‘আমার ঠিকানা তাই গোয়ালঘর’

  14-07-2017 04:51PM

পিএনএস ডেস্ক : নাম বিবি মরিয়ম। বয়স ৮৫ বছর। পড়ে আছেন গোয়ালঘরে। রাতে শিয়াল কামড়ায়! ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার পুটিজানা ইউনিয়নের তেজপুটুলি গ্রামের ঘটনা। তাঁর ছেলেমেয়েরা তাঁকে দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে চায় না। তাই বিবি মরিয়মের ঠিকানা ছিল তাঁদের বাড়ির গোয়ালঘর। ফেসবুকে এ রকম একটা পোস্ট ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।

সেদিন আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে বয়স্ক ভাতা নিয়ে আলোচনার সময় এ ঘটনার কথা আলোচনায় আসে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কয়েকটি এলাকায় কাজ করে তার ফলাফল সেখানে তুলে ধরছিল। ওই বৈঠকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সোমা দত্ত এই করুণ কাহিনির কথা বলেন।

এই মর্মান্তিক স্ট্যাটাস দেখে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নূরুল কবির সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকায় যোগাযোগ
করে বৃদ্ধাকে হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তিনি এখন সুস্থ। তাঁকে সরকারি ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ছেলেমেয়েরা উপযুক্ত শিক্ষা পেয়েছে। ওরা ওদের ভুল বুঝতে পেরেছে। মা এখন আবার মায়ের রূপে ফিরে এসেছেন সন্তানদের কাছে।

মহাপরিচালক বললেন, তাঁদের অধিদপ্তর বয়স্কদের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে করার চেষ্টা করছে।

কিন্তু সব খবর তো আর ফেসবুক স্ট্যাটাসে আসে না। আর এলেও একজন মহাপরিচালক বা সরকারি কর্মকর্তার পক্ষে সব খবরে
সাড়া দেওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। দেশে বয়স্ক ভাতার যে ব্যবস্থা আছে, তার সুফল সত্যিকার অর্থে অসমর্থ বয়স্ক মানুষের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই আসল কথা।

আমার মায়ের কাছে একটা গল্প শুনেছিলাম। তরুণ ছেলে এসে বাবাকে বলল, তোমার কাছে এক ভদ্রলোক এসেছেন। ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছেন। মিনিট পাঁচেক পর ছেলে এসে দেখে, বাবা ইজি চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছেন। সে তো রেগে আগুন। ধমকের সুরে বলল, এখনো এখানে? সব কথা ভুলে যাও কেন? ভদ্রলোক কী ভাববেন?

বাবা তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন। পরে ছেলেকে ডেকে স্নেহের সুরে বললেন, তুই যখন খুব ছোট, একদিন জিজ্ঞেস করলি, বাবা, কা, কা করছে, ওটা কী? আমি বললাম, কাক।

কিন্তু একটু পরেই ভুলে গেলি যে ওটার নাম ‘কাক’। তাই কিছুক্ষণ পর আবার বললি, বাবা, ওটা কী? আমি বললাম, কাক। এ রকম দশ-বারো দিন বলার পর তুই ‘কাক’ চিনতে পারলি। বাবা-ছেলের কথা এখানেই শেষ।

খুব হালকাভাবে বললাম। আসলে সমাজে বুড়ো মানুষের অবস্থা খুবই করুণ। এমন করুণ যে একসময় নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন, এত বেশি বয়স পর্যন্ত বাঁচলাম কেন? আমি এখন কী করব?

আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য মো. হাবিবে মিল্লাত ছিলেন। তিনি বললেন, সরকার শুধু বয়স্ক ভাতা নয়, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধীদের জন্য সহায়তাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। মানুষ বেশি, সংগতি সীমিত।

তাই বাছাই প্রক্রিয়া যতটা সম্ভব ত্রুটিমুক্ত করাই বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বললেন, তাঁর এলাকায় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে তিনি এ বিষয়ে কাজ করছেন।

এটাই মূল কাজ। যদি জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা যায়, আর তাঁরা যদি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করেন, আর যদি এলাকার নির্বাচিত সাংসদেরা নজরদারি করেন, তাহলে সরকারের সহায়তা কর্মসূচির সুফল গ্রামের গরিব, বয়স্ক মানুষেরা পাবেন।

কিন্তু তারপরও সমস্যা আছে। একটি অভিজ্ঞতায় দেখা গেল, একজন চেয়ারম্যান বলছেন, যেহেতু বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি, কিন্তু বরাদ্দ কম, তাই প্রচার করে সবাইকে ডেকে খোলা বৈঠকে বয়স্ক ভাতার জন্য তালিকা করা সমস্যা। এ অবস্থায় তিনি নিজে খোঁজখবর নিয়ে এলাকার বয়স্ক এবং যাঁদের সত্যিই আয়-উপার্জনের আর কোনো উপায় নেই এবং যাঁদের দেখাশোনার জন্য ধারেকাছে ছেলেমেয়েরাও নেই, তাঁদের তালিকা তৈরি করেছেন।

এই পদ্ধতিতে ভুল হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। ভুল না হলেও সবাই হয়তো সন্দেহ করবেন, নিজের লোকজনকেই তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। তাই কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি কোনো তালিকা করা যাবে না।

গ্রামে প্রচার করে সবাইকে জানিয়ে বৈঠক করে সবার মতামত নিয়ে তালিকা করতে হবে।

সেখানে যখন দেখা যাবে, বরাদ্দ ১০ জনের, কিন্তু তালিকায় ২০ জনের নাম এসে গেছে, তখন কী করবেন? এরও একটি সমাধান আছে। ও রকম ক্ষেত্রে সেই ২০ জনকে নিয়ে একটা কমিটি গঠন করা যায়। তাঁদের ওপরই দায়িত্ব দেওয়া যায়, যেন তাঁরা নিজেরা আলাপ-আলোচনা করে তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি ১০ জনকে নির্বাচিত করেন।

কাজটা কঠিন হলেও সম্ভব। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনামও তাঁদের এই অভিজ্ঞতার কথা বললেন। তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন প্রকল্পে এ ধরনের গ্রুপ গঠন করে সুফল পেয়েছেন। অন্য কয়েকটি এনজিও প্রতিনিধি বললেন, খোলা বৈঠকে তালিকা নির্ধারণের পর তালিকাভুক্তরাই সেই তালিকার নাম কাটছাঁট করে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করে দিয়েছেন। এরপর তো আর সমস্যা থাকে না।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, সরকারের বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা বা এ ধরনের সহায়তা কর্মসূচির অর্থ দান–খয়রাত নয়। গোলটেবিল বৈঠকে এ কথাটাও বেশ কয়েকজন বলেছেন। কারণ, এই মানুষেরাই একদিন মাঠে কাজ করেছেন। ফসল ফলিয়েছেন। কারখানায় কাজ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। আজ বয়সের ভারে যখন তাঁরা কাজের শক্তি হারিয়েছেন, তখন তাঁদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব সমাজের, তথা সরকারের ওপরই বর্তায়।

এখানে বয়স্কদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে শুধু সরকারের একার পক্ষে সবার জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করা কঠিন। সে জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা করা যায়। তরুণ ও যুবক বয়সে যাঁরা কাজ করবেন, উপার্জন করবেন, তাঁরা প্রত্যেকেই কিছু টাকা পেনশন ফান্ডে জমা রাখবেন। সরকারও কিছু টাকা দেবে। পরে দুয়ে মিলে পেনশনের টাকা পাবেন। এটা হবে সবার জন্য একধরনের বয়স্ক ভাতা।

কিন্তু এখানেও সমস্যা। দেশে বেকারের সংখ্যা কী কম? তাঁরা কোথা থেকে পেনশনের জন্য টাকা জমা করবেন? এখন কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। তাঁদের কাজের সুযোগ তো আগে করতে হবে।

জানি, বেকার আছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে ২৩ শতাংশ মানুষ। সে জন্যই এখনো দরকার বয়স্ক ভাতা।

বয়স্ক মানুষ যদি সমাজে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে না থাকতে পারেন, আমরা বিশ্বের মানুষের কাছে মুখ দেখাব কীভাবে?

[ আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।[email protected] প্রথম আলোর সৌজন্যে]
পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন