দেশে দেশে ভ্যালেন্টাইন’স ডে

  14-02-2017 11:14AM

পিএনএস ডেস্ক: বর্তমানে ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা ভালবাসা দিবস বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এক নাম। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন এর নাম অনুসারে পালিত হয় “ভ্যালেন্টাইন ডে” অর্থাৎ “বিশ্ব ভালবাসা দিবস”। রোমান সম্রাজ্জের সময় থেকে শুরু হয় ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ পালন। প্রাচীন রোমে নারী ও বিবাহের দেবী বলে বিশ্বাসরত রোমান রানী জুনোর সম্মানে পবিত্র দিন ১৪ ফেব্রুয়ারী অনুসরন করে পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারী লুপারকেলিয়া উৎসব পালিত হতো এবং বিশেষ ভোজও হতো। লুপারকেলিয়া ছিল রোমান প্রেম উৎসবের নাম। তখনকার সময়ে তরুণ-তরুণীদের জীবনব্যবস্থা বর্তমান পেক্ষাপট থেকে ভিন্ন ছিল। তৃতীয় শতাব্দীর সময় রোমে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন ধর্মযাজক হিসেবে কাজ করছিলেন। সে সময় রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস এর শাসনামলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছিল। সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস তার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। কিন্তু তার সেনাবাহিনীতে আশানুরুপ সৈন্য ভর্তি না হওয়ায় তিনি কঠিন সময় পার করছিলেন এবং পরিবার ও ভালবাসার মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধে না যাওয়াকেই প্রধান কারন হিসেবেই দায়ী করছিলেন। তাই ক্লডিয়াস রোমে বিয়ের উপর নিষেদাজ্ঞা আদেশ জারি করেন। ভ্যালেন্টাইন এই জারিকে অনৈতিক আখ্যায়িত করলেন এবং বিরোধিতা করলেন। তখন সেইন্ট ভ্যালেনন্টাইন ও সেইন্ট ম্যারিয়াস খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের গোপনে গোপনে বিবাহ দিতেন এবং সহযোগিতা করতেন। এ কার্যকলাপ প্রকাশ পেলে রোমের ম্যাজিস্ট্রেট ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেফতার করেন। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন বন্দি থাকা অবস্থায় অনেক তরুণ কপোত-কপোতী তার সাথে দেখা করতে যেত। এমন কি তারা কারাকক্ষের জানালা দিয়ে বন্দী ভ্যালেন্টাইন এর উদ্দেশ্যে তাদের লেখা চিরকুট ও ফুল দিয়ে কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা প্রকাশ করত। এদের মধ্যে একজন কারারক্ষীর মেয়েও ছিল।

ঐ মেয়েটি কারারক্ষী বাবার দেওয়া সুযোগ নিয়ে মাঝে মাঝে ভ্যালেন্টাইন এর সাথে দেখা করতেন এবং কথা বলতেন। পরে ভ্যালেন্টাইন ও মেয়েটি এক অপরের বন্ধু হয়ে যান। এসব ঘটনায় হিংস্র প্রকৃতির ক্লডিয়াস ক্ষিপ্ত হয়ে যান এবং ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। ভ্যালেন্টাইনকে শিরশ্ছেদ করে হত্যার দিন তিনি মেয়েটিকে তার বন্ধুত্ব ও ভালবাসার প্রতি বিশ্বাস নিয়ে একটি চিরকুটে লেখে রেখে যান “লাভ ফরম ইউর ভ্যালেন্টাইন”। এটা ছিল সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের বীরোচিত ও রোমান্টিক ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ। ফলে ঐ দিনই বিচারকের নির্দেশে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে হত্যা করা হয়। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের এ আত্মত্যাগের দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারী।

এরপর ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়াস সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের সম্মানে লুপারকেলিয়া উৎসবের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারী’র পরিবর্তে ১৪ ফেব্রুয়ারী নির্ধারন করেন। পরবর্তীতে এটি সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের নাম অনুসারে দ্রুত ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ নামে পরিচিতি লাভ করে। বিশ্বব্যাপীই ভালবাসা দিবস নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি উপহার, ফুল ও কবিতা বিনিময়ের মাধ্যমে পালিত হয়।

# মধ্যযুগে ফ্রান্সে ও ইংল্যান্ডে বিশ্বাস জন্মে যে, ১৪ ফেব্রুয়ারী পাখিদের প্রেম-বন্ধনের ঋতু, আর সেখান থেকেই চালু হয় ফেব্রুুয়ারীর মাঝামাঝি সময়ে ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা রোমান্সের দিবস হিসেবে উদযাপন।

# জাপান ও কোরিয়াতে নারীরা ও কিছু পুরুষরাও পরস্পরের মধ্যে ক্যান্ডি, চকোলেট, ফুল আদান-প্রদান করে দিবসটি পালন করে। বিশেষ করে যারা অফিসে কাজ করে তারা সহকর্মীদের মাঝে চকোলেট বিতরন করে। এই চকোলেটকে বলা হয় গিরি-চকো, জাপানের গিরি (অনুগ্রহ) ও চকো শব্দ থেকে এটা চালু হয়েছে-যা দেওয়া হয়ে থাকে প্রেমের ক্ষেত্রে গভীর সর্ম্পকের বেলায়। বন্ধু, বিশেষ করে তরুণীরা চকোলেট বিনিময় করে থাকে-যেটাকে বলা হয় টমো-চকো; জাপানিদের মাঝে টমো মানে বন্ধু। অন্য বিপণন প্রচেষ্টায় হোয়াইট ডে নামক পারস্পরিক বিনিময়ের একটা দিবস উদ্ভুত হয়েছে। ১৪ মার্চে, পুরুষরা প্রতিদান আশা করে থাকে যারা ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে চকোলেট উপহার দিয়েছিল। বেশকিছু পুরুষ তাদের গার্লফ্রেন্ডদের উপহার দেয়। মূলত তারা প্রতিদান চায় সাদা চকোলেট বা তুলতুলে লেবেনচুষ।

# দক্ষিণ কোরিয়ায় ১১ নভেম্বর পেপেরো ডে উদযাপিত হয়। ওই দিন জুটিরা পরস্পর পরস্পরকে রোমান্টিক উপহার দেয়।

# চীনা সংস্কৃতিতে ভ্যালেন্টাইন ডে’র অনুরুপ ভিন্ন একটি দিন ‘দি নাইট অব সেভেনস’ পালিত হয় চন্দ্র বর্ষের সপ্তম মাসের সপ্তম দিন।

# পারস্য সংস্কৃতিতে এই দিবসটি সতর্কভাবে উদযাপিত হয় ইহুদি ঐতিহ্য-অনুসারে অগস্টের পঞ্চদশ দিবসে পেমের উৎসব পালিত হয়।

# ব্রাজিলে ১২ জুন ‘বয়ফ্রেন্ড স/ গার্লফ্রেন্ডস ডে পালিত হয় জুটিরা চকোলেট, কার্ড, ফুলের তোড়া বিনিময় করে থাকে।

# কলম্বিয়ায় ‘লাভ এ- ফ্রেন্ডশিপ ডে’ উদযাপিত হয় সেপ্টেম্বরের তৃতীয় শুক্রবার ও শনিবার, বাণিজ্যিক শর্তের কারনে।

# মেক্সিকোতেও কলম্বিয়ার মতো একইভাবে উদযাপিত হয়, তবে সেটা ১৪ ফেব্রুয়ারী।

স্লোভেনিয়া, রুমানিয়া, নরওয়ে, ফ্রিনল্যান্ড, ভারতবর্ষসহ আধুনিক বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আনন্দমুখর পরিবেশে প্রেমের দিবস হিসেবে “ভ্যালেন্টাইন’স ডে” পালিত হয়।

যাই-হোক, কালের ধারাবাহিকতায় আজ অবধি এই ১৪ ফেব্রুয়ারীই প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে বা বিশ্ব ভালবাসা দিবস’। এই ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র বা ভালবাসা দিবসের কিছু মিথ বা কুসংস্কার বা ব্যাপ্ত ধারনা যাই বলি না কেন তা এক সময়ে প্রচলিত ছিল।

ওয়েলসে কাঠের তৈরি চামচের উপরে হৃৎপিণ্ড, তালা, শেকল প্রভৃতি নক্সা খোদাই করে এ দিনে উপহার দেওয়া হতো। কোথাও এদিনে তরুণীরা রোদে একটি বাটিতে পরিস্কার পানি রেখে তার উপর চেয়ে থাকত। ধারনা করা হতো, যার ছবি ঐ পানিতে ভেসে উঠবে সে-ই হবে তার আকাঙ্খার ভ্যালেন্টাইন। কোথাও ফেব্রুয়ারীর ১৪ তারিখে তরুণ-তরুণীরা তাদের জামার হাতায় পছন্দের মানুষটির নাম লেখে সপ্তাহ জুড়ে ঘুরে বেড়াত। বিশ্বাস করত এর ফলে সহজেই ভালবাসার মানুষটিকে তারা কাছে পাবে।

কোন কোন দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারীতে অবিবাহিত ছেলেরা মেয়েদের নতুন নতুন পোষাক উপহার হিসেবে পাঠাত। মেয়েটি ঐ পোষাক পরলে মনে করা হতো মেয়েটি ছেলেটিকে বিয়ে করতে রাজি। এছাড়াও তারা বিশ্বাস করতো ১৪ ফেব্রুয়ারী যদি কোন মেয়ে তার মাথার উপর দিয়ে ফিতা উড়ে যাওয়া দেখে তাহলে তার বিয়ে হবে কোন নাবিকের সাথে, যদি সে চড়ূই পাখি উড়ে যাওয়া দেখে তাহলে তার বিয়ে হবে দরিদ্রলোকের সাথে-কিন্তু সে হবে খুবই সুখী। আবার সে যদি সোনালী রংয়ের মাছ দেখে তাহলে তার বিয়ে হবে প্রভাবশালী ধনাঢ়্য ব্যক্তির সাথে। এভাবেই এক এক দেশে একেকভাবে জড়িয়ে আছে ভ্যালেন্টাইন’স ডে।

সবচেয়ে প্রাচীন ভ্যালেন্টাইন কার্ডটি সংরক্ষিত আছে লন্নেডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। নরম্যা-ির ডিউক চালর্স ব্যাটল অব আজিনকোর্ট-এ বন্দি হয়ে তিনি টাওয়ার অব ল-নে ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দে তার স্ত্রীকে ‘ভ্যালেন্টাইন’ শিরোনামে একটি কবিতা লেখে উপহার দেন। ধরনা করা হয় যে এটিই প্রথম ভ্যালেন্টাইন কার্ড।

সপ্তদশ শতাব্দীতে গ্রেট ব্রিটেনে ভ্যালেন্টাইন’স ডে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তখন মেয়েরা এদিন একটা সিদ্ধ ডিম খেত আর পাঁচটা পাতা বালিশের উপর মাথা রেখে ঘুমাত। এতে তারা বিশ্বাস করত মনের মতো স্বামী পাবে।

অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ভ্যালেন্টাইন ডে’র উপহার সামগ্রীর বিনিময় শুরু হয়। এ সময় সকল শ্রেণীর বন্ধু-বান্ধব, কপোত-কপোতী, প্রেমিক-প্রেমিকা জুটিদের মধ্যে ভালবাসার নিদর্শন স্বরপ ছোট ছোট স্মৃতিচিহ্ন বা হাতে লিখিত স্মারকলিপি বিনিময় প্রথা হয়ে দাড়ায়। এই শতাব্দীর শেষের দিকে মুদ্রণযন্ত্র আবিস্কৃত হলে মুদ্রিত কার্ডের মাধ্যমে ভালবাসার বানীসহ আবেগ প্রকাশের আদান-প্রদান শুরু হয়। পরবর্তীতে ডাক বিভাগের মাধ্যমে আরো জনপ্রিয়তা পায়।

আমেরিকানদের মধ্যে হাতে-তৈরি ভ্যালেন্টাইন’স উপহার প্রদান শুরু হয় সপ্তদশ শতকের শুরুতে। ১৮৪০ সালে ইস্টার-এ হল্যান্ড নামে এক ব্যক্তি হরেক রকমের কার্ড এবং উপহার সামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাতকরন করে জনপ্রিয় করে তোলেন।

ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনকারীরা উনবিংশ শতাব্দীতে ভ্যালেন্টাইন ডে পোস্টকার্ড উত্তর আমেরিকায় আমদানি করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম যন্ত্রাদির সাহায্যে উৎপাদিত প্রচুর পরিমানে ভ্যালেন্টাইন উপহার বিক্রি হয় ইস্টার হল্যান্ড কর্তৃক।

ডায়মন্ড ইন্ডাস্ট্রি ভ্যালেন্টাইন’স ডে উপলক্ষে ১৯৮০ সালে নানা রকম জুয়েলারী উপহার প্রদান শুরু করেন।

বাংলাদেশে এ দিবসটি প্রবর্তন করেন খ্যাতিমান লেখক ও সাংবাদিক শফিক রেহমান ১৯৯৩ সালে। তারপর থেকে বর্তমানে এ দিবসটি এ দেশে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ছাড়াও পিতা-মাতা, ভাই-বোনদের মধ্যেও ফুল, কার্ড বা আন্যান্য সামগ্রী উপহার বিনিময়ের মাধ্যমে পালিত হয়। তবে বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যেই বেশী প্রচলিত। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াতেও এ দিবস উপলক্ষে বিশেষ লেখা বা অনুষ্ঠান প্রচার হয়।

২০০১ সাল থেকে গ্রিটিং কার্ড এসোসিয়েশন প্রতিবছর ‘ইস্টার হল্যান্ড এওয়ার্ড ফর দি গ্রিটিং র্কাড ভিশনারী’ অনুষ্ঠান করে আসছে। গ্রিটিংস কার্ড এসোসিয়েশনের এক পরিসংথ্যান থেকে জানা যায়, ভালবাসা দিবসে প্রতিবছর এক বিলিয়নের বেশী কার্ড পাঠানো হয়। ভ্যালেন্টাইন ডে এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্ড বিনিময়ের উৎসবে পরিনত হয়েছে।

সেইন্ট ভ্যালেন্টইনের আত্মত্যাগের ইতিহাস আজ বিশ্বব্যাবী সমাদৃত। ভালবাসার জন্য শুধু ভ্যালেন্টাইন নয়, যুগে যুগে শতকে শতকে বহুদেশের বহুজন জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। ভালবাসার বিজয় এনেছেন। ভালবাসার কোন সীমা নেই। ভালবাসা সব সময়ই সর্বজনীন।

লেখক:- মোঃ মিজানুর রহমান। সাংবাদিক, কবি ও কলামিস্ট।


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন