করোনার দুটি কুসন্তান

  09-04-2020 08:36PM

পিএনএস (হেলাল মহিউদ্দীন) : জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দারুণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কারণ, করোনা ঘরে ঘরে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা বেশুমার ও বেসামাল করে তুলছে। কপালে গভীর চিন্তার রেখা ফুটিয়ে তিনি জানালেন যে করোনার দুঃসময়ে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ থেকে পারিবারিক সহিংসতার খবর আসছে। ঘরের খবর পরে কি আর তেমন জানে? পরিবারের চরিত্রই এমন যে অন্দরমহলের অধিকাংশ খবর অন্দরমহলেই মিলিয়ে যায়। ‘সেইফ হরাইজন’ নামের একটি এনজিও সহিংসতার শিকার নারীদের সহায়তা দিয়ে থাকে। সংস্থাটি জানিয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সহিংসতার শিকার নারীদের হেল্পলাইনে ফোন করার জন্য ফোনের কাছেই যেতে দেওয়া হয় না। সেলফোন কেড়ে রাখা হয়, বা ব্যাটারিহীন করে রাখা হয়। তবু যেটুকু বাইরে আসছে, তাতে শঙ্কিত না হওয়ার উপায় নেই।

৩ এপ্রিল গার্ডিয়ান পত্রিকা সমাজকর্মীদের ভাষ্যে জানিয়েছে যে ফেব্রুয়ারিতে চীনের উহানে এক পুলিশ স্টেশন রিপোর্ট করেছিল, গৃহে অন্তরীণ থাকার সময়ে পারিবারিক সহিংসতা অন্য স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় তিন গুণ বেড়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে মার্চ মাসে প্রতি চারজন নারীর একজন পুরুষ সঙ্গীর হাতে এবং প্রতি সাতজন পুরুষের একজন নারী সঙ্গীর দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। হেল্পলাইনে এক নারী তাঁকে উদ্ধার করে নেওয়ার আর্তি জানিয়েছেন। কারণ, তাঁর কাশি হচ্ছিল, কিন্তু পুরুষ সঙ্গীর খুবই বিশ্বাসযোগ্য হুমকি এই যে আর একবার কাশি দিলে তাঁকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে। এক নারীর ঘুম ভেঙেছিল খানিকটা জ্বর নিয়ে। পুরুষ সঙ্গী সন্তানটিকে কাছে রেখে নারীটিকে ঘরের বাইরে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে এসে সেই যে ঘর বন্ধ করে দিয়েছিলেন আর খোলেননি।


এদিকে ইউরোপে ঘরবন্দী মানুষ আত্মহত্যা করতে শুরু করছে। প্রথম প্রথম বন্ধ ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গিটার-ব্যাঞ্জো, থালাবাসন পিটিয়ে নিজেদের মনোবল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গেয়েছে একজন আরেকজনের জন্য প্রবোধ হওয়ার প্রয়োজনে। কিন্তু কত দিন? ফোন ক্যামেরায় তোলা বেশ কিছু ভিডিওতে দেখা গেল উঁচু দালানের ছাদ থেকে রাস্তায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করছেন কেউ কেউ। ধনী দেশগুলোয় অসংখ্য মানুষ মূলত একা। অনেকের স্থায়ী যৌনসঙ্গীও নেই। তাঁদের সমাজ সম্পূর্ণ নির্ভরশীল কর্মক্ষেত্র, নাইট-লাইফ, ক্লাব-বার, জিম, পানশালা, দূরে ঘুরতে যাওয়া, ঘোরাঘুরি, নাটক-সিনেমা ও শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডের ওপর। ঘর অনেকের জন্যই শুধুই নিদ্রাস্থান। তাই ঘরে আটকে থাকা অনেকের জন্যই বিনা অপরাধে হাজতবাসের মতো ঠেকছে। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য।

পারিবারিক সহিংসতা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় যেন করোনার দুই কুসন্তান। দুটি আবার সম্পর্কিতও। পুঁজিবাদী সমাজের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার গভীর সংকট এই দুটি রূপে ধরা দিচ্ছে এই সময়ে। সমাজবিজ্ঞানী দুর্খেইমের ‘অ্যানোমি’ বা ‘নৈরাজ্যিক জীবনবোধ’—জীবনযাপন ও পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সম্পর্কহীনতা, এবং বেঁচে থাকাকে অর্থহীন ও অগুরুত্বপূর্ণ ভাবার মতো অনুভূতিবোধ করোনায় মৃত্যুর সমান্তরালে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ফলাফল আত্মহনন, যেমনটি দুর্খেইমও বলে গিয়েছিলেন।

মার্ক্সীয় নারীবাদী ভাবনার মানুষেরা সব সময়ই বিশ্বাস করেন, ঘর থেকেই নারীর বিরুদ্ধে প্রথম সহিংসতার সূচনা হয়। সেটিই ছড়িয়ে পড়ে বাইরে; সমাজের বিস্তীর্ণ প্রান্তে। আরেকটি তাত্ত্বিক ধারণাও বাজারে চালু যে ‘ক্ষমতা-সম্পর্ক’ই সহিংসতা কেমন হবে বলে দেয়। মোটাদাগে সমাজ এখনো পুরুষবাদী। পুরুষের শারীরিক এবং সমাজ-রাজনৈতিক ক্ষমতাও প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই নারীর তুলনায় বেশি। ফলে তাঁদেরই নিবর্তক হয়ে ওঠার ঝোঁক ও ঝুঁকি বেশি থাকবে। তাঁদের ঘরবন্দিত্ব এ কারণে ক্ষমতা অপব্যবহারের ক্ষেত্র হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়।

অক্সফামের ২৫ মার্চের রিপোর্টে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে যে ‘ঘর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় ও নির্ভরতার জায়গা’—এ রকম পূর্বানুমানে ভর করেই সরকারগুলো ‘গৃহে অন্তরীণ’ (হোম কোয়ারেন্টিন) ব্যবস্থাকেই মূল সমাধান ভেবে বসে আছে। ধারণাটি সঠিক নয়। ‘পরিবার’ ধারণাটিকে সরকারগুলো শুধুই মূল্যবোধের মানদণ্ডে বিবেচনা করেছে। অথচ তাদের বোঝা উচিত ছিল অকস্মাৎ ট্রাম-টিউব ও হাট-বাজারের ভিড় ঠেলা একটি বহির্মুখী সমাজ হুট করে ঘরের চার দেয়ালের ভেতর নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবে না। দু-এক দিন পারলেও দিনের পর দিন মাসের পর মাস থাকলে বন্দিদশাবোধের গভীর হতাশা ও বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত হবে। হতাশা ও বিষণ্নতার আঘাত কাটানোর জন্য হাতের সহজ নাগালে পাওয়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল মানুষটিকেই শিকার বানাবে। স্বভাবতই নারী ও শিশুরাই হবে প্রথম শিকার।

পত্রপত্রিকাও সামাজিক মাধ্যমে শিশু নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার যে চিত্র মিলছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে ঘরের বাইরের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ভাবনাও মাথায় রাখা দরকার ছিল সরকারগুলোর। হোটেল-মোটেল এবং বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি সেন্টারের মতো স্থাপনাগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা গেলে প্রাতিষ্ঠানিক মানসিক চিকিৎসাসেবা দেওয়াও সম্ভব হতো। সরকারি কড়াকড়ির কারণে এই সময়ে বাইরের সমাজ সম্পর্ক নানারূপে ও ভঙ্গিতে ঘরের ভেতরে এসে পড়েছে। এ অবস্থাটি নতুন। ফলে প্রতিক্রিয়ার ধরনও নতুন। ফলে আগাম প্রস্তুতি না নেওয়ার দায়ে সরকারগুলোকে দোষারোপ করারও সুযোগ কম। তবে এবারের করোনার আঘাত থেকে শিক্ষণীয় এই যে ভবিষ্যতে অনুরূপ বিপজ্জনক জীবাণু আক্রমণের কালে সামাজিক ব্যাধি নিরাময়ের সমান প্রস্তুতিও নিতে হবে।

সাধারণ্যে একটি ধারণা তৈরি হচ্ছে, যে কর্মজীবী মধ্যবিত্তের ঘরে বসে থাকার অসহনীয় একঘেয়েমি থেকে খিটিমিটি সমস্যা বাড়ছে। খিটিমিটি থেকে সম্পর্কনাশ। সেটি থেকে শারীরিক আঘাত। ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্ব। একঘেয়েমি একটি কারণ বটে, কিন্তু মূল কারণ সম্ভবত নয়। কারণ, আধুনিক মধ্যবিত্তের ঘরে সময় কাটানোর উপাদানের অভাব নেই। সেলফোন, কম্পিউটার গেম, হোম থিয়েটার, রোবট অনেক মাধ্যমই আছে। টিকে থাকার সম্ভাবনা-অসম্ভাবনার দুর্ভাবনা থেকে নিম্ন আয়ের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হচ্ছে। ঠিক একই অবস্থা এখন মধ্যবিত্তেরও।

ধনী দেশগুলোর শ্রমবাজারে শ্রম বেচতে সক্ষম মধ্যবিত্তদের তিন ভাগের দুই ভাগই অস্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিক। ভবিষ্যতের জীবন-জীবিকা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ঝুঁকিতে তাদের এবারের মতো করে আগে কখনো পড়তে হয়নি। তিরিশের মন্দা যা তারা দেখেনি, সে রকম একটি মন্দার আগাম পূর্বাভাস দিচ্ছে পত্রিকাগুলো। সরকারগুলো এবং বিশ্ব মিডিয়া যেভাবে লাশ গুনে চলেছে, সেই তুলনায় আশার বাণী শোনানোর কিংবা আশা-ভরসা জোগানোর কোনো চেষ্টা এখনো দৃশ্যমান নয়। ভবিষ্যতের জন্য করোনার আরেক শিক্ষা এই যে অনাক্রান্তদের বিপজ্জনক মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার জন্য আগাম প্রস্তুতি এবং সর্বাত্মক মানসিক সেবা-সহায়তাকে অত্যাবশ্যক কর্মসূচি হিসেবে প্রয়োগের আওতায় আনতে হবে।

নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে সংখ্যায়, করোনার মতোই, নিত্যনতুন ধরনে ও মাত্রায়। সে জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস অত্যন্ত জোরগলায় বলেছেন, এটি মারাত্মক দুশ্চিন্তার বিষয়। নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতার ধরন নির্দেশে তাঁর ব্যবহৃত শব্দমালার বিশেষণটিও ছিল ‘হরিফাইং গ্লোবাল সার্জ’ বা ‘মারাত্মক ভীতি-জাগানিয়া বৈশ্বিক প্লাবন’। ধরন-ধারণে সহিংসতাগুলো এক নতুন যুদ্ধের রূপে হাজির। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য তিনি তাই দুটি যুদ্ধক্ষেত্রে ‘সিজফায়ার’ বা যুদ্ধবিরতির আকুল আবেদন জানালেন। একটি যুদ্ধক্ষেত্র ঘরের বাইরে অস্ত্র-কামান-বন্দুক মিসাইলের রণাঙ্গান। আরেকটি ঘরের ভেতরের যুদ্ধক্ষেত্র।

করোনার এই দুই কুসন্তানের ব্যাপক সংক্রমণ এখনো শুরু না হলেও অচিরেই যে তারা বিশ্বময় ভয়াবহ সামাজিক দুর্যোগের কারণ হয়ে উঠবে, সেসব নমুনা এখন স্পষ্ট। বাংলাদেশসহ সব রাষ্ট্রেরই অত্যাসন্ন দুর্যোগটি মোকাবিলার যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া আবশ্যক।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন