মেয়ের বাবা

  18-05-2018 06:09PM

পিএনএস (মোস্তফা মামুন) : লিফট আছে এ রকম বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি দিয়ে ওঠাটা দ্বিগুণ কষ্টের। শারীরিক পরিশ্রমের সঙ্গে খিঁচড়ানো মেজাজও যোগ হয়। তার উপর যদি লিফটটা আটকে রাখা হয় ভিআইপির জন্য তাহলে কষ্টটা আরেক গুণ বেড়ে তিনগুণ হয়ে যায়।

আমি এখন এমন তিনগুণ কষ্ট নিয়ে সিঁড়ি ভাঙছি। কষ্টটাকে চারগুণ করে দিল সুজন। সিঁড়ির রেলিং ধরে আস্তে আস্তে এগোচ্ছি, এমন সময় কানের কাছে এসে বলল, ‘আনোয়ার ভাই, একটা গোপন কথা আছে।’
সুজনের সব সময় গোপন কিছু কথা থাকে। কিছু মানুষ আছে তারা কানে কানে না হলে, একা না পেলে কথা বলতে পারে না।

সুজন সেই শ্রেণীর। আর সেই গোপন কথাও এমন এলেবেলে ধরনের যে মাঝেমধ্যে মাথায় রক্ত চড়ে যায়। শোনা যায়, অ্যাকাউন্টসের বাবুল ভাই গোপন কথা শুনে ওকে একবারে টেবিলের রোলার নিয়ে মারতে গিয়েছিলেন। আমি সহিংস প্রকৃতির মানুষ নই, বিরক্তি প্রকাশের বেশি কিছু করতে পারি না, আর সুজন সেটাকে গায়েই মাখে না।

যার অনেক গোপন কথা থাকে এবং সেগুলো শোনানোর জন্য মনোযোগী স্রোতার দরকার হয়, তার অবশ্য বিরক্তি গায়ে মাখলে চলেও না।

কঠিন গলায় বললাম, ‘কী গোপন কথা?’
‘ফ্রি হবেন এখন?’

‘এখনই ফ্রি।’ দাঁড়িয়ে গেলাম দুই সিঁড়ির মাঝখানে।
সুজন একটু থতমত খেয়ে বলল, ‘না! মানে...এখন...এই সিঁড়ির মাঝখানে...।’

এটাও সুজনের একটা সমস্যা। গোপন কথাটা সঙ্গে সঙ্গে বলতে
রাজি নয়। লক্ষ করেছি, যারা এমন গোপন কথা বলতে চায় তারা সঙ্গে সঙ্গে সময় দিলে হকচকিয়ে যায়। কথা বলার জন্য ওদের ফ্রি টাইম
লাগে। সম্ভবত সময়টা সঙ্গে সঙ্গে দিলে কথাটাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না বলে মনে করে।

সুজন বলল, ‘না। লাঞ্চের পরই বরং আসি। ওই সময়টাতে তো আপনার কাজ একটু কম থাকে।’

‘লাঞ্চের পর আমি আজ বিশ্রাম নেব। শরীরটা ভালো লাগছে না।’
‘তাহলে অফিস শেষের পর। হাঁটতে হাঁটতে আপনাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম।’

বাসস্ট্যান্ড অফিস থেকে প্রায় আট-দশ মিনিটের হাঁটাপথ, তারপর ওখানে গিয়ে আরো মিনিট দশ-পনেরো অপেক্ষা করতে হয়, অতক্ষণ সঙ্গে থাকলে সুজন মাথায় আগুন ধরিয়ে দেবে। আত্মরক্ষার জন্য তাড়াতাড়ি বললাম, ‘না না। তুমি লাঞ্চের পরই এসো। ওই সময়ই কথা বলে নেব।’
টেবিলে এসে বসছি, পাশের চেয়ার থেকে রাব্বানি সাহেবের গলা শোনা যায়, ‘সুজনের পাল্লায় পড়েছিলেন দেখলাম।’

‘হ্যাঁ।’
‘গোপন কথা বলবে, না?’
‘এই তো!’

রাব্বানি সাহেব ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, ‘টোটাল নুইসেন্স। সবাইকে পাগল করে দিল!’

আমি কিছু না বলে কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করি। সুজনের ব্যাপারটা বিরক্তিকর, তাই বলে কারো তো কোনো ক্ষতি করছে না। কিছু কথা বলতে চায়। ব্যস, এই তো!

রাব্বানি সাহেব থামলেন না। বরং আমার সামনের চেয়ারে এসে কায়দা করে বসে বললেন, ‘একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন?’

‘কোন ব্যাপারটা যেন!’
‘এত দিনেও টের পাননি?’

আমি একটু বোকার মতো চেয়ে থেকে বললাম, ‘না তো!’
‘যারা সহজ-সরল তাদেরকে ধরে বেশি। আসলে ওর অন্য
উদ্দেশ্য আছে।’

‘কী উদ্দেশ্য?’
‘এই তো আপনার সঙ্গে খাতির করবে। তারপর একদিন আপনার বাসায় যাবে। তারপর...।’ রাব্বানি সাহেব হাসতে হাসতে রহস্যের ভঙ্গিতে বলেন, ‘তারপর কত কিছু করা যায়। টোটাল নুইসেন্স।’

রাব্বানি সাহেবের হাসিটাকেই বরং আমার টোটাল নুইসেন্স
মনে হলো।

ফাইলপত্র বের করে দেখা শুরু করলাম। পিয়ন আসিফকে ডেকে অকারণে একটা কড়া ধমক দিলাম। কিছু একটা খোঁজার ভান করে টেবিলের জিনিসপত্র ওলট-পালট করলাম। এ সবই রাব্বানি সাহেবকে উপেক্ষা করার জন্য।

রাব্বানি সাহেব তবু হাসেন। হাসতে হাসতে বলেন, ‘অভাজনের কথা বাসি হলে ফলে। দেখবেন!’

দেখার মতো কিছু অবশ্য পেলাম না। লাঞ্চের পর সুজন এসে টেবিলের সামনে বসল। তারপর ফিসফিস গলায় বলল, ‘ক্যান্টিনের দিকে গেলে একটু ভালো হয়। ওখানে নিরিবিলি আছে।’

‘এখানেই বলো না!’
সুজন এদিক-ওদিক তাকায়। রাব্বানি সাহেব কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কানটাও খাড়া। যদিও সুজনকে তিনি প্রশ্রয় দেন না কিন্তু খেয়াল করেছি গোপন কথা শোনার বিষয়ে তাঁর আগ্রহটাই সবচেয়ে বেশি।

রাব্বানি সাহেবের উপর বিরক্তিতেই কিনা উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘চলো। ক্যান্টিনেই যাই।’

সুজন লাফ দিয়ে দাঁড়াল। তারপর দ্রুতপায়ে হেঁটে চলল ক্যান্টিনের দিকে। ক্যান্টিনে গিয়েই হাঁক দিল, ‘এই আনোয়ার ভাইয়ের জন্য স্পেশাল চা। দুধ-চিনি কমিয়ে...।’

আমি তাড়া দিয়ে বললাম, ‘কী যেন বলবে বলেছিলে...’
‘বলছি। একটা সিগারেট ধরাই। বেয়াদবি নেবেন না তো?’
‘নেব। বেয়াদবি নেব। এই একটা জিনিস আমি সহ্য করতে পারি না।’
‘ও।’

‘কেন সিগারেট সহ্য করতে পারি না জানো?’
‘অনেকেই সহ্য করতে পারে না। ক্যান্সার হয়।’

‘ক্যান্সার যার হবে সে বুঝবে। আমি সহ্য করতে পারি না টাকার জন্য। দিনে কয়টা সিগারেট খাও?’

‘দশটা।’
‘কত যায়?’
‘এই তো পঞ্চাশ-ষাট টাকা।’

‘মানে মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। ভাবা যায়, তুমি পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছ দেড়-দুই হাজার টাকা! অথচ এই টাকায় নিজের কথা বাদ দাও, বাচ্চা-কাচ্চার জন্য কত কিছু করা যায়।’

এমন কোনো জ্ঞানী কথা না, সিগারেট যারা খায় তাদের এ রকম নানা হিসাব-নিকাশ প্রায়ই শুনতে হয়, তবু একটু যেন বিষণ্ন দেখায় সুজনকে।

উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলি, ‘বলো, তোমার ঘটনাটা বলো। আমার গিয়ে আবার কাজে বসতে হবে।’

‘আনোয়ার ভাই, আমার মেয়েটা না ওর গানের স্কুলে রবীন্দ্রসংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে।’

‘তাই নাকি! খুব ভালো। বয়স কত হলো ওর?’
‘৮ বছর ১ মাস ১১ দিন।’

আমি চমকে গেলাম। লজ্জাও পেলাম একটু। আমার ছোট মেয়ের বয়সও এ রকমই কিন্তু তাই বলে একেবারে দিন গুনে ওর বয়সটা তো এমন মুখস্থ করে বসে নেই। আজ বাসায় গিয়ে জানতে হবে। জেনে মনে রাখতে হবে।

সুজন একটু থেমে বলল, ‘খুব সুন্দর গান গায়। ওর স্কুলের মিস্ট্রেস বলেছেন, রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যার একটা ভাব নাকি আছে ওর মধ্যে। যদি ঠিকঠাক চর্চা চালিয়ে যায় তাহলে একদিন তাঁর মতোই বড়
গায়িকা হবে।’

‘খুব ভালো। উৎসাহ দিও সব সময়। গানের গলা হচ্ছে আল্লাহর দান, এ রকম সবার হয় না। আমার মেয়েদের অবশ্য ওসবে উৎসাহ নেই।’
সুজন একটু মনোযোগী হয়ে জানতে চায়, ‘ওদের উৎসাহ কীসে? মানে কী করতে পছন্দ করে?’

আবার বিপদ। ওরা স্কুলে যায়, পড়াশোনা করে, বেড়াতে যায় মায়ের সঙ্গে, রাতের টিভি সিরিয়াল দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আমার কাছে নানা আবদার করে, এই তো! আলাদাভাবে তো কিছু খেয়াল করিনি। না, আজ গিয়ে জানতে হবে। জেনে মনে রাখতে হবে।

একটু ভেবে বললাম, ‘ওদের সাজগোজে খুব উৎসাহ। ওরা খুব সুন্দর সাজতে পারে। অবশ্য এটা এমন কিছু গুণ না। সব মেয়েকেই তো...।’
সুজন বলল, ‘ভাই, এটাও একটা বড় গুণ। সবাই কি সাজতে
পারে? আমাদের এক ভাবির সংসারই ভেঙে গেল ঠিকমতো সাজতে পারে না বলে।’

‘বলছ কি!’
‘হ্যাঁ। সাজলে ওকে খুব বিশ্রী দেখাত। জামাই ওর প্রতি উৎসাহ হারিয়ে পরকীয়া প্রেমে লেগে গেল...।’

প্রসঙ্গটা ভালো লাগল না। তাড়া দিয়ে বললাম, ‘তোমার
গোপন কথাটা...’

সুজন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘না। আর তেমন কিছু না। পরে আবার বলব না হয়।’

বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তোমার মেয়ের এই স্কুলের গল্প বলার জন্য তো এত ভদ্রতা করার দরকার ছিল না। এমন খুশির খবর তো যে কোনো সময়ই বলা যায়।’

‘আরো কথা আছে। বাসায় আসব একদিন। ভাবির সঙ্গে পরিচিতও হব। মেয়েগুলোকে দেখে আসব।’

ফিরে টেবিলে বসতেই রাব্বানি সাহেব বললেন, ‘কী বলল?’
আমি উপেক্ষার স্বরে বললাম, ‘এই তো!’

‘সাবধান থাকবেন ভাই। অভাজনের কথা বাসি হলেও ফলে।’
বাসায় ফেরার পথে মনে হলো, আচ্ছা সুজন শেষে বাসায় আসবে বলল। ভাবির সঙ্গে পরিচিত হতে চায়। কেন? আর মেয়ের কথাই বা এমন গোপন করে বলার কী ছিল! একটু তো চিন্তার বিষয়।

আমার সমস্যা হলো সামান্য একটু চিন্তাও স্ত্রীর কাছে লুকাতে পারি না। আমার চেহারা দেখেই সে বুঝে ফেলে, কিছু একটা গোলমাল। এটা কি আমার একার সমস্যা নাকি সব স্বামীই স্ত্রীর কাছে এমন ধরা খেয়ে যায়! জানতে হবে। ঘরে ঢোকার দশ মিনিটের মাথায় লীনা বলল, ‘তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’

ওর কাছে কিছুই লুকানো যায় না বলে পুরো বিষয়টা বললাম। রাব্বানি সাহেবের সন্দেহ পর্যন্ত। সে হাসতে হাসতে বলল, ‘ব্যাপারটা তো সোজা।’
‘কী রকম?’
‘টাকা চায়।’
‘টাকা?’
‘হ্যাঁ।’

‘কই সে রকম তো কিছু বলল না!’
‘এক দিনে বলবে নাকি? আজ ক্ষেত্র তৈরি করে রাখল। দুই দিন পর তুমি জানতে চাইবে মেয়ের খবর কী? গান-টান শিখছে তো? তখন বিষণœ গলায় বলবে, আর গরিবের শখ! স্কুলের বেতন বাকি পড়ে আছে দুই
মাস। মেয়েটার গানের গলা এত ভালো! মিস্ট্রেস বলছিলেন, বন্যার মতো গলা। তখন তুমি ভবিষ্যতের রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যার জন্য কিছু টাকা বের করে দেবে।’

লীনা অনেক প্র্যাকটিক্যাল। সব কিছু এত যুক্তিপূর্ণ থাকে যে না মেনে উপায় নেই। ওর কথা মানলাম আর তাতে বুকের ওপর থেকে একটা চাপও সরে গেল যেন। তাহলে সুজনের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই! রাব্বানি সাহেব যে বলছিল, বাসায় এসে...। আমি স্বস্তি বোধ করি। টাকা দেয়া-না-দেয়া তো আমার হাতে। তাছাড়া দেয়ার মতো টাকা আসলে আমার কাছে থাকেও না বিশেষ।

দুই দিন বাদে একটা জরুরি কাগজ দেখছিলাম। একটা পার্টি সময়মতো মাল পায়নি বলে ক্ষতিপূরণ চেয়েছে, নইলে মামলা করবে, এমডি সাহেব নিজে ডেকে আমাকে বলেছেন একটা সেটেলমেন্টে যেতে।

ওদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যদি সমঝোতায় রাজি করানো যায়! সেই ফাইলে ব্যস্ত ছিলাম বলে খেয়াল করিনি রাব্বানি সাহেব কখন এসে সামনের চেয়ারে বসেছেন। বরাবরের মতো ব্যঙ্গের হাসির বদলে একটু যেন চিন্তিত ভঙ্গি। ভেবেছিলাম এই ফাইল নিয়ে কিছু বলবেন। এখানে ওঁর সেকশনের একটা গাফিলতি আছে বলে অফিসের অনেকের ধারণা।
চোখ তুলে জানতে চাইলাম, ‘কিছু বলবেন?’

‘আচ্ছা সুজন কি আপনাকে বলেছে যে ওর মেয়ে গানের স্কুলে
ফার্স্ট হয়েছে?’

‘হ্যাঁ। কেন বলুন তো?’
‘কত বড় ফ্রট চিন্তা করেন!’
‘মানে?’

‘আরে গানের স্কুলে রবীন্দ্রসংগীতে তো ফার্স্ট হয়েছে আমার মেয়ে।’
‘আপনার মেয়ে?’

‘আমার কাছ থেকে খবরটা শুনে এখন সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে ওর মেয়েই নাকি...বলুন। টোটাল নুইসেন্স। আচ্ছা আর কী বলল আপনাকে?’

‘আর তেমন কিছু না।’
‘কিছু শুনতে চায়নি?’

‘না। মানে...আমার মেয়েরা কী করে, কেমন এগুলো জানতে চেয়েছিল।’
‘আপনি কি বলেছেন আপনার মেয়েরা সাজতে পছন্দ করে?’
‘হ্যাঁ। বলেছিলাম।’

‘দেখেছেন কাণ্ড! অ্যাডমিনের শফিক সাহেবের বাসায় গিয়েছিল পরশু রাতে। সেখানে নাকি বলে এসেছে ওর মেয়ের সাজার খুব শখ। সাজার এত সব কায়দা জানে যে সে নাকি অবাক হয়ে গেছে। বলুন কাণ্ড!

একেকজনের কাছ থেকে কায়দা করে মেয়েদের গল্প শুনে তারপর সেটা আরেকজনের কাছে নিজের মেয়ের নামে চালিয়ে দেয়। টোটাল নুইসেন্স। ওর বিরুদ্ধে তো অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ব্যবস্থা নেয়া উচিত।’

আমি এত বিস্মিত হয়েছি যে বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। রাব্বানি সাহেব বললেন, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। একটা ব্যবস্থা নেব আমরা সবাই মিলে।’

ব্যবস্থা নেয়ার মতো অপরাধ হয়তো। হয়তো এর মাধ্যমে অফিস ডেকোরামের গুরুতর লঙ্ঘন হয়েছে কিন্তু আমি আসলে এসব নিয়ে ভাবছি না। আমি ভাবছি, কেন সুজন এ রকম করছে?

হঠাৎ কী ভেবে রাব্বানি সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা ও কি টাকা-পয়সা ধার নিয়েছে কারো কাছ থেকে? মানে, টাকা চেয়েছে!’

রাব্বানি সাহেব একটু ভেবে বললেন, ‘সে রকম ইনফরমেশন এখনো আমার কাছে নেই। তবে আমার ধারণা সেটা বের হবে। আরো বড় কোনো অপরাধও বের হতে পারে। গর্তে হাত দিলেই না সাপ বের হয়। এত দিন তো সেই গর্তে কেউ হাত দেয়নি। এখন সব ধরা পড়ছে।’
‘সুজন কি অফিসে আছে?’

‘না। ট্যুরে সিলেটে গেছে। ও ছিল না বলেই তো খবরটা বেরিয়ে পড়ল। থাকলে তো এমন কায়দা করে রাখে যে কথা এদিক-ওদিক হতে দেয় না। আজ কথায় কথায় শফিক সাহেব যখন বললেন ওঁর বাসায় সুজন গিয়েছিল তখনই না বিষয়টা বের হলো।’

খবর আরো বেরোল। বেরোতেই থাকল। দেখা গেল সুজন শুধু তাদের কাছেই গোপন কথা বলে যাদের মেয়ে আছে। এবং সত্যিই একজনের কাছে শোনা গল্প আরেকজনের কাছে নিজের মেয়ের নামে চালিয়ে দেয়।

অফিস সহকারী জুবেদের মেয়ের লম্বা চুলের গল্প শুনে গিয়ে আরেকজনকে বলেছে, আমার মেয়ের চুল খুব লম্বা। আট বছর বয়সী মেয়ের এই চুল দেখে নাকি ওর স্কুলের স্যার বলেছেন, মা তুমি তো বড় হলে মহারানি হবে। মেয়ে এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছে, বাবা লম্বা চুল থাকলে কি মহারানি হওয়া যায়? আরেকজনের মেয়ে হয়তো অসুস্থ।

সেটাকেই নিজের মেয়ের অসুস্থতার খবর বানিয়ে ছুটি-ছাঁটাও নাকি নিয়েছে। সবাই একমত হলো, সুজন একটা প্রতারক। আমাদের কারো বা কারো মেয়ের কোনো ক্ষতি সে করেনি কিন্তু করার গভীর মতলব যে আছে সেই বিষয়ে কারো সন্দেহ নেই। রাব্বানি সাহেব আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘কী আনোয়ার ভাই, বলেছিলাম না অভাজনের কথা বাসি হলে ফলে!’

আমি চুপ করে থাকলাম। সুজন অপরাধী প্রমাণিত হয়েছে বলে নয়, বিষয়টা মেলাতে পারছি না বলে।

ওর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় তা-ই নিয়ে অনেক আলোচনার পর শেষে সিদ্ধান্ত হলো, সুজন ফেরার পরের ছুটির দিনেই আমরা সবাই হাজির হব ওর বাসায়।

তারপর হাতেনাতে ধরে ওর উদ্দেশ্য বের করতে হবে। ক্যাশিয়ার আবুল সাহেব অবশ্য বললেন, ‘এতে ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে একটা। এ রকম লোকের পেছনে বড় কোনো শক্তি থাকে। বাসায় গেলে আমাদের লাইফ থ্রেট হতে পারে।’

আবুল সাহেবের বয়স একাত্তর। কিন্তু সব সময় তিনি লাইফ থ্রেট নিয়ে চিন্তিত থাকেন।

রাব্বানি সাহেব বললেন, ‘আরে রাখেন আপনার লাইফ থ্রেট। আমরা আট-দশজন লোক। আর আমাদের লাইফ থ্রেট দেবে ওই পুঁচকে বদমাশ! বয়স পঞ্চাশ পেরোতে পারে কিন্তু এখনো এক ঘুসি দিলে আরেকটার জায়গা থাকবে না।’

রাব্বানি সাহেবের ঘুসির ভরসায় দ্বিধা দূর করে সবাই রাজি। গুরুদায়িত্বটা পড়ল আমার উপর। আমি কখনো ওকে সন্দেহ করিনি, বাজে কথা বলিনি, কাজেই আমার উপর ওর বিশ্বাস সবচেয়ে বেশি। সেই বিশ্বাস কাজে লাগিয়ে আগামী শুক্রবার ওর বাসায় যাওয়ার একটা সময় ঠিক করতে হবে।

জনদাবির মুখে আমি আপত্তি করতে পারলাম না। রাব্বানি সাহেব বললেন, ‘ফোন লাগান।’

‘এখনই? ফিরুক না হয়। কালই তো ফিরবে।’
‘না, এখনই। ফোন করে বলুন, পরশু শুক্রবার দুপুরে আমরা ওর মেয়ে দেখতে বাসায় যাব।’

শফিক সাহেব বললেন, ‘না না। এভাবে বললে সন্দেহ করবে। আনোয়ার সাহেব বরং বলুক উনি একা যাবেন। ওনার মেয়েদের নিয়ে। ও যেন বাসায় থাকে।’

এটাই বেশি যুক্তির কথা। রাব্বানি সাহেব আমার ফোন থেকে ওর নাম্বারটা বের করে রিং করে স্পিকার অন করে দিলেন। একটা রিং হতেই সুজন ফোন ধরে বলল, ‘জি আনোয়ার ভাই।’

‘সুজন, তুমি কালকে ফিরছ কখন?’
‘রাত হয়ে যাবে। কোনো দরকার? বাসায় আসব?’

‘না না। পরশু সকালবেলা তোমার কাজ কী?’
‘তেমন কোনো কাজ নেই। বাসায় আসব?’

রাব্বানি সাহেব ফিসফিস করে বললেন, ‘দেখলেন শুধু বাসায়
আসতে চায়!’

সবাই নীরবে একমত, এই বাসা-বাসা করার পেছনে উদ্দেশ্য আছে। গভীর। সর্বনাশা। ভয়ঙ্কর।

আমি একটু থেমে বললাম, ‘না। তুমি বাসায় থেকো। আমি আসব।’
‘ও।’ একটু যেন হতাশ শোনায় সুজনের গলা।

‘ঠিক আছে তাহলে। পরশু সকালে দেখা হবে।’
‘মেয়েদের নিয়ে আসবেন নাকি আনোয়ার ভাই? ছুটির দিন তো, ওরা আসলে ভালোই হবে।’

‘আচ্ছা দেখি। তুমি বাসায় থেকো।’
‘জি।আসামুআলাইকুম।’

ফোন কাটতেই রাব্বানি সাহেব বললেন, ‘দেখলেন তো মেয়েদের চায়। আমার ধারণা আন্তর্জাতিক মেয়ে পাচারকারী দলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ আছে।’

আবুল সাহেব বলেন, ‘এ জন্যই তো বলছিলাম লাইফ থ্রেটের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে।’

মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হবে কি না তাই নিয়েও কিছু আলোচনা হলো। কেউ কেউ এর পক্ষে ছিলেন, যাতে দেখিয়ে দেয়া যাবে ওর মেয়ের
চেয়ে আমাদের মেয়েরা কত গুণবতী কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঝুঁকি না নেয়ার পক্ষেই মত এলো। লাইফ থ্রেটের মতো ভীতিকর না হোক সুজন তো সন্দেহজনক। আর সন্দেহজনক মানেই ভীতিকর। কিছু একটা গোপন শক্তি ওর থাকতেও পারে।

দরজা খুলে আমাকে দেখে সুজন যতটা উল্লসিত হয়েছিল বাকিদের দেখে ততটাই চমকে গেল।

রাব্বানি সাহেব জঙ্গি ভঙ্গিতে ঢুকেই বললেন, ‘তোমার সর্বগুণে গুণান্বিতা মেয়ে কোথায়? ডাকো তাকে।’

তিনি পুলিশের মতো ঘর তল্লাশি করতে থাকলেন। বাকিরাও সঙ্গী হয়ে গেল। এ রকম সম্ভাব্য মেয়ে পাচারকারীর ঘরে তো সন্দেহজনক অনেক কিছুই থাকার কথা।

কিন্তু ঘরটা খুব সাদামাটা। একটা মাত্র রুম, লাগোয়া রান্নাঘর আর এক চিলতে বারান্দা।

সুজন বলল, ‘আসলে আমি তো জানতাম না যে সবাই আসবেন। কোথায় যে বসতে দেই!’

রাব্বানি সাহেব পাত্তা না দিয়ে বললেন, ‘মেয়ে কোথায়?’
সুজন বলল, ‘ওর মায়ের সঙ্গে একটু বাইরে গেছে। আসবে।

একটু কেনাকাটা করতে গেছে। আনোয়ার ভাই আসবেন জেনে আমি
না করেছিলাম, কিন্তু মেয়েটা বলল, বাবা আংকেলকে তো দুপুরে
খাওয়াতে হবে।’

আমার কেন যেন ঠিক ওর কথা বিশ্বাস হয় না। মেয়ে থাকলে, স্ত্রী থাকলে ঘরে মেয়েলি ছাপ থাকত। আর ওর এত প্রিয় মেয়ের খেলনা কোথায়? কাপড়-চোপড়ই বা আলনায় টানানো নেই কেন?

রাব্বানি সাহেব বললেন, ‘সুজন শোনো, আর মামদোবাজি করো না। তুমি ধরা পড়ে গেছ।’

‘জি!’
‘হ্যাঁ। তুমি যে একটা প্রতারক সেটা আমরা ধরে ফেলেছি। এখন সব স্বীকার করে ফেলো।’

আবুল সাহেব বললেন, ‘নইলে তোমার লাইফ থ্রেট। আমরা
অ্যাকশনে যাব।’

সুজন বলল, ‘আমার আসলে বলার কিছু নেই।’
‘তুমি মিথ্যা কথা বললে কেন? কেন আমাদের সঙ্গে প্রতারণা
করলে! একজনের মেয়ের গল্প শুনে নিজের নামে চালাও কেন? তোমার মেয়েই বা কোথায়?’

‘আছে।’
শফিক সাহেবও এতক্ষণে খেয়াল করেছেন ঘরে মেয়ের থাকার কোনো চিহ্ন নেই। বললেন, ‘তুমি বলছ মেয়ে বাইরে গেছে। কিন্তু মেয়ে আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। ঘরে কোনো কাপড়-চোপড়ও তো নেই।’
রাব্বানি সাহেব বললেন, ‘মিথ্যুক। প্রতারক। টোটাল নুইসেন্স।’
এই সময়ই হঠাৎ কলিং বেল।

সুজন বলল, ‘এই যে ওরা এসেছে বোধহয়।’
আমরা চমকে গেলাম।

রাব্বানি সাহেব বললেন, ‘চিন্তার কিছু নেই। মেয়ে আসলে হবে কী? আমাদের সঙ্গে তো মিথ্যা বলেছে। এটা তো ঠিক আছে।’

দরজা খুলে বছর ত্রিশের এক মহিলার সঙ্গে ঢুকল ফুটফুটে একটি মেয়ে। দৌড়ে এসে সুজনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ‘বাবা।’

সঙ্গে সঙ্গেই সুজনের চোখ গড়িয়ে যে জলের ধারা বইতে শুরু করল সেটা দেখে আমি চোখ ফেরালাম। এই কান্না দেখা যায় না।

ভদ্রমহিলা আমাদের দেখে একটু অপ্রস্তুত যেন। বললেন, ‘সুজন,
এরা কারা?’

সুজন বলল, ‘আমার অফিসের কলিগ সবাই।’

‘কিন্তু তুমি না বলেছিলে একজন মাত্র। আমি তো রান্না করেছি...’
সুজন বলল, ‘অসুবিধা নেই ভাবি। খাবার আনিয়ে নেব। সবাই তো অফিসের কলিগ।’

ভাবি! আবার ধাক্কা। আমরা তো ভেবে বসেছিলাম ওর স্ত্রী। ইনি ভাবি, সঙ্গের মেয়েটি সুজনকে ডাকছে বাবা। আবার প্যাঁচ খেয়ে যায়।
রাব্বানি সাহেব এখনো কঠোরই আছেন। চোখের পানিতে গলে না গিয়ে কড়া গলায় মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি কি ওর ভাবি?’
‘জি।’

‘ওর স্ত্রী কোথায়?’
মহিলা মাথা নিচু করে থাকেন।
‘উত্তর দিন। আর এই মেয়েটি কে?’

আলাদা কোনো ঘর নেই, মহিলা তাই এগিয়ে এসে রাব্বানি সাহেবের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন এক চিলতে বারান্দায়। কী যেন কথা চলল কিছুক্ষণ। আমরা অধীর। সুজনের কোলে মেয়েটি। চোখে পানি। এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কী হচ্ছে।

রাব্বানি সাহেবের গলা শুরুতে খুব চড়া ছিল। এখন আর ঠিক শোনা যাচ্ছে না।

মিনিট পাঁচেক পর রাব্বানি সাহেব বেরিয়ে এসে আমাদের অবাক করে সুজনের হাত ধরে বললেন, ‘সুজন আমাকে মাফ করো। ভুল হয়ে গেছে ভাই...’ বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

আমরা এখনো ঠিক ধরতে পারছি না।
আবুল সাহেব শুধু বললেন, ‘তাহলে আর লাইফ থ্রেট নেই।
কী বলেন!’

সুজন উঠে দাঁড়ায় আস্তে আস্তে। তারপর উবু হয়ে বিছানার নিচ থেকে একটা ট্রাংক বের করে। সেই ট্রাংকে বাচ্চাদের অনেক খেলনার ভিড়
থেকে বেরিয়ে আসে মলিন একটা ছবি। একেবারে নবজাতক। এক মহিলার পাশে শুয়ে।

রাব্বানি সাহেব বললেন, ‘সুজন দেখাতে হবে না। দেখাতে হবে না। সহ্য করতে পারব না। আমাদের মাফ করে দাও।’

সুজন ছবিটা বের করে গভীর আগ্রহে নিজের শার্টের হাতা দিয়ে ধুলো মোছে। তারপর বলে, ‘এই যে আমার স্ত্রীর পাশে শ্রাবণী। শ্রাবণ মাসে জন্ম হয়েছিল তো!’

মহিলাটি এগিয়ে এসে সুজনকে ধরেন। টেনে বসান। তারপর বলেন, ‘শ্রাবণ মাসেই মৃত্যু। জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। তারপর...। এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ওর স্ত্রীও...।’

রাব্বানি সাহেব চিৎকার করলেন, ‘আর বলতে হবে না।’
মহিলা থামলেন না, ‘সুজন ভেঙে পড়েছিল। পাগলই ছিল প্রায় দুই বছর। তারপর অনেক কষ্টে জীবনে ফিরিয়েছি আমরা। ওই বয়সী আমাদের পরিবারের যত মেয়ে আছে সবাই ওকে বাবা ডাকে।

এই যে দেখলেন না আমার মেয়ে, মানে ওর ভাতিজির কাছেও সে বাবা। আর সুজন নিজেদের চেনা-জানাদের সবার ওই বয়সী মেয়েদের মনে করে নিজের মেয়ে। তাই ওদের কারো কোনো কৃতিত্ব, কোনো দুষ্টুমি সব কিছুকেই সে নিজের মেয়ে শ্রাবণীর পাশে বসিয়ে বেঁচে আছে।

তাই আপনাদের মেয়েরাও হয়ে গেছে ওর মেয়ে। ওদের রবীন্দ্রসংগীত, ওদের পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া সব সুজনের কাছে শ্রাবণীর কৃতিত্ব।’
বড় লজ্জা লাগল। আমাদের সবার মেয়ে আছে তবু আমাদেরকে পেছনে ফেলে সবার উপরে দাঁড়িয়ে আছে এমন একজন, যার মেয়ে নেই। মেয়ে নেই তবু সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মেয়ের বাবা।

[লেখক : সাংবাদিক ও শিশু সাহিত্যিক, উপ-সম্পাদক দৈনিক কালের কণ্ঠ, https://www.facebook.com/মোস্তফা-মামুন-৫৯৫-1420913671481540/ থেকে নেয়া]

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন