‘রাজনীতির প্রভু’ ও প্রশাসনের নৈতিকতা

  28-02-2018 03:56PM

পিএনএস ডেস্ক : রাজনীতিকেরা নিজেদের জনগণের সেবক বলে দাবি করেন। আর সেই সেবকের সেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দেন সরকারি প্রশাসনযন্ত্র, যাকে আমরা আমলাতন্ত্র বলে অভিহিত করি। কিন্তু রাজনীতি ও আমলাতন্ত্র প্রায়ই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে না। এ ব্যাপারে একে অপরের ওপর দোষ চাপালেও কেউ আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হন না।

আমরা যখন সমাজের কোনো অংশের নীতিনৈতিকতার ঘাটতি তথা অসততার উদাহরণ দিই (সেটি হতে পারে সাংবাদিক, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা কিংবা অন্য পেশার মানুষ), তখন তার চটজলদি উত্তর দেওয়া হয়, তাঁরা তো সমাজের বাইরের কেউ নন। আর যেহেতু সমাজ অসততা-অনাচারে আছে, সেহেতু ওই নির্দিষ্ট পেশার মানুষেরও দুর্নীতিমুক্ত থাকা সম্ভব নয়। এ ধরনের অপযুক্তি দিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্রের সব অন্যায়কে জায়েজ করা হয়।

যেমন সরকারের সমালোচনা করলে ক্ষমতাসীনেরা অতীতের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, তাদের আমলে আরও বেশি দুর্নীতি হতো (বর্তমানে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়। আমাদের নিচে আছে আফগানিস্তান। ওপরে ভুটান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও পাকিস্তান)।

গত রোববার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উদ্যোগে প্রশাসনে নৈতিকতার মানোন্নয়ন নিয়ে যে সংলাপ হলো, সেখানেও আলোচকেরা স্বীকার করেছেন, দেশের উন্নয়নকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিয়ে যেতে হলে প্রশাসনে সততা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ধরনের সংলাপে সাধারণত মন্ত্রী-সাংসদেরা হাজির থাকেন এবং অন্য বক্তারা দল ও ব্যক্তি-বন্দনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আলোচ্য সংলাপে সে রকম কেউ ছিলেন না বলে সবাই মন খুলে কথা বলেছেন।

সংলাপে উপস্থাপিত ধারণাপত্রেও স্বীকার করা হয়, ‘দুর্নীতির ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং উন্নয়নের সুফল সব জনগণের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে; অপরাধ দমনের জন্য নিয়োজিত ব্যক্তিদের অপরাধপ্রবণতা অন্যদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করছে। সমাজের বিভিন্ন অংশে অনৈতিক চর্চা বিস্তার লাভ করছে। অপরাধ ও অনৈতিকতার চর্চা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।’ দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানও স্বীকার করেছেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ঘাটতি আছে এবং বড় বড় দুর্নীতি ধরা কঠিন কাজ। রাষ্ট্রে সুশাসন আনতে হলে এই কঠিন কাজটাই তাঁকে করতে হবে।

প্রশাসনে সুশাসনের ঘাটতির নানা কারণ আছে। যোগ্য লোককে যোগ্য স্থানে না বসানো কিংবা অযোগ্য লোককে যোগ্য স্থানে বসানোর এন্তার মন্দ নজির আছে। আছে ভালো কাজ করে তিরস্কৃত এবং মন্দ কাজ করে পুরস্কৃত হওয়ার উদাহরণও। এমনকি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে অর্থের বিনিময়ে পদোন্নতি, ভালো পদায়নের কথাও সরকারি কর্মকর্তাদের কথায় উঠে এসেছে। তবে তাঁরা যে কথাটি জোর দিয়ে বলেননি বা বলতে সাহস পাননি, তা হলো প্রশাসনের ওপর রাজনীতির প্রভুদের (পলিটিক্যাল মাস্টার্স) অযাচিত হস্তক্ষেপ।

‘জনগণের সেবক’ রাজনীতিকেরা অনেক সময় সেটি মানতে চান না। জবরদস্তি করেন। যাঁরা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন, তাঁরা জানেন এই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কী ও কত প্রকার। বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা তারিক সালমনের ঘটনা নিয়ে শোরগোল উঠেছিল। তিনি সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ যাতে সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়, সে জন্য কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছিলেন। অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দিয়েছিলেন। এতে এলাকার রাজনীতির প্রভুরা ক্ষুব্ধ হন এবং মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁকে গরাদখানা পর্যন্ত নিয়ে যান। পরে ওপর মহলের হস্তক্ষেপে তারিক সালমনের হয়রানি বন্ধ হয়। কিন্তু তারিক সালমনের মতো যাঁরা রাজনীতির প্রভুদের চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না, তাঁরা মুখ বুজেই সব সহ্য করেন। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হন।

সুষ্ঠু ও সৎভাবে প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব আইন ও বিধি প্রয়োজন, তার প্রায় সবটাই আমাদের আছে। নতুন করে আইনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু যে সমস্যাটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো আইনের প্রয়োগ। প্রশাসনের কর্মকর্তারা যদি দেখেন আইনের প্রয়োগ করতে গেলে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন, তখন তো তাঁরা আইনবহির্ভূত পথেই হাঁটবেন। বেআইনি কাজে উৎসাহিত হবেন। যাঁরা ঢাকার সচিবালয়ে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের হয়তো তেমন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মুখোমুখি হতে হয় না। কিন্তু তারিক সালমনের মতো যাঁরা উপজেলা পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। স্থানীয় সাংসদের কথা শুনলে উপজেলা চেয়ারম্যান ক্ষুব্ধ হন। উপজেলা চেয়ারম্যানের কথামতো কাজ করলে দলের অন্য নেতারা বিরাগভাজন হন। আবার দলও নানা উপদলে বিভক্ত। এক নেতার কথা মানলে অন্য নেতা বিগড়ে যান।

একটি দেশের উন্নয়ন ও সুশাসনের জন্য আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, সরকার তাদের মাধ্যমেই নীতি-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে থাকে; দলীয় ক্যাডারদের মাধ্যমে নয়। কিন্তু সেই কাজটি সব সময় তাঁরা নির্বিঘ্নে করতে পারেন না। আবার অনেক সরকারি কর্মকর্তা ব্যক্তিগত সুবিধা পেতে রাজনীতির প্রভুদের সঙ্গে আপসের পথ বেছে নেন। বিষয়টা এমন যে ‘তুমিও খাও, আমিও খাই।’ প্রশাসনে ন্যূনতম নীতিনৈতিকতাবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হলে এই অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

ওই সভায় নাগরিক সমাজের এক প্রতিনিধি ভারতের একটি উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে একটি জেলা সদরে গেলে জেলা প্রশাসক তাঁর সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী আপনার জন্য সার্কিট হাউসের কক্ষ বরাদ্দ আছে। কিন্তু আপনি যেহেতু রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এসেছেন, সেহেতু আমার পক্ষে থাকা সম্ভব হবে না। তবে এখানে আপনার দেখাশোনার লোক থাকবে। এ কথা বলে জেলা প্রশাসক সার্কিট হাউস থেকে বের হয়ে যান।

বাংলাদেশে কী কখনো ভাবা যায়, দেশের প্রধানমন্ত্রী বা কোনো মন্ত্রী জেলা শহরে গেছেন আর জেলা প্রশাসক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর কর্মসূচিতে না থাকার কথাটি তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন। এ রকম হলে পরদিনই তাঁকে বিএনপি-জামায়াতের অনুসারী আখ্যা দিয়ে ওএসডি অথবা খাগড়াছড়ি বদলি করা হতো।

বাংলাদেশের মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে একজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রীরা জেলা শহরে গেলে তাঁদের সঙ্গে দলের ৫০ থেকে ১০০ লোক যান। আর জেলা প্রশাসককে তাঁদের সবার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। এত লোকের আপ্যায়ন তিনি করবেন কোত্থেকে? স্থানীয় সম্পদ তহবিল বা এলআর ফান্ড নামে একটি তহবিল করা হয়েছে, যা বেআইনি না হলেও অনৈতিক। এ বিষয়ে আমলাদের ওজর-আপত্তি থাকলেও মন্ত্রী-এমপিরা শোনেন না।

প্রশাসনের নীতিনৈতিকতা বিষয়ে আরেকটি চাক্ষুষ উদাহরণ দিই। গত সোমবার বিকেলে কারওয়ান বাজার থেকে আমরা উবারের গাড়িতে করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলায় যাচ্ছিলাম। আন্ডারপাস পার না হতেই একটি বাস এসে আমাদের গাড়িকে ধাক্কা দেয়।

পরে পুলিশ বাসটিকে আটক করে। উবারের চালক প্রতিকার চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করার পরামর্শ দেন। কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা যায়, বাসচালকের লাইসেন্সও হালনাগাদ ছিল না। আমরা বললাম, ক্ষতিপূরণ দিলে তো বাসচালক যে অন্যায় করলেন, তার বিচার তো হলো না। তাঁকে তো শাস্তি পেতে হবে।

জবাবে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ঢাকায় যাঁরা গাড়ি চালান, ৯০ শতাংশের লাইসেন্সই জাল বা মেয়াদোত্তীর্ণ। কেন? তাঁর জবাব, একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে ১০-১৫ হাজার টাকা উৎকোচ দিতে হয়। নবায়ন করতেও ৫ হাজার টাকা দিতে হয়।

পুলিশ কর্মকর্তার কথা শুনে মনে হলো আমাদের প্রশাসন নৈতিকতা থেকে এখনো শত মাইল দূরে আছে।

[সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]]

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন