাদিক বলেছিলেন, ঘটনাটি হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউই করেছে। আমি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলাম, ওরা সামান্য ব্যাগ ছিনতাই করবে না! এত ছোট কাজ ওরা ওই এলাকার এবং নিজেদের প্রেস্টিজের কারণেই করবে না। আর যদি করেও, করলে বড় কিছুই করবে।

রাষ্ট্রদূতের ভ্যানিটি ব্যাগ উদ্ধার হয়েছে। কারণ প্রশাসনের কর্মকর্তারা দায়িত্ববোধের চাপ অনুভব করেছিলেন। কিন্তু এ রকম চাপ আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বেলায় কেন অনুভব করেন না তারা? রাষ্ট্র কেন তার নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে না? আমরা কি আসলেই একেবারেই গুরুত্বহীন?

আমরা তো রাষ্ট্রদূত নই, আমাদের ব্যাগ কে খুঁজে দেবে?

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, বাংলা ট্রিবিউন

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন