তদন্ত কমিটি গঠন মানেই অপরাধীকে রক্ষা করার হাতিয়ার

  04-02-2017 12:25PM


পিএনএস, এবিসিদ্দিক: অনেকেরই মনে থাকার কথা। এরশাদ সরকারের শাসনামলে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার শিমুলিয়ায় কথিত পীর বাহিনীর সাথে পুলিশের ‘যুদ্ধ’ হয়েছিল। আর পীরের নাম ছিল মেজর মতিউর রহমান। শিমুলিয়া গ্রাম আমার গ্রামের থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দুরে। আর মেজর মতির আমার বাড়ি হলো আমার আপন চাচির বাপের বাড়ি। আমি তখন ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকের কিশোরগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা। এই ঘটনার শুরু থেকে শেষ আমি একজন নিরব দর্শক আর সাক্ষীও বটে। মেজর মতিরা তিন ভাই, মতি, হামিদ ও হাবিব। মতি ছিলেন পাকিস্তান সরকারের একজন আর্মি অফিসার(ক্যাপটেন) তিনি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর তিনি ধর্মী কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং পীর হয়ে যান। অনেক মুরিদও করেন। এলাকায় অনেক বেশ কিছু জমি কিনে সেখানে ছোট ছোট ঘর করে তার মুরিদদের(যারা খুব গরীর) তাদের পুনবার্সন করেন। ঘরে সেলাই মেশিন সহ যে যেকাজ করতে পারেন সেই কাজের সুবিধা করে দেন। আর বার্ষিক ওরশ করতেন। ঘটনাটির সূত্রপাত যে ভাবে হয়। তিনি বার্ষিক ওরশ করতে দিন তারিখ ঠিক করেন আর সেটা এলাকায় মাইকে প্রচার শুরু করেন। ওরশ শুরু হলো। পাকুন্দিয়া থানা থেকে পাঠানো হলো গোয়েন্দার পুলিশের এক সদস্যকে না যার মহব্বত। মহব্বত এসে আসরের নামাজের সময় যখন জামায়াতে নামাজ হচ্ছেছিল তখন গিয়ে ঝামেলা শুরু করে এবং মোটা অংকের ছালামিও দাবি করে। তখন মুসল্লিরা তাকে ধরে বেধে রাখে। শুরু হলো ঘটনা। অবশ্য ঘটনার সময়ে পীর মতি ছিলেন ঢাকায়। সারা রাত মহব্বতকে আটক রাখার পর সকালে পাকুন্দিয়া থাকার পুলিশ কিশোরগঞ্জে গিয়ে ম্যাজেস্ট্রেট আর পুলিশ বাহিনী চায় মহব্বতকে উদ্ধার করার জন্য। অনুমোতি পাওয়া যায়। মাসটা ছিল অগ্রাহয়ণ। আমিও পুলিশের সাথেই ঘটনাস্থলে যাই। তখন কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার ছিলেন নুরুল আনোয়ার(সম্ভবতঃ)। আর ঢাকা ডিআইজি ছিলেন আবদুল খালেক। পুলিশ ঘটনাস্থলে না পৌছে দুরে রাস্তার উপর থেকে মতির বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। আর পুলিশ সুপারের গাড়ি চালক মতির বাড়িতে গিয়ে মতির লোকদের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করে। ওপরদিকে পুলিশ গুলি ছুড়লে চালক আর মতির একলোক মারা যায়। ঘটনা আরো জঠিল রূপ নেয়। আরো পুলিশ মোতায়েন করা হয়। একদিকে কিশোরগঞ্জের পুলিশ, অপরদিকে নরসিংদীর পুলিশ দুই দিকে অবস্থান নেয়। আর ডিআইজ খালেক সাহেব অবস্থান নেন কালিয়াচাপড়া চিনি কলের ডাকবাংলায়। উনার হুকুমে শুরু হয় অপারেশনের নামে যুদ্ধ। তখন ঢাকায় সংবাদ মাধ্যমে ধর্মঘট চলছিল। প্রকাশ হতে থাকলো বাংলার বাণী পত্রিকা। খবর বিবিসি’তে। খবর ছড়ালো পীরের বিশাল বাহিনী আর বিশাল অস্ত্র ভান্ডার। থেকে থেমে গুলাগুলি। শিমুলিয়া গ্রামে পুলিশ আগুন দিল। এলাকার মানুষ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে ছিল সেই ভাবে পালাতে শুরু করলো। একদিকে নরসিংদীর পুলিশের গুলি অপরদিকে কিশোরগঞ্জের পুলিশের গুলি। এই গুলাগুলিতে প্রাণ গেল ১৩ জনের। আমার এক কলেজ বন্ধু মতিউর রহমান(পুলিশ সার্জেন্ট) পাটুয়াভাঙ্গা গ্রামের । তার বাবা পুকুরে ওজু করতেছিল, তিনিও গুলিতে প্রাণ হারালেন। পুলিশের দেয়া আগুনে শিমুলিয়া গ্রামের ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা আর ধানের জমি পুড়ে ছাই। অবশেষে ঘটনাস্থলে পৌছে যা পেল তা হলো লইসেন্স করা একটি কাতুস আর একটি লাইসেন্স করা পিস্তল। রাষ্ট্রপতি এরশাদ গেলেন ঘটনাস্থলে। ডিআইডি খালেকও ছিলেন, সাথে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী( সম্ভতঃ মাহবুবুর রহমান)। এরশাদের পাশেই আমি ও কয়েক সাংবাদিক খাড়া। এরশাদ বললেন‘দেখ মাহবুব তোমার পুলিশ কি করছে’। তদন্ত কমিটি হলো বিচারপতি আবদুল বারি সরকারের নেতৃত্বে। তিনি এলাকায় কয়েকদিন ঘুরে ঘটনা পর্যবেক্ষন ও সাক্ষি নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করলেন। রিপোর্ট জমা হলেও প্রকাশ পেলো না। মতির ভাই হাবিব রিপোর্টের একখানা কপি উদ্ধার করেছিলেন। রিপোর্টের শেষ বাক্যটি বা মন্তব্যটি যা ছিল তা আর নাই বা বললাম। যাক সে সব কথা। কাজেই সব তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ পায় না, কারণ ক্ষমতা আর অর্থ এর পিছনে কাজ করে।
কোন বড় দুর্ঘটনা বা কোন আলোচিত- সমালোচিত ঘটনা ঘটলেই তদন্ত কমিটি ঘটন করা হয়। এটি একটি মামুলি বিষয়। আর তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে যা হচ্ছে তা হলো প্রকৃত অপরাধিকে তার অপকর্ম থেকে রেহাই দেয়া আর অপরাধকে উৎসাহিত করা। সেই সাথে জান-মালের ক্ষতিকে বাড়িয়ে দেয়া। ঘটনা-দুর্ঘটনা কেন ঘটছে তা তাৎক্ষনিক ভাবেই জানা যাচ্ছে। তারপরও কেন তদন্ত কমিটি? সংবাদ মাধ্যমে তাৎক্ষনিক ভাবেই প্রকাশ পাচ্ছে ঘটনার কারণ। যেমন শিক্ষার্থীগের সেতু বানিয়ে তাদের উপর দিয়ে সাহেবরা জুতা পায়ে হেটেছে। এটা পরিষ্কার ভাবেই সচিত্র খবর প্রকাশ পাচ্ছে। এটার জন্য আর তদন্ত কমিটি কেন? সরকারের সরকারের উচিত ছিল তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়। এখন তদন্ত কমিটি করে একখানা নাটক সাজানো হচ্ছে। কিছু কিছু ঘটনা আছে যার কারণ তাৎক্ষনিক ভাবে জানা সম্ভব হয় না। যেমন একটা অগ্নিকান্ড ঘটলো তার কারণ হয়তো তাৎক্ষনিক ভাবে জানা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে অধিকাংশ ঘটনাই তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ পায়। কত মানুষ মরছে নানা দুর্ঘটনায়। অনেক বড় দুর্ঘটনার তদন্তও হয়, কিন্তু বিচার হয়না, তদন্ত কমিটি হয়, রিপোর্ট প্রকাশ পায় না, অপরাধির বিচার হয় না। গত ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৬৮১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, মারা গেছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন, আহত অনেক। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। আর সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে। অপরাধিদের বিচার না হওয়ায় দুর্ঘটনা বাড়ছে, মানুষ মরছে। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নৌদুর্ঘটায় মারা গেছেন ১ হাজার। দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০০। তদন্ত কমিটিও হয়েছে। অপরাধীর বিচার হয়নি। পোশাক শিল্পে ২০০৮ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত অগ্নিকান্ডসহ নানা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪ হাজার ৩৯৯ জন, আহত ১০ হাজার ৪১ জন, অনেকেই নিখোজ। রানা প্লাজা সহ কয়েকটি বড় ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। সেসব কমিটি আলোর মুখ দেখেনি। অপরধিরা ধরাছোয়ার বাইরে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়ার উল্লেখযোগ কয়েকটি কারণ হচ্ছে-যারা অন্যায় করেন তারা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের ব্যক্তি। যেমন পোশাক শিল্পে যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটছে তারা সবাই প্রভাবশালী। কাজেই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে সরকার কখন ব্যবস্থা নেবে না। এছাড়া মোটা অংকের ঘুষ বা ছালামি দেয়া হয়। সরকারি কোন ব্যক্তি যদি কোন অপকর্ম করেন তাহলে সরকারী লোক দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে সেই তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখবে না, দোষিদের বিরূদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে না, এটাই স্বাভাবিক। মূল কথা হলো টাকা আর ক্ষমতার দাপটে তদন্ত কমিটি হারিয়ে যায়। অপরাধিকে রক্ষা করার জন্যই তদন্ত কমিটি।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন