বিভ্রান্তি, ভয় ও চাটুকারিতার খেসারত

  23-07-2017 09:02PM

পিএনএস (এ কে এম জাকারিয়া) : বঙ্গবন্ধুর ছবি ‘বিকৃত’ করার ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা কেটেছে। যার ‘হৃৎকম্পন’ ঘটনা জন্ম দিয়েছিল, সেই বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ ওবায়েদুল্লাহ দল থেকে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ায় অনেকেই খুশি হয়েছেন। ইউএনও গাজী তারিক সালমনের বিপদও কেটেছে। তাঁকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ চারদিক থেকে শোনা গিয়েছিল, সেখানেও স্বস্তি এসেছে। এর কৃতিত্ব পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এ ঘটনায় তিনি বিরক্ত হয়েছেন বলে আমরা জেনেছি। তিনি সরাসরি ভূমিকা পালন না করলে ঘটনা এত দ্রুত পাল্টে যেত না।


প্রধানমন্ত্রী সবকিছুর খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করেন এবং দ্রুত সাড়া দেন—এটা তাঁর বিশেষ গুণ। কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যই যদি প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা বা হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়ে বা এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তবে তা সরকার ও প্রশাসনযন্ত্রের অদক্ষতাকেই তুলে ধরে। এখানে বড় ধরনের ঘাটতির বিষয়টি দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। স্বাভাবিক আইন ও নিয়মনীতি মানলে ইউএনও যে কায়দায় গ্রেপ্তার হলেন, সেই ঘটনাই ঘটত না।

ইউএনও উপজেলা পর্যায়ের সবচেয়ে বড় নির্বাহী কর্মকর্তা। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা আমলে নিতে বা গ্রেপ্তার করতে হলে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগে। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, সেখানকার জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কি বুদ্ধি-বিবেচনা লোপ পেয়েছিল? বোঝা যায়, স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসনে অনেক কিছু নিয়েই বিভ্রান্তি রয়েছে। বিভ্রান্তি থেকেই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। ইউএনও গ্রেপ্তারের ঘটনার মধ্য দিয়ে তা পরিষ্কার হয়েছে। আরও বোঝা যাচ্ছে, কিছু কিছু বিষয়কে আমরা এতটাই সংবেদনশীল করে তুলেছি যে সেসব ক্ষেত্রে আইন ও নিয়মকানুন মেনে কাজ করার পরিস্থিতিও নষ্ট হয়ে গেছে।

ইউএনও গ্রেপ্তারের ঘটনাটি আমাদের নাড়া দিয়েছে। কিন্তু এটা কি হঠাৎ হাজির হওয়া কোনো ঘটনা? নাকি ধারাবাহিকতা মেনেই ঘটনাটি ঘটেছে? ‘অবমাননা’, ‘বিকৃতি’ বা ‘অনুভূতিতে আঘাত’—এগুলোর অপব্যবহারকে কি দিনে দিনে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি! আমরা তো দেখেছি, এ ধরনের মামলা করে নেতৃত্বের মনোযোগ পাওয়ার সংস্কৃতিকে সরকার ও সরকারি দলের তরফে উৎসাহিত করা হয়েছে।

এটা দেশে একধরনের ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। অথচ লেখালেখি বা শিল্পচর্চার জন্য শুধু নয়, জীবনধারণের জন্যও মুক্ত ও ভয়হীন পরিবেশ জরুরি। সেই পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় স্বাধীন মতপ্রকাশ, শিল্প বা ইতিহাসচর্চা হুমকির মুখে পড়ছে। জীবনধারা থমকে যাচ্ছে। কোনো কিছু কারও পছন্দ না হলে বা নিজের মত ও নিজেদের ইতিহাসের ব্যাখ্যার সঙ্গে না মিললেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নানা সুযোগ তৈরি হওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একটি শিশুর আঁকা ছবিকে পর্যন্ত প্রতিপক্ষকে দমন বা হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

দেশ ও সমাজে যখন ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়, তখন তা মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। ঠিক-বেঠিকের বিচার-বিবেচনা নিয়ে একধরনের সংশয় তৈরি হয়। বরিশালের স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ করছি। প্রশ্ন তুলছি, তারা এ কাজ হতে দিল কীভাবে? কিন্তু সমাজে যে ভয়ের পরিস্থিতি ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, তা যে আইন ও নিয়মকানুন মেনে কাজ করার পরিস্থিতিকে নষ্ট করেছে, সেই দিক সম্ভবত আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি।

একদিকে ভয় অন্যদিকে চাটুকারিতা—এই পরিস্থিতি যেকোনো সমাজের জন্যই ধ্বংসাত্মক। এই ঘটনা কি আমাদের জন্য শিক্ষা হিসেবে কাজ করবে? সরকার ও সরকারি দল কি হয়রানিমূলক মামলায় উৎসাহ দেওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখবে? বিভিন্ন আইনের খড়্গ ঝুলিয়ে ও এর অপব্যবহার করে মুক্তচিন্তা বা স্বাধীন শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে, তা থেকে সরে আসবে?-প্রথম আলোর সৌজন্যে

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন