স্বাধীনতার ঘোষনার প্রকৃত ইতিহাস ও মির্জা আবু মনসুরের জবানবন্দি

  07-03-2017 10:28AM



পিএনএস, ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম : ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবদ্ধু শেষ মুজিবুর রহমানে ভাষণই ছিল মূলতঃ স্বাধীনতার ঘোষনা। ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার,এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষনায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা যা ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্স লাইট’ চুড়ান্ত রূপ নেয়। স্বাধীনতার ঘোষনা নিয়ে স্বাধীনতা বিপক্ষের শক্তি নানা ধরণের বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং আজও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের মতে স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়া। আসলে কি তাই? এবিষয়ে মির্জা আবু মনসুর(জোনাল কমান্ডার, সেক্টর-১, প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য ও প্রক্তন সভাপতি চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি) সাহেবের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল তুলে ধরা হলো।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে তৎকালীন ইপিআর’র সিগন্যাল বার্তায় চট্রগ্রাম আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতা মরহুম এম আর সিদ্দিকী ও মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষনা লাভ করেন। চট্রগ্রামের বীরজনতা তাৎক্ষনিক ভাবে স্বাধীনতার সূতিকাগার চট্রগ্রাম থেকেই শুরু করেন। ঐ রাতেই গঠিত হয় মুক্তিবাহিনীর প্রথম ব্যাটিলিয়ান, যার অন্যতম নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাকে সহ কয়েকজন উদ্যামী ও সাহসী যুবককে দায়িত্ব দেয়া হলো যে কোন উপায়ে কালুরঘাটে অবস্থিত বেতার কেন্দ্র হানাদার কবল থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনা মুক্তিকামী জনগণের মাঝে ইথারের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার। আমরা আর কোন অপেক্ষা না করে চট্রগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাগুলোতে তাৎক্ষনিক ভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করি। এর দায়িত্ব দেয়া হয় ছাত্র নেতা শওকত হাফিজ খান রুশনিকে। কিন্তু চট্রগ্রামের পত্রিকার মালিক ও সম্পদকরা এই দায়িত্ব নিতে অস্বিকার করেন। একমাত্র হাজারি লেইন থেকে প্রকাশিত দৈনিক সমাচারের সম্পাদক সেকান্দর হায়াত মজুমদার ও এই পত্রিকার বার্তা সম্পাদক বাবু মৃণাল চক্রবর্তী এই দায়িত্ব নিতে রাজি হন পরের দিনের পত্রিকায় “ আজ থেকে বাংলাদেশ স্বধীন” এই ব্যানার শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনা প্রকাশ করে বাঙ্গালী জাতির গুরু দায়িত্ব পালন করেন। পরদিন পাক হানাদার বাহিনী এই সমাচার পত্রিকার অফিস গুড়িয়ে দেয়। অপরদিকে আমরা তৎকালিন চট্রগ্রাম আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম এম এ হান্নানের নেতৃত্বে ১০/১২ জন যুবককে দায়িত্ব দেই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হানাদার মুক্ত করতে। পরের দিন দুপুরে দায়িত্ব প্রাপ্ত নেতা-কর্মীরা অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হানাদার মুক্ত করে। এরপর আমরা বেতার কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সাথে যোগাযোগ করি।

যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-প্রকৌশলী ফজলে এলাহী, অনুষ্ঠান প্রযোজক বেলাল মোহাম্মদ ও আবুল কাশেম সন্ধীপ। ২৬ মার্চ দুপুরে এম এ হান্নান ও আবুল কাশেম সন্ধীপ পর্যায়ক্রমে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে প্রাপ্ত স্বাধীনতার ঘোষনা পত্র ইথারে ছড়িয়ে দেন। এরপর থেকে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিযুদ্ধের যৌথ কমান্ড থেকে নির্বাচিত এম পি এ হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয় চট্রগ্রামে কর্মরত বাঙ্গালী সৈনিক, পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে। আমি তাৎক্ষনিক ভাবে ইপিআর’র সেক্টর অধিনায়ক ক্যাপটেন রফিকের সাথে যোগাযোগ করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনা বেতারে প্রচারের জন্য অনুরোধ করলে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তখন যারা কর্মরত ছিলেন তাদের কাউকে দিয়ে সেটি প্রচারের অভিমত প্রকাশ করেন। আমরা ক্যাপ্টেন চৌধুরী খালেকুজ্জামানের মাধ্যমে মেজর শওকতের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন তার সিনিয়র মেজর জিয়া ঘোষনা পত্রটি পাঠ করাতে। তখন ষোলশহর ২ নং গেইটে তিনি অবস্থান করছিলেন। এরপর ২৬ মার্চ বিকাল সাড়ে ৪ টায় ষোলশহর ২ নং গেইটে জিয়া সাথে দেখা হয়। একজন সৈনিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ঘোষনাটি বেতারে পাঠ করার অনুরোধ করি। কিন্তু মেজর জিয়া কেন জানিনা যে, কোন মাসসিকতার বশবর্তী হয়ে এই দায়িত্ব পালনে গড়মসি করতে থাকেন। জিয়া তার অধিনস্থ কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করেন। সে সময় তার সাথে ছিল ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূইয়া, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জজান চৌধুরী প্রমুখ। জিয়া আমার বা ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের সাথে আলাপ না করেই সন্ধ্যা ৭ টায় ঘোষনা দেন “ I Major ziaur Rahman do hereby declare the Independence of Bangladesh”।

জিয়ার এই ঘোষনায় গোটা বিশ্বে দেখা দেয় চড়ম বিভ্রান্তি। আমরা তখন হতম্বভ হয়ে পড়ি। তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নিজেকে বাচানোর জন্য আমাকে ও ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসনকে ঘোষনার মুসাবিদা প্রস্তুত করে দিতে বলেন। তখন আমি, মোশারফ ভাই, চট্রগ্রাম আওয়ামীলীগের দুই শীর্ষ নেতা মরহুম এম আর সিদ্দিকী ও জহুর আহমদ চৌধুরী সাথে যোগযোগ করের জানতে পারি যে, তারা দু’জনই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আগরতলা যাওয়ার জজন্য ফটিকছড়িতে রওয়ানা হয়েছেন। তখন আমরা নিরুপায় হয়ে আমার নতুন volks wagan ধিমধহ গাড়ি নং-চট্রগ্রাম-খ-৬০০ নিজে ড্রাইভ করে মোশারফ ভাই সহ রাত দেড়টায় ফটিকছড়ির দৌলতপুরে মরহুম এম আর সিদ্দিকীর শ^শুর শিল্পপতি এ কে খানের কাছে জানতে পারি যে, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী ঘন্ট দুই আগে আগরতলা রওয়ানা হয়ে গেছেন।

এ কে খান আমাদের ঘটনার শোনে বঙ্গবন্ধুর স্বপক্ষে একটি মুসাবিধা তৈরি করে দেন। আর সেটি ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়ার পাঠ করা সেই ঘোষনা পত্র। যেটি ২৭ মার্চ সকাল ১১ টায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়েছিল। অপরদিকে স্বাধীনতার ঘোষনা পত্র পাঠ করা হয় ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে। ঘোষনা পত্রটি হলো‘ যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল; এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল; এবং যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন; এবং যেহেতু তিনি আহূত এই অধিবেশন স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন; এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারষ্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; এবং যেহেতু উলি¬খিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান; এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে; এবং যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্য এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনার দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব কে তুলেছে; এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ¬বী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে; সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি; এবং এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পক্ষে অধিষ্ঠিত থাকবেন; ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন; এবং তাঁর কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের ক্ষমতা থাকবে; এবং বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন।

বাংলাদেশের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসাবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তেছে তা যথাযথভাবে আমরা পালন করব। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য আমরা অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করলাম। স্বাক্ষর: অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কর কমিশনার

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন