ভারতের বন্ধুত্ব বনাম নিরেট বাস্তবতা!

  04-04-2017 01:07PM



পিএনএস: মূল কথায় যাওয়ার পূর্বে প্রাসঙ্গিকতার হেতুতে ইতিহাস থেকে অতি সংক্ষিপ্ত দু’টো দৃষ্টান্ত টানছি।

প্রথমঃ অবিভক্ত বাংলার প্রথম মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক বলেছিলেন, তোমরা যখন দেখবে কলকাতার দাদারা আমার প্রশংসা করছে তখন নিশ্চিতভাবে বুঝবে আমি দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছি । বাংলার বাঘ খ্যাত মহান নেতা তার রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক দূরদর্শীতা এবং নির্মোহ বাস্তবতা থেকেই এ উক্তি করেছিলেন ।

দ্বিতীয়ঃ যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার নিরব যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকেই । গত শতাব্দীর ’৯০ দশক পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে একক শক্তিধর রাশিয়া তথা বৃহত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিবেচনা করা হতো । ১৯৯১ সালে সেভিয়েত ইউনিয় ভেঙে কয়েক খন্ড করে গেলেন তৎকালীন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেব । আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডা্ব্লিউ এইচ বুশ মিখাইল গর্ভাচেবের ভূয়সী প্রশংসা করার অল্প দিনের মধ্যেই সেভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে কয়েকখন্ড হয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে যায় । এসব আজ ইতিহাসের নির্মম সত্য ।

কোন সন্দেহ নাই ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু । বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসে ভারতের বিশেষত শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অনস্বীকার্য অবদান রয়েছে । আমরা যদি কৃতঘ্ন না হই তবে ভারতের ঋণকে অস্বীকার করার কোন যৌক্তিকতা নাই। বাংলাদেশিরা মনেপ্রাণে কামনা করে, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সমস্বার্থ রক্ষাকারী সম্পর্কের উন্নয়ণ ঘটুক । তবে সাম্প্রতিককালে বন্ধুত্বের ছদ্মবরণে ভারত বাংলাদেশের সাথে এমন কিছু আচরণ করতে শুরু করেছে যেটাকে আর বন্ধুত্বের মোড়কে আবৃত করার সুযোগ রাখেনি । ভারত-নেপাল সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নেপালের গৌবন্দি গৌতম নামের এক যুবক নিহত হওয়ায় দিল্লী কাঠমুন্ডুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্যহয় । অথচ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে অহরহ বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হলেও তাতে দিল্লীর ন্যূনতম সহমর্মিতা প্রদর্শনের লক্ষণ নাই বরং তারা ফেলানী হত্যার বিচারের নামে প্রহসনের আয়োজন করে উগ্রতাই দেখিয়েছে । দিল্লীর কর্তৃত্ব ভারতের মাটিতে গরুর জীবনের মূল্যকে যতোটা মূল্যবান মনে করে তাদের কাছে ততোটা মূল্য বাংলাদেশী মানুষদের জীবনের মূল্যের রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়নি । নয়তো বিশ্বের কোথাও বৈরীতার সম্পর্কেও এমন নজির নাই যেখানে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত কর্তৃক যেভাবে বাংলাদেশী হত্যা হচ্ছে; ভারত বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র ! ধিক্কার এমন বন্ধুত্বে ।

৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমি স্বর্ণ প্রসবিনী । এখানকার মাটি, আলো, বায়ু এবং পরিবেশের সবটাই সোনার ফসল ফলানোর অনুকূলে । যে কারণে অল্প কৃষিভূমি থাকার পারেও এ মাটি প্রায় ১৭কোটি মানুষের আহার যোগানো ও রফতানিযোগ্য কৃষিপণ্য উৎপাদনে সক্ষম । অথচ ভারতের হীন ন্যাক্কারজন আচরণের কারণে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারের পাণিটুকু পাচ্ছে না । উপরন্তু যখন বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলের ফসল তোলার সময় আসে তখন ফারাক্কা, টিপাইমূখ এবং তিস্তাসহ বিভিন্ন নদী-উপনদীর উজানের পানি ছেড়ে দিয়ে বন্যার সৃষ্টি করে কৃষককে পথে বসায় এবং খাদ্যশস্যে চিরকাল যাতে বাংলাদেশীরা ভারতমূখী অবস্থানে থাকে তার সবরকম চক্রান্ত ফাঁদে ।

বাংলাদেশ ভারতের মতো নির্লজ্জ হতে পারেনি । বন্ধুত্বের দাবীতে তারা যখন যা চেয়েছে তা অনায়াসে পেয়েছে । বিশ্লেষকরা বলেছেন, দিল্লী ঢাকা থেকে যেসকল সুবিধা শর্তহীনভাবে পায় ততোটা সুবিধা তারা তাদের রাজ্য সরকারগুলো থেকেও পায়না । এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আত্মসমর্পিত ৯৪ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের সামরিক অস্ত্র এবং অন্যান্য মালামাল ভারত নিয়েছে, ’৭৫ এর জানুয়ারিতে সংবিধান সংশোধন করে তিনবিঘা করিডোর ভারতকে উপহার দেয়া হয়েছে, সাম্প্রতিক কালে, ট্রানজিট (সড়ক, নৌ এমনকি আকাশ হস্তান্তরের বিষয়টিও প্রস্তাবিত) বাংলাদেশে ঢালাওভাবে ভারতের সংস্কৃতির আমদানি এবং অতিসম্প্রতি সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধের সম্ভাব্যতাও প্রবল হয়েছে অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৫ বছরে ভারত থেকে বাংলাদেশ কি পেয়েছে; চক্রান্ত ছাড়া ?

ঋণ, ঋণের সূদ কিংবা উপহারের নামে গরীব বাংলাদেশ ভারতকে বন্ধুত্বের খাতিরে এতোকিছু দিলো অথচ ভারত বাংলাদেশকে কি দিয়েছে; সীমান্তে লাশের উপহার ছাড়া ? আমাদের ন্যায্য হিস্যার পানিটুকু অনেক মিনতি করেও পাওয়া যায়নি । তাদের নির্লজ্জ স্বার্থপরতার কারণে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে, উত্তরের জনপদ মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে, মঙ্গায় ভূগছে বিশাল অঞ্চল । পাওনা পানি না দিয়ে তারা গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং বর্ষা মওসূমে এমনভাবে পানি পাঠায় যাতে নিম্নাঞ্চলের মানুষের ডুবে মরার অবস্থা, জেলার পর জেলার মানুষ পানিবদ্ধ হয়, উজানে নেমে আসা পানির প্লাবনে কৃষক ফসল-মাছ হারায়, গ্রহপালিত পশু-পাখি হারা হয় অগণিত মানুষ । পানিবাহিত রোগে রোগাক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায় । খাদ্য আর বিশ্রামের অভাবে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ দুর্ভিক্ষপ্রবন অঞ্চলের মানুষের রূপ ধারণ করে । এই বুঝি বন্ধুত্বের নমুনা ?

আজকাল ভারতের বিভিন্ন পত্রিকা বিশেষ করে আনন্দবাজার বাংলাদেশের খুব প্রশংসা করছে । তাদের উদ্দেশ্য কতোটা মহৎ তা সময় নির্ধারণ করবে কিন্তু চৌকষ আবুল কাশেম ফজলুল হকের মতো কোন রাজনৈতিক নেতা ও মহৎ নেতৃত্বের শুণ্যতা বোধহয় বাংলাদেশীদেরকে ভোগাবে খুব । স্বার্থ হাসিলের জন্য সিনিয়র বুশ গর্ভাচেবের প্রশংসা করেছিলো, ভেঙে দিয়েছিলো শক্তিধর রাশিয়াকে । তেমন প্রশংসা শুনে আমাদের কেউ যাতে সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতার স্বকীয়তা নিলামে তোলার পথে পা না বাড়ায়-এতোটুকু নিশ্চয়তা কি দেশপ্রেমের প্রশ্নে পেতে পারি না? ইতিহাস সাক্ষী, দেশের স্বার্থ বিরোধী কোন সিদ্ধান্তে যদি কেউ কলম বাড়ায় তবে আগামী প্রজন্মের ইতিহাস তাদেরকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে; যেমন সব অতীতে ঘটেছে ।

রাজু আহমেদ, কলামিষ্ট ।
[email protected]
পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন