কাশ্মীর ও কিছু কথা

  09-09-2016 06:54PM

পিএনএস ডেস্ক : কাশ্মীর ‘আনরেস্ট’ বা অস্থিরতা নিয়ে ইন্টারনেটে বিভিন্ন প্রতিবেদন পড়ছিলাম। হঠাৎ বার্তা সংস্থা রয়টার্স-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রকাশিত ছবিতে চোখ আটকে গেল। ১৭ আগস্ট, ২০১৬ রাজধানী শ্রীনগর থেকে তোলা খুবই সাদামাটা ছবিটি ছিল–একটি বন্ধ দোকানের, যার শাটারে ইংরেজিতে লেখা ‘উই ওয়ান্ট ফ্রিডম’ বা ‘আমরা স্বাধীনতা চাই’। ছবিটির এক পাশে পুলিশের একজন সদস্য টহলে আছেন, শাটারের নিচে পুলিশের দুটি হেলমেট ও একটি বর্ম পড়ে আছে, পাশেই একটি পানির বোতল। ছবিটির ঠিক মাঝখানে নিচের দিকে একটি ‘পায়রা’ উড়ে এসে বসছে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে গত ২ মাসের আনরেস্ট বা অস্থিরতা বোঝাতে এই একটি ছবিই যথেষ্ট। স্থানীয় দৈনিক রাইজিং কাশ্মীরে প্রকাশিত সর্বশেষ (০৭.৯.২০১৬) তথ্য অনুসারে ৮ জুলাই ২০১৬ শুরু হওয়ার পর অব্যাহত এ সহিংসতায় ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ৭৬ জনে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে আহতের সংখ্যা সাড়ে আট হাজার ছাড়িয়েছে। বিভিন্ন স্থানে কারফিউ জারি রয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে।
ইন্টারনেটে সার্সইঞ্জিন গুগলে ‘কাশ্মীর আনরেস্ট’ লিখে সার্চ করলে অনেক ছবিই চোখে পড়বে, যার অধিকাংশই নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় স্থাধীনতাকামী (কেউ বলে বিচ্ছিন্নতাবাদী) বাসিন্দাদের সংঘর্ষের। কোনোটিতে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, এক পক্ষ (স্থানীয় বাসিন্দা) ঢিল বা পাথর ছুড়ছে, অপর পক্ষ (ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য) আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে তার জবাব দিচ্ছে। কোনোটিতে দেখা যাবে নিহত কারো কফিন নিয়ে মিছিল করে স্থানীয় লাখো মানুষ তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আবার কোনোটিতে সন্তান হারিয়ে কোনো মায়ের বিলাপ, কোনোটিতে সংঘর্ষে আহত নারী বা শিশুর হাসপাতালের বিছানায় কাতরানো। এ যেন কাশ্মীরিদের নিত্যদিনের চিত্র। কাশ্মীরিদের এ চিত্র এক বা দুদিন, মাস, বছর বা দশকের নয়, প্রায় শতাব্দীব্যাপী এ চিত্র। কেবল কাশ্মীরিদের নয়; বিশ্ববাসীর কাছেও এই চিত্র খুবই পরিচিত।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ৮ জুলাই ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে বুরহান ওয়ানি নামের এক তরুণ (স্থানীয়দের কাছে স্বাধীনতাকামী, আর ভারতীয় বাহিনীর কাছে বিচ্ছিন্নতাবাদী) নেতার নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে এ সহিংসতার সূত্রপাত। তখন থেকে সেখানে বিক্ষোভ চলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ, কারফিউ জারি করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বন্ধ রয়েছে দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, চলছে না যানবাহন। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসী স্বাধীনতাকামীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ চলছে। এতে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের কান্না, হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষের কাতরানো।
তবে, ছবিটি নিয়ে কোনো ‘ওড’ বা ‘গীতি কবিতা’ রচনা করতে চাই না, যেমনটি করেছেন ইংরেজ রোমান্টিক কবি জন কিটস। বিখ্যাত এই কবি ‘আর্ন’ বা শবাধারের ওপর আঁকা ছবি দেখে ১৮১৯ সালে রচনা করেছিলেন ‘ওড অন এ গ্রিসিয়ান আর্ন’। একইভাবে কাশ্মীরিদের বিয়োগান্তক ঘটনা নিয়ে ‘এলিজি’ বা ‘শোকগাথা’ রচনা নয়, যেমনটি রচনা করেছিলেন আরেক ইংরেজ কবি থমাস গ্রে তার নিকটতম বন্ধুর মৃত্যুতে। বন্ধু রিচার্ড ওয়েস্টকে হারিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘এলিজি রিটেন ইন কান্ট্রি চার্চইয়ার্ড’। ছবিটি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের ৮ আগস্ট, ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত “ডযু ধ হবি ধিাব ড়ভ ারড়ষবহপব যধং ংঃৎঁপশ ওহফরধহ কধংযসরৎ” শীর্ষক প্রতিবেদনে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে নতুন করে সহিংসতার কারণ খুঁজেছেন নিখিল কুমার। প্রতিবেদনে বলা হয়, হিমালয়ের পূর্ব প্রান্তে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত কাশ্মীর মূলত বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরতম স্থানগুলোর মধ্যে একটি। এটাকে ভূ-স্বর্গও বলা হয়ে থাকে, যা ভারত ও পাকিস্তানকে পৃথক করেছে। এই ভূ-স্বর্গ নিয়ে শতাব্দীকালব্যাপী দ্বন্দ্ব রয়েছে প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে। দুটি দেশই কাশ্মীরকে তাদের অংশ বলে দাবি করে থাকে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে মোট চারটি যুদ্ধ সংঘঠিত হয়, যার মধ্যে তিনটিই ছিল মুসলিম-অধ্যুষিত এই কাশ্মীর নিয়ে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর বরাতে ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তাদের কাছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ আছে। কেবল ’৯০-এর দশকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সংঘঠিত ৮০০-এর বেশি নির্যাতন ও নিহত হওয়ার ঘটনার রেকর্ড আছে তাদের কাছে। এ ছাড়াও ১৯৮৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত কয়েক শ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও রয়েছে। সর্বশেষ ২০১০ সালে ভারতীয় বাহিনীর হাতে তিনজন সিভিলিয়ান বা স্থানীয় লোক নিহত হওয়ার পর ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে। এরপর থেকে সহিংসতার মাত্রা কিছুটা কমলেও কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা চলতে থাকে।
সর্বশেষ ৮ জুলাই ২২ বছর বয়সী বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পর সহিংসতা তীব্র আকার ধারণ করে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। যাতে ৭৬ জন নিহত এবং সাড়ে আট হাজার লোক আহত হয়েছেন, যাদের অনেকেই ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহার করা ‘নন-লেথাল’ উইপনের (বিশেষভাবে তৈরি ছররা গুলি) আঘাতে অন্ধত্ববরণ করতে চলেছেন। অনেকে অবার এক চোখে দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছেন। শ্রীনগরের মহারাজা হরি সিং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১২ বছর বয়সী উমারের অবস্থা বর্ণনা করে টাইম ম্যাগাজিনের ওই খবরে আরও বলা হয়, উমারের মতো আরও অনেকের একই ভাগ্য বরণ করতে হচ্ছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর ঘটনা সাম্প্রতিক সহিংসতার সূত্রপাত। এখানে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে যুবকদের মধ্যে ‘উত্তেজনা’ সৃষ্টি করেছিলেন বুরহান। তিনি কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ‘আইকন’ হয়ে উঠেছিলেন। তার মৃত্যুতে গোটা ভ্যালিতে ব্যাপকভাবে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
বুরহান ওয়ানির মৃত্যুই সাম্প্রতিক সহিংসতার প্রধান কারণ ঠিক তা নয়, কারণ আরও গভীরে। ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের এক প্রতিবেদনের সারকথা দাঁড়ায় এমন‒কাশ্মীর কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ―এ তিনটি বিষয় ভারতের হাতে তুলে দিয়ে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল। তবে কাশ্মীরের তরুণ প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরিদের চেয়ে একধাপ এগিয়ে গেছেন। তারা এখন স্বাধীনতা চান, নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি নিজেরাই প্রণয়ন করতে চান। তারা বস্তুত সার্বভৌমত্বের দাবি তুলেছেন, তা অন্য যেকোনো দেশের স্বাধীনতার সমতুল্য, আর এ দাবিই মানতে নারাজ কেন্দ্র। কেননা ভূ-রাজনৈতিক দিকে থেকে পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশের কাছেই কাশ্মীর সমান গুরুত্ব বহণ করে আসছে। আর এ অবস্থায় কাশ্মীরিদের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
এবার ছবিটির কথায় আসা যাক। বন্ধ দোকানের সামনে পুলিশের টহল এবং ফেলে রাখা হেলমেট কাশ্মীরের সহিংসতার জানান দিচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, সেখানে বড় ধরনের কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যার কারণে দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। আর যেহেতু সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, সেহেতু সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আর দোকানের ‘উই ওয়ান্ট ফ্রিডম’ লেখাটি কাশ্মীরিদের মনের কথা বোঝানো হয়েছে। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে ‘ডাভস’ বা পায়রা বা কবুতর লাভ, পিস অথবা বার্তাবাহকের প্রতীক। জুডাইজম, ক্রিশ্চিয়ানিটি ও প্যাগানিজমেও প্রতীক হিসেবে ‘ডাভস’-এর ব্যবহার লক্ষ করা যায়। আর বাংলা অভিধানে শব্দটির অর্থ শান্তি বা নীরবতার প্রতীক। সুতরাং সহিংসতা ও অস্থিরতার মাঝেও ছবির পায়রাটি শান্তির প্রতীক হিসেবে বোঝানো হয়েছে।
কাশ্মীরে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা সহিংসতা বন্ধে কার্যত কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। তাহলে কি এ অবস্থা চলতেই থাকবে। কাশ্মীরিদের প্রাণের দাবি এখন স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, যদিও এ নিয়ে নিজেরাই দ্বিধাবিভক্ত। তবে এখনই উচিত সহিংসতা বন্ধ হওয়া। কেননা এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের প্রাণহানির তালিকা আরও দীর্ঘ হবে। হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষের ভিড় বাড়তে থাকবে। একপর্যায়ে মানবিক বিপর্যয়ও নেমে আসতে পারে। এসব এড়াতে এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ভারত-পাকিস্তান-কাশ্মীরিসহ সব পক্ষকে আলোচনায় বসতে হবে। রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। কাশ্মীরিদের কথা শুনতে হবে, বুঝতে হবে তাদের ভাষা। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে আন্তর্জাতিকভাবেও সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে সেখানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে।
তবে, বন্ধ দোকানের শাটারে লেখা কাশ্মীরিদের মনের কথা ‘উই ওয়ান্ট ফ্রিডম’ বুঝে পদক্ষেপ নিলে গল্পের ছবির মতো শত অস্থিরতা দূর হয়ে শান্তির ‘পায়রা’ দেখা দিতে পারে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ‘অস্থির’ এই ভূ-স্বর্গে।
লেখক: আব্দুল্লাহিল ওয়ারিশ

পিএনএস/ হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন