ক্লিন ঢাকা ও স্মার্ট নগরীর বহুমুখী সমস্যা

  27-01-2017 10:43AM


পিএনএস ডেস্ক: ২০১৭ সালে ঢাকা হবে স্মার্ট নগরী। .রাজধানী শহরকে নিয়ে নানা স্বপ্ন রয়েছে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে যেসব বাধা রয়েছে তা গণমাধ্যমে বার বার উঠে আসছে। ঢাকার এই সমস্যা বহুমুখী। ছোট্ট একটি আর্টিকেলে সব কথা তুলে ধরাও সম্ভব হয় না। প্রত্যেকটি সমস্যাই বিস্তারীত লেখার দাবি রাখে। নগরকেন্দ্রিকক সব সমস্যার সমাধান কখনোই সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। কিছু কিছু সমস্যা সাময়িক আর কিছু কিছু সমস্যা সুদীর্ঘ বছরের। কিছু সমস্যা চলমান প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। কিছু সমস্যা এমন আছে যা একটি সমস্যা দূর করতে গিয়ে নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে। কেউ চাইলেই একত্রে সব সমস্যা দূর করতে পারবেন না। তাই বলে আলোচিত মৌলিক সমস্যার সমস্যার সমাধান করতে শত বছর পেরিয়ে যাবে এমনটিও হতে পারে না। গত ১৮ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোর একটি শিরোনাম ছিল ‘এক টাকার কর দিতে তিন টাকার হয়রানি’। একই দিনে দৈনিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ এর একটি শিরোনাম হলো ‘দেখার কেউ নেউ, রাত নামলেই চাঁদাবজির বিভীষিকা’। এর আগে গত ৩ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘ফ্লাইওভার নির্মাণে ধীরগতিতে ভোগান্তি’র কথা তুলে ধরা হয়েছে। ‘ফ্লাইওভার অব্যবস্থাপনা’ শিরোনামে দৈনিক নয়া দিগন্ত জনভোগান্তির কথা তুলে ধরেছে। ‘ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদের পরেই দখল’ শিরোনাম করেছে দৈনিক ইনকিলাব। সংবাদমাধ্যমগুলো কম-বেশি প্রত্যেকেই এসব নাগরিক সমস্যার কথা তুলে ধরছেন। কিন্তু যে ভাবে লেখালেখি চলছে সেই তুলনায় প্রশাসনের তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। গণমাধ্যমে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় এগুলো কি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে না? নাকি তারা এসব সমস্যার সমাধান দেয়া প্রয়োজন মনে করছেন না। উপরে যে কয়েকটি সমস্যার কথা কথা বলা হয়েছে, এক টাকার কর দিতে তিন টাকার হয়রানি এবং রাত নামলেই চাঁদাবজি। এ ধরণের হয়রানি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা যায় না-এটি মানতে কষ্ট হচ্ছে। একাজগুলো প্রশাসনের ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। চাইলেই সম্ভব। তাহলে কেন হচ্ছেনা? অসাধু ব্যক্তিদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে তাই ইচ্ছা করেই এসব অনিয়ম দূর করা হয়ে না। সরকার যদি সামান্য সমাধানে ব্যর্থ হন তাহলে দীর্ঘ মেয়াদি যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলোর সমাধান হয়তো কোন দিনই পাওয়া যাবে না। উন্নয়নমূলক কাজ হয়তো থেমে থাকতে পারে তাই বলে কলম সৈনিকরা থেমে থাকতে পারে না।

গণমাধ্যমে নগরের সমস্যাবলী তুলে ধরা হলেও দু’একটি বাদে বাকিগুলোর কোনোই সমাধান হয় না। উন্নয়নের স্বার্থে ঢাকা সিটিকে দুই ভাগ করা হলো। প্রশাসক থেকে জনপ্রতিনিধি ক্ষমতা পেল। কিন্তু জনসমস্যার কথা বলতে গেলে আগের মতো থেকে গেল। গুলশান, বনানী, বারিধারা ও ধানমন্ডিসহ ভিআইপি, সিআইপি এলাকার কিছু সমস্যা দূর হলেও হাজারীবাগ, লালবাগ, কামরাঙ্গিরচরসহ কিছু এলাকা অবহেলিত। আর উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্ধ হলেও তা যৎসামান্য। আবার যে পরিমাণ টাকা বরাদ্ধ পাওয়া যায় তার অর্ধেক চলে যায় অফিসের ফাইল চালাতে, ঠিকাদার ও দলীয় নেতা-কর্মীর পকেটে। রাস্তার পাশে কয়েক হাজার ডাস্টবিন স্থাপন, বাড়ির ছাদে বাগান করার পরামর্শ, কয়েকটি পাবলিক টয়লেট পরিচ্ছন্ন করা, তেজগাঁয়ে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড দৃশ্যমান উচ্ছেদসহ নগরীতে র্যালি এবং সভা-সমাবেশের আয়োজন করে উন্নয়নের (?) ফিরিস্তি তুলে ধরা যথেষ্ট নয়।

পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ঢাকার নাগরিক সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। ঢাকার ৯৯ শতাংশ মার্কেট অগ্নিঝুঁকিতে। খেলার মাঠ নেই অনেক এলাকায়। মাদকাসক্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। সুয়ারেজ সমস্যা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে পুরান ঢাকার কয়েক লাখ মানুষ। গ্যাস সঙ্কটে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা। অনেক এলাকায় রান্নায় গ্যাসের সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। চরম দুর্ভোগে নগরবাসী। যানজটে ক্ষতি হওয়া অর্থ দিয়ে বছরে একাধিক পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব বলেও গবেষণা জরিপ করেছেন কেউ কেউ। ব্য্যাক সেন্টার আয়োজিত ‘নগর পরিস্থিাতি ২০১৬ : ঢাকা মহানগরে যানজট, শাসন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, যানজট ও গাড়ীর ধীর গতির কারণে বছরে ক্ষতি ১১.৪ বিলিয়ন ডলার বা লক্ষ কোটি টাকা। যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন ৮.১ মিলিয়ন কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া ঢাকার রাস্তার সবচেয়ে বড় আতঙ্ক-‘হর্ন’। গণপরিবহনসহ সকল স্তরের চালক নিজ ইচ্ছানুযায়ী সর্ব শক্তি নিয়োগ গাড়ির হর্ণ বাজান। কোথায় হাসপাতাল আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে দেখার প্রয়োজনও অনুভব করছেন না কেউ। ২০০৬ সালের শব্দ দূষণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকায় সকাল ৬ টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ শব্দসীমা ৫৫ ডেসিবেল এবং রাত ৯ টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবেল। একই ভাবে নীরব এলাকার জন্য এই শব্দসীমা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ৫০ ও ৪০ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকায় ৬০ ও ৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ও ৬০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকায় ৭৫ ডেসিবেল সর্বোচ্চ শব্দসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞের ধারণা, ঢাকা শহরে যেভাবে শব্দ দূষণ বেড়ে চলছে তাতে এ শহরের অর্ধেক মানুষের শ্রবন ক্ষমতা ২০১৭ সালের মধ্যে ৩০ ডেসিবেল পর্যন্ত কমে যাবে। অথচ কেউ এই নিয়ম মানছেনা। ড্রাইভিং লাইসেন্সে যেসব নিয়মের কথা বলা হয়েছে সেগুলোও তারা মানছেনা কোনো কোনো ঘটনা দায়িত্বেরত পুলিশের নজরে আসলেও নগদ অর্থের বিনিময়ে সব অনিয়ম নিয়মে পরিণত হচ্ছে।

রাজধানীতে আরেক সমস্যা ধুলাবালি। ঢাকা ঢেকে যায় ধুলার চাদরে। তাছাড়া বায়ু দূষণ ও শব্দ দূষণ সব সময়ের সাথী। ধূলার কারণে রাস্তার পাশের দোকানীরা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষকরে যে এলাকায় ফ্লাইওভার, সরকারি ভবন নির্মাণ, প্লাট বাড়ি ও রাস্তা উন্নয়নের কাজ চলছে তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। জানা গেছে, রাজধানীর ২৫% মানুষের ফুসফুস সমস্যা হচ্ছে। দূষিত নগরী ঢাকা, রাজধানীর বিষাক্ত বাতাসে আক্রান্ত হচ্ছে গর্ভের শিশুও। রাস্তার পার্শ্বে ময়লা ফেলার জন্য ছোট ছোট ডাস্টবিন বসানো হলেও সেগুলো সঠিকভাবে দেখভাল করা হয় না। দিনের পর দিন ময়লায় ভর্তি থাকলেও কর্তৃপক্ষের নজরে আসেনা। ডাস্টবিন সংরক্ষণে মনিটরিং না থাকায় সেগুলো চুরি হয়ে যাচ্ছে। দুর্গন্ধে চলা দায়। কোথাও কোথাও আবাসিক এলাকা ময়লার বিশাল ভাগার হওয়ায় জনস্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হচ্ছে। যত্রতত্র ময়লার স্তুপ থাকায় চলাচল করতে সমস্যা হচ্ছে। মাঝে ময়লার গন্ধ খুব বেশী ছড়িয়ে পড়লে জনজীবন স্থবীর হয়ে পড়ে। ময়লার দুর্গন্ধে বায়ু দূষণের কারণে বাতাসের সাথে প্রবেশ করছে বিভিন্ন রোগের জীবানু। র্দুগন্ধযুক্ত আরেকটি এলাকা হলো হাজারীবাগের ট্যানারী শিল্প এলাকা। ট্যানারী স্থানান্তরীত হবে এ কথা সত্য। তবে কবে নাগাদ স্থানান্তরিত হবে সেই প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। ট্যানারী বর্জ্য থেকে মুক্ত হতে হতে হয়তো আমাদের সন্তানরা দাদা হতে শুরু করবেন।

সর্বোপরি, নির্বাচনের আগে জনপ্রতিনিধরা ভোটারদের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা মনে রেখে তাদের কাজ করতে হবে। নগরবাসীর সমস্যা নিরসনে নজরদারী বাড়ানো না হলে জনদুর্ভোগ আরো চরমে পৌছে যাবে। ২০১৬ সালকে পরিচ্ছন্ন বছর ঘোষণা করলেও আশানুরূপ কোন অগ্রগতি হয়নি। এমতাবস্থায় ২০১৭ সালে ঢাকা হবে স্মার্ট নগরী এমন স্বপ্ন দেখা অবান্তর। গত বছর ক্লিন ঢাকা ২০১৬ যেমন বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি তেমনিভাবে স্মার্ট ঢাকা ২০১৭ কতটা বাস্তবে পরিণত হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন