‘চাই নির্দিষ্ট পরিকল্পনা, সততা ও সঠিক বাস্তবায়ন’

  02-05-2020 04:31PM

পিএনএস (ডা. আব্দুন নূর তূষার): আমরা সবাই ভয় পাচ্ছি। কেন? কারণ, আমরা বেঁচে থাকি প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে। নিজেরা যেমন বাঁচতে চাই, চাই আমাদের প্রিয় মানুষেরাও বেঁচে থাকুক। এই ভয়টা তাই স্বাভাবিক। আতঙ্ক আমাদের স্থবির করে, ভয় আমাদের সচল করে। তাই আমি মনে করি, ভয় পাওয়াই উচিত।

প্রতিদিন আমি আগে আমার ফেসবুক বন্ধুদের জন্মদিনে শুভ জন্মদিন লিখতাম। গত কিছুদিন শুভেচ্ছা পাঠাই না। মনে হয় যাকে লিখবো সে যদি না থাকে আর কিছুদিন পরে। আজ মনে হলো এটাই ভুল। যতক্ষন বেঁচে আছি , ততক্ষন জীবনকে উদযাপন করতে হবে বেঁচে থাকার মধ্যেই। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দর জীবনটার জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে স্রষ্টাকে। এ জীবন না পেলে কি করে বুঝতাম প্রিয়জনের সান্নিধ্যে শুধু বেঁচে থাকাটাও এক উপহার।

ডাক্তারদের সুরক্ষা নিয়ে কথা বলেছিলাম এই কারণে যে, ডাক্তার সুস্থ থাকলে মানুষ বাঁচবে বেশি। সেই মানুষেদের মধ্যেই তো আমার আপনার প্রিয়জন আছেন, থাকবেন।

অনেকে আক্রমন করেছে। দুঃখ পাইনি, দমেও যাইনি। কারণ, আমি তো জানি আমি কেন বলছি, কি করছি।

যখন আমার প্রিয়র চেয়েও প্রিয়জনেরা কোয়ারেন্টিনে গেছে, বলেছে, তুষার আমার দুটো বাচ্চা। আমার যদি ভাইরাল অ্যাটাক হয়? এ অবস্থায় নিজেও ভয় পেয়েছি, কিন্তু সাহস দিয়েছি।

আমার পুলিশে কাজ করা ছোট ভাইটা , আমার ডাক্তার ছোটভাইটা যখন বলে, তুষার ভাই নিজেকে নিয়ে ভাবি না, কিন্তু আমার বউটাকে কোন সময় দেই নাই, বাচ্চারা খুব ছোট। ওরা বেঁচে থাকলেই চলবে। মাফ করে দিয়েন। পারলে বাচ্চাদের খোঁজ নিয়েন। তখন আমি শক্ত দেয়াল হয়ে কথা বলতে থাকি।

আমি টেলিফোনে কথা বলেই যাই, ফেসবুকের চ্যাট বক্সে আশার কথা লিখতে থাকি। আমার চোখ জানে কেন পৃথিবী ঝাপসা হয়ে আসে।

বাংলাদেশে তরুণ বেশি। এটা একধরনের সুবিধা। তরুণদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি । শক্তি বেশি। কিন্তু যখন সিটি ব্যাংকের তরুণ কর্মকর্তা, দুদকের তরুণ কর্মকর্তা, পুলিশের তরুণ সদস্য চলে গেছেন দেখি তখন মনে হয় কেউ নিরাপদ না। যখন ডা. মঈন চলে গেলেন, তখন মনে হয়েছে চিকিৎসাবিদ্যাও কিছু না।

যখন বাবা মায়ের মৃত্যুর পরে তার কাছে না থাকতে পেরে, সন্তানের হাহাকার দেখি তখন এই মানবজন্মকে শাস্তি বলে মনে হয়।

তরুণরা কি চায় তাদের মাথার ওপরে স্নেহময়, মমতাময়, অভিজ্ঞতার হাতের স্পর্শ চলে যাক? আমরা কি চাই আমাদের মুরুব্বিরা আক্রান্ত হয়ে বিরাট সংখ্যায় আমাদের ছেড়ে চলে যান?

চায় না। তাই চোখের সামনে পরিসংখ্যান দেখেও মনে মনে সেটা অস্বীকার করতে চাই। এমন পৃথিবীতেকে বেঁচে থাকতে চায় যে পৃথিবীর বয়স্করা ভাইরাসের আক্রমনে টিকে থাকতে পারছেন না। এমন পৃথিবীকে চায় যে পৃথিবীতে মাথায় হাত রাখার মানুষ নাই, পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানানোর মানুষ নাই।

আমরা টিকা খুঁজি। আমরা ওষুধ খুঁজি। কবে পাবো জানি না, তবু আশায় বিশ্বাসে বুক বাঁধি। স্রষ্টা আমাদেরই কেবল মেধা দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর শক্তি দিয়েছেন। আমরা পারবোই।

আর যদি না পারি? যদি এর চেয়েও বড় কোন ভাইরাস আসে! এটা তো আমাদের তিন সপ্তাহ সময় দিচ্ছে। যদি এর পরেরটা দুদিনও না দেয়?

মানুষ তার সকল শ্রেষ্ঠত্বের মধ্যেও একটা জায়গায় বড় বেশি দুর্বল। মানুষ ভালোবাসা চায়, মানুষ মৃত্যুর পরেও চায় তার জন্য প্রিয়জনেরা আসুক। তার জন্য কাঁদুক। তাকে নিয়ে দুটো ভাল কথা বলুক। মৃত্যুর পরে কেউ মাটিতে চলে যায়, কেউ ছাই হয়ে যায়। তার আর কিছুতেই কিছু আসে যায় না।

তারপরেও জানাজা আর শেষকৃত্যের ছবি দেখে সে কাতর হয়। এমন জানাজা, এমন বিদায় সে চায় না। সে চায় তাকে ঘিরে থাকুক তার প্রিয় মুখগুলো। তাই একটি জীবনও যদি বেশী বাঁচানো যায়, সেটাই করতে হবে। কারণ আমরা জানি, সবাই মিলে এই মহামৃত্যুর মিছিল ঠেকানো সম্ভব। এজন্যই লড়াই।

এটা ওষুধ দিয়ে নয়, প্রতিহত করতে হবে সবার সম্মিলিত চেষ্টায়।

অনাহারের যুক্তিতে আমরা লকডাউন খুলে দিয়ে যাদের ঝুঁকিতে ফেলছি তারা সেই অনাহারী মানুষেরাই। কিন্তু প্রশ্ন করছি না, তাদের অনাহারী , দরিদ্র অবস্থায় আমরা রেখেছি কেন? কেন এত উন্নয়ন , এত সমৃদ্ধি সারা দুনিয়াতে এত অনাহারী মানুষ রেখেছে যাদের কাছে মৃত্যু স্বাভাবিক, বেঁচে থাকাটাই নিদারুন পরিশ্রমের?

আমাদের সমাজকে প্রান্তিক মানুষের দায়িত্ব নিতে হবে। বকে হোক, গাল দিয়ে হোক, বুঝিয়ে হোক, তালা মেরে হোক, যেভাবেই হোক মানুষকে শেখাতে হবে বেঁচে থাকার উপায়।

চাই নির্দিষ্ট পরিকল্পনা।
চাই সততা ও সঠিক বাস্তবায়ন।
চাই সবাই মিলে বেঁচে থাকার জন্য সবাই মিলে কষ্ট করার চেষ্টা।

আমি আর আমার চিকিৎসক বন্ধুরা প্রতিদিন কথা বলি। প্রতিদিন কেউ পিপিই সংগ্রহ করে সেটা বিভিন্ন জায়গায় পাঠায়। কেউ টেলিমেডিসিনে বিনামূল্যে সেবা দেয়। কেউ নানারকম গবেষণার ফলাফল পড়ে , বেছে সব চিকিৎসকদের কাছে পাঠিয়ে দেয় যাতে নতুন চিকিৎসাটা সাথে সাথে শুরু হয়ে যায়। কেউ খাবার পাঠায়। কেউ করোনা আক্রান্ত চিকিৎসকদের পাশে থাকার চেষ্টা করে। করোনাবার্তা নামে একটা ইনফর্মেশন পেজ পরিচালনা করে।

আমার মিডিয়ার বন্ধুরা , ওয়েবে নানারকম গান, অনুষ্ঠান, কবিতা, আড্ডা দিয়ে মানুষের মনটাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে। নানারকম কাজ করে মানুষকে আনন্দ দেন, তথ্য দেন। তাদের অনেকেই ফান্ড রেইজ করে সেটা ত্রানে দিচ্ছেন। । অনেকে প্রেরণা দিচ্ছেন স্বাস্থ্য কর্মী, পুলিশ, ব্যাংকার, সরবরাহকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নানা রকম ভিডিও, অডিওতে। তাদের মুখগুলি এত প্রিয় যে সেটা দেখলেও মানুষ সব ভুলে যায়।

রেমিয়ানস, আমার স্কুলের সব ডাক্তার অ্যালুমনি, প্রায় ৭০০ জন, বিনামূল্যে সেবা দিচ্ছে, ডাক্তারদের পিপিই দিচ্ছে। আবার চিকিৎসাও দিচ্ছে হাসপাতালে।

আমার বন্ধুসভার বন্ধুরা বন্ধুর মতো মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। আমার ডিবেট ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের বিতর্কের বন্ধুরা লিখছে, সাংবাদিকতা করছে, সচেতনতা বাড়াচ্ছে। ত্রাণ তো আছেই।

আমার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবীরাও সারা দেশে কাজ করছে নিজেদের মতো করে। রোটারিয়ান বন্ধুরা, যারা একসাথে বারো বছর রোটার‌্যাক্ট করেছিলাম। তারাও পাশে দাঁড়িয়েছেন মানুষের বরাবরের মতোই।

আহা! কত মানুষের সাথেই না ছিলাম। কতোভাবে যুক্ত ছিলাম, আছি কতো কাজে। আমি কি উপযুক্ত ছিলাম এত ভালোবাসার?

তবুও ভয় পাই। প্রতিদিন ভাবি জীবনের মেয়াদ মাত্র দু’সপ্তাহ। কিন্তু দমে যাই না। আমরা কেউ দমে যাই না। জীবনটা যদি দুসপ্তাহেরই হতো। তাহলেও কি আমরা সে জীবনটাকে একইরকম মূল্যবান ভাবতাম না! সে জীবনেও কি প্রিয়জনদের, জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসতাম না?

ভেবে নেন জীবনটা আর দুসপ্তাহের। আসেন প্রতিটা দিন আরো ভালোভাবে বাঁচি। মানুষের মতো বাঁচি।

লোভী, নীচ, অসাধু, অসৎ লোকগুলোর মতো না।

আসুন ভালোবাসায় বাঁচি।

ভয়কে বদলাই ভালোবাসায়।

লেখক : ডা. আব্দুন নূর তূষার, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন