প্রবাসীদের আত্মকাহন : ২ শতাংশ নগদ সহায়তা নয়, প্রয়োজন ৪ শতাংশ জীবন বীমা

  23-07-2021 08:19PM

পিএনএস( আহমেদ জামিল) : মহামারি করোনার মধ্যেও প্রতিটি দেশ অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশে এই মহামারির সময়েও প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে দেশের এবং দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হলেও তাদের ভেতরে রয়েছে কষ্টের আত্মকাহন । প্রবাসীদের দুঃখ, প্রবাস মানে পরবাস বা দূরদেশ, অনেকটা সার্কাসের হাতির মতো ছয় ফুট শিকলে বাঁধা দীর্ঘ জীবনের ফুটন্ত গোলাপের শুকনো পাতা। এক প্রকার দেয়ালবিহীন কারাগার, শত দুঃখ কষ্টের সাথে বিরামহীন জীবন যুদ্ধে কখনো জয়ী, কখনো পরাজয়ী সৈনিক।

ভাগ্য পরিবর্তন? কার! কোনো ভাবে পরিবারের এক সদস্য প্রবাসী হয়ে গেলেই বাকি সবাই যুব রাজা, মহারাজা! প্রবাসী মানেই আলাদিনের চেরাগ! শুরু হয় চাহিদার লিষ্ট।

পরিবার তথা মা-বাবা, ভাই- বোন, স্ত্রী- সন্তান এমন কি আত্মীয় স্বজনেরও দায়িত্ব এসে পড়ে। সবাই শুধু কষছে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব। কখনো হিসেব করা হয় না প্রবাসীর জীবনের। অন্যের সুখের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে দেশান্তরী। আর এই দেশান্তরী হওয়া মানুষগুলোর সুন্দর একটি নাম প্রবাসী। এক প্রবাসী একটি স্ট্যাটাস মাধ্যমে প্রবাসীর সংজ্ঞা দিয়েছেন‘ ‘প্রবাসী একটি প্রাণী দেখতে মানুষের মতো কিন্তু গাঁধা প্রকৃতির তার উপরে যতই বুঝা চাপিয়ে দেওয়া হোক বহন করিতে বাধ্য থাকিবে’!

বিশেষ করে ঈদ আসলেই কাকে কি দিতে হবে এই চিন্তা। পরিবারের সবাইকে খুশি রাখতে দিন রাত পরিশ্রম করে হাসি ফোটানোর চেষ্টা। সবার ঈদ আনন্দ যেন নিশ্চিত করার আপ্রাণ চেষ্টা অথচ ঈদের দিন সকালটা প্রতিটি প্রবাসীর হৃদয়ে চাপা কান্না নিয়ে মুখে মলিন রক্তঝড়া হাসি দিয়ে বর্তমানে একটি সেলফি তুলে ফেসবুকে দিয়ে শান্ত্বনা খোঁজে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। যাদের সুখের জন্য এই মহান আত্মত্যাগ তারা কি কখনো মানসিক শান্ত্বনা দিতে পেরেছে তাদের? অনেক প্রবাসীর জীবনে গল্প ত্রিশ চল্লিম বছর পর্যন্ত প্রবাস জীবন কেটে আসছেন। জীবনের সমস্ত সঞ্চয় স্ত্রীর কাছে, কখনো পরিবারের কাছে দিয়েছেন কিন্তু দেশে এসে যখন টাকা চেয়েছেন তখন লাশ হতে হয়েছে!

প্রবাসীদের কষ্টার্জিত এই টাকা কিভাবে খরচ করা হয়?
বর্তমান সময়ে প্রতিটি প্রবাসীর পরিশ্রমের টাকা দিয়ে চলছে এক ধরণের অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। স্ত্রীদের দামি গহনা, মাসে তিনবার শপিং, অপরিপক্ক বয়সে সন্তানদের হাতে দামি মোবাইল সেট , মোটর বাইক ইত্যাদি। এছাড়া প্রবাসে যারা থাকেন তারা কখনো চান না তাদের ছেলে-মেয়েরা পড়া- লেখা না করে বিদেশে গিয়ে তাদের মতো পরিশ্রম করুক। পড়া- লেখার জন্য যা প্রয়োজন শত কষ্ট হলেও সন্তানদের জন্য টাকা পাঠান। পড়া- লেখার নাম করে নিয়ে আসা সেই টাকা দিয়ে চলে সন্তানের বিলাসী জীবন যাপন ও অনৈতিক নানা কার্যকলাপ। কখনো কখনো প্রবাসীর স্ত্রীদের বিলাসী জীবন যাপনের সাথে জড়িয়ে পড়েন অনৈতিক সম্পর্কে।

একটি নার্সারী পড়ুয়া বাচ্চার জন্য অনেক পরিবার বলতে শুনেছি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ দেখানো হচ্ছে । প্রতিটি বিষয়য়ের জন্য গৃহশিক্ষক! প্রবাসীদের সরলতার সুযোগ নিয়ে এই টাকা সবটাই খরচ হয় বিলাশীতা অথবা অনৈতিক সম্পর্কের পিছনে। সবার ক্ষেত্রে যে তা হচ্ছে তাও ঠিক নয়। দায়িত্বশীল পরিবার সব কিছুই কিন্তু ব্যালেন্স করে চলছে। এছাড়া পাশের বাড়ির ভাবি কি করছে, এই মাসে কয়টা ড্রেস ক্রয় করেছে, পরিবারের দামি ফোন কয়টা আছে অপ্রয়োজনীয় অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় মাস্তুল! এসব এড়িয়ে চলতে পারলে হয় তো প্রবাসীদের জীবনের কষ্ট অনেকটা লাগব হতে পারে। সঞ্চিত হতে পারে কষ্টার্জিত কিছু টাকা। একটি প্রবাদ বাক্য রয়েছে কোনো কিছুতে টাকার প্রয়োজন হলে আগে মানুষ বলতো, লাগে টাকা দেবে গৌরি সেন আর এখন প্রবাদ হচ্ছে, লাগে টাকা দেবে প্রবাসী গাঁধা, যেখানে লাগবে দশ টাকা সেখানে দেবে হাজার টাকা!

দুই.
প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা অর্থাৎ রেমিট্যান্স বাংলাদেশের আয়ের প্রধান উৎস। বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি প্রবাসী রয়েছে। শতকরা ৯০ ভাগ প্রবাসী অর্থাৎ সাধারণ শ্রমিক। প্রবাসীরা মাসিক যে বেতন পায় তার এক- তৃতীয়াংশ নিজের রুম ভাড়া, খাওয়া, মোবাইল ও অন্যান্য খরচে চলে যায়। বাকি দুই- তৃতীয়াংশ পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেয় ; তাতে ঘর খরচ, ছেলে- মেয়ের স্কুলের খরচ, ভাই -বোনের বিবাহ, মা -বাবার চিকিৎসা খরচ ও স্ত্রী হাত খরচ ইত্যাদি। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু অনেকের ভাগ্যে ঠিকমতো বেতন জোটে না, (৪-৫) মাস পর্যন্ত বেতন বাকি থাকে। তখন ঋণ করে প্রিয়জনের সুখের জন্য টাকা পাঠিয়ে থাকেন। কিন্তু সে দুঃখ কাউকে বুঝতে দেয় না। কষ্ট বুঝতে না দিয়ে মা, বাবা, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোনদের বলেন, আমি ভালো আছি।

প্রবাসীরা নিজের জন্য প্রতিটি টাকা খরচ করতে দুইবার ভাবতে থাকেন। অথচ দেশে যারা এই টাকার অপব্যবহার করি কখনো কি তাদের কষ্টের কথা একবার চিন্তা করি? ভোর চারটায় উঠে দুপুরের খাবার নিয়ে (৩০-৪০) কিলোমিটার দূরে বিল্ডিং কন্সট্রাকশননের কাজে যেতে হয় তাদের। দোকানের চাকরি সকাল পাঁচটা- ছয়টা থেকে রাত দশটা- এগারোটা পর্যন্ত। আর সবচেয়ে কষ্টের কাজ হচ্ছে বাগান ও ঘরের চাকরি। যেখানে শুধুমাত্র নিদ্রাটাই বিশ্রাম। একটু বিশ্রাম নেবে তার সুযোগ নেই ; শুধু কাজ করে যাও। শুধু তাই নয়, তার উপর আবার মানসিক নির্যাতনও চলে। বছরে রমজান ঈদ ও কোরবানি ঈদ দুই দিন করে মোট চার দিন বন্ধ পাওয়া যায়।

জীবনের সোনালী দিন ও মধুময় যৌবন হাসিমুখে বিসর্জন দেয়। মা-বাবার স্নেহ , ছেলে মেয়ের আদর ,স্ত্রীর ভালোবাসা ,ভাই বোনের মমতা থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি পরিবার ও সমাজের সব অনুষ্ঠান থেকেও বঞ্চিত। বছরের পর বছর যাদের জন্য তাঁরা প্রবাসে; সেই পরিবারও অনেক সময় তাদের ভুল বুঝে, মনে কষ্ট দেয় । তাঁদের সব সময় এটা -ওটা পাঠাতে বলে। পরিবারের অন্য সদস্যদের দ্বারা তাঁরা অবহেলার শিকার হয়। পরিবার ও তাদের দুঃখ বুঝেনা, এ এক নির্মম পরিহাস। এটা প্রতিটি প্রবাসীর আত্মকথা।

প্রবাসে একা থাকা, নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা ইত্যাদি কারণে হূদরোগ, কর্মক্ষেত্রে বা সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি মাসে (১০০-১৫০) জন ফিরে লাশ হয়ে। তার পরেও প্রবাসীদের আনন্দ যখন শুনে মা বাবা সহ পরিবারের সবাই ভালো আছে। সবচেয়ে কষ্টের হচ্ছে যখন বিদেশে থাকা অবস্থায় আপন জনের মৃত্যু সংবাদ। ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কাজ করে যাওয়া, নিজে রান্না করে খাওয়া সত্ত্বেও পরিবারের সুখের জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছেন প্রবাসী ভাইয়েরা। প্রবাসী পরিবারের কাছে মিনতি একটু সহানুভূতি ও সুন্দর ব্যবহার তাঁদের প্রাপ্য। অনেক সময় তাও দিতে ব্যর্থ হই আমরা।

তিন.
প্রবাসীরা কি চায়?
এক কথায় জীবনের নিশ্চিয়তা। বাংলাদেশের সৈনিকরা যেমন দেশরক্ষার অতন্ত্র প্রহরী, ঠিক তেমনি প্রবাসীরাও দেশের ব্যাংকে রিজার্ভের চাবিকাঠি । প্রতিটি প্রবাসী এক একটি জীবন যুদ্ধের সৈনিক। প্রত্যেক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিটি প্রবাসী দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। সরকারের একটি যুগান্তরকারি সিন্ধান্ত হচ্ছে ২ শতাংশ নগদ সহায়তা প্রধানের ঘোষণা। প্রবাসী আয়ে ২ শতাংশ নগদ সহায়তা দিতে নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে মহামারি করোনার মধ্যেও প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। আর এই প্রবাসী আয়ের ওপর ভিত্তি করেই দেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে। শুধু তা-ই নয়, প্রবাসীদের পাঠানো এই রেমিট্যান্স বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রেখেছে।

করোনা মহামারির প্রভাব কেটে গেলে অবৈধ পথে টাকা লেনদেন আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে। এতে টানা বাড়তে থাকা রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আবার কমতে পারে। তাই প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব করেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। বৈধ পথে প্রবাসী আয়ের ধারাটি অব্যাহত রাখতে পারলে এবং আরও বেগবান করতে পারলে রেমিট্যান্স প্রবাহের বর্তমান ধারা অদূর ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। তাই প্রবাসীদের উৎসাহী করতে বিদ্যমান ২ শতাংশের প্রণোদনা বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করার একটি প্রস্তাব করা হয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়ে।

কিন্তু যাদের হাত ধরে দেশের রেমিট্যান্স বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে তাদের ভাগ্য কি আদও পরিবর্তন আসছে? অনেক প্রবাসী দেশে আসার পর টাকার কারণে দিন মজুরের কাজ করতে হয়। ব্যবসার জন্য পুঁজি পর্যন্ত তাদের কাছে থাকে না। হতাশার গ্লানি নিয়ে শূন্য হাতে দেশে এসে বেকারের খাতায় নাম লেখাতে হয় তাদের। সরকারের ২ শতাংশ নগদ সহায়তা সুবিধা যদি প্রবাসীদের সরকারের জীবন বীমা আওয়াতায় নিয়ে আসা যায় অথবা সরকারি যেকোনো একটি ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে প্রবাসীদের নামে রাখা হয় তাহলে যখন তারা একেবারে দেশে চলে আসবে তখন হয়তো তাদের এই টাকা বিশাল উপকারে আসবে।

২ শতাংশ হোক আর ৪ শতাংশ হোক তারা যখনি বৈধভাবে দেশে টাকা পাঠাবে তখনি তাদের সঞ্চয়ী হিসেবে জমা হবে অথবা সরকারের জীবন বীমা পলিসির মাধ্যমে সেই টাকা তাদের নামে জমা হবে। প্রবাসে যাবার সময় তাদের পাসর্পোট নম্বর দিয়ে তাদের একটি আইডি বা একাউন্ট করা থাকলে অথবা যারা অবৈধ ভাবে গিয়েছেন তারা পাসর্পোট নম্বর দিয়ে একাউন্ট করলেই এই সুবিধা ভোগ করতে পারেন এ রকম ব্যবস্থা করলে একদিকে যেমন দেশের রিজার্ভ বাড়বে অন্য দিকে প্রবাসীদের জীবনের একটি নিশ্চয়তা তৈরি হবে। যে ২ শতাংশ দেওয়া হচ্ছে তা প্রবাসীদের পরিবার বা যারা টাকা তুলছে তারা সরাসরি ভোগ করছে অথচ যে কষ্ট করে টাকা পাঠাচ্ছে তার জন্য কিছুই থাকছে না। সরকারি ব্যবস্থপনায় যদি এ রকম কোনো প্রদক্ষেপ গ্রহন করা হয় তাহলে এক দিকে যেমন তৎক্ষণাৎ নগদ টাকা দেওয়া লাগবে না, আবার সেই টাকা সরকারে হাতেই চলে যাবে এতে দুই পক্ষেরই আর্থিক লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া প্রবাসীদের বাধ্যতামূলক জীবন বীমার আওতায় নিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি।

প্রবাসীদের দুঃখ কষ্ট বিবেচনা করে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং অর্থমন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টি কর্তৃপক্ষ সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ই পারে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে। প্রবাসীরা তাদের জীবনের নিশ্চয়তা পেলে বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে আরও উৎসাহ পাবেন আশা করি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন