লকডাউনে জমজমাট অনলাইন জুয়া!

  16-04-2021 11:32PM

পিএনএস ডেস্ক : সারাদিন চায়ের দোকান চালিয়ে আয় হয় চার থেকে পাঁচশ টাকা। খাটুনিটাও কম নয়। তার ওপর বাকির ঝামেলা তো আছেই। চলমান লকডাউনে চায়ের ব্যবসা মন্দা। তাই সহজ আয়ের পথ ধরেছেন মোহাম্মদপুর নবোদয় হাউজিং এলাকার চায়ের দোকানদার শাকিল। শুরু করেছেন অবৈধ ক্রিকেট বেটিং। কিন্তু আয়ের মুখ তো দেখা হলো না। উল্টো গত চার দিনে আট হাজার টাকা খোয়া গেছে তার।

একই অবস্থা রাজধানীর হাজারীবাগ বউবাজার এলাকার পাঠাও রাইডার ওমর ফারুকের। পাঠাও বন্ধ থাকার কারণে অলস সময় কাটাচ্ছিলেন তিনি। এ সময় ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) খেলা শুরু হয়। আর এই খেলাকে কেন্দ্র করে জুয়ায় লিপ্ত হয়েছেন তিনি।


ওমর ফারুক জানান, চায়ের দোকানে বিভিন্ন দলের ওপর বা ওভারপ্রতি জুয়া তিনি আগেও খেলেছেন। এবার জুয়া খেলছেন বিভিন্ন বেটিং সাইটে।

ওমর ফারুকের দেয়া তথ্য মতে, দেশীয় অনেক বেটিং ওয়েবসাইট রয়েছে। যেখানে অ্যাকাউন্ট খুলে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হয়। সে টাকা অনুযায়ী অ্যাকাউন্টে কয়েন বা ডলার জমা হয়। এই কয়েন বা ডলার মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্কের বাজি ধরার সুযোগ রয়েছে।

ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এমন অনেক দেশীয় বেটিং সাইটের ঠিকানা। এসব বেটিং সাইট যারা পরিচালনা করেন তারা বেশ চতুর প্রকৃতির লোক। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নজরে এলে এসব ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু ওয়েবসাইটের পরিচালকরা স্বল্প সময়ের মধ্যে নতুন ডোমেইন নিয়ে ফিরে আসছেন, লিপ্ত হচ্ছেন একই কাজে।

কেবল আইপিএলকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন লাখ থেকে কোটি টাকা হাতবদল হচ্ছে এসব ওয়েবসাইটে। নিয়মিত ঠিকানা পরিবর্তন করা এসব চক্রকে শনাক্তকরণের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনী।

অনলাইনে জুয়া খেলার বেশ কিছু দেশীয় ওয়েবসাইটের নাম ও তথ্য ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এসব বেটিং সাইটে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) এবং আন্তর্জাতিক ও ক্লাব পর্যায়ের ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে চলে বেটিং। এই সাইটগুলো হলো─ বাজীগর ডটকম, প্লেবেট৩৬৫ ডটকম, লগ১০ ডট লাইভ, ৯ক্রিকেট, বিডিটি১০ডটকম, বেটবি২ডটকম, বেটস্কোর২৪ ডটকম, টাকা৬৫ ডটকম, উইনস৬৫ ডটকম, জয়টি২০ ডটকম, ভিক্টর২৬ ডটকম, ৬ক্রিকেট ডটকম, ইন্ডিতা৯৬ ডটকম, লাক বেট বিডি ডটকম, ওপেন বেট ডট লাইভ, এলবিএস২৪ ডটকম, বেট উইন ৯৬ ডটকম, স্পোর্টস ৩৩৩ ডটকম, বেট বাটার ফ্লাই ডটকম।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি ওয়েবসাইট এক বা একাধিক এডমিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারাই জুয়া পরিচালনা করেন। এসব ওয়েবসাইটে জুয়া খেলতে প্রথমে একটি আইডি তৈরি করতে হয়। এক্ষেত্রে নাম ও মোবাইল নম্বর দিয়ে আইডি খুলতে হয়। পরবর্তী ধাপে টাকা পাঠিয়ে ‘কয়েন’ কিনতে হয়।

ওয়েবসাইটগুলোতে এক বা একাধিক বিকাশ, রকেট ও নগদ নাম্বার দেয়া রয়েছে। যেখানে টাকা পাঠালে টাকার সমপরিমাণ কয়েন দেয়া হয়। এরপর রেজিস্ট্রেশনকারী সে কয়েন দিয়ে প্রতি খেলায় সর্বনিম্ন ২০ কয়েন, সর্বোচ্চ যেকোনো পরিমাণ বেট বা বাজি ধরতে পারে।

বাজি ধরার পর জয়ী হলে বিজয়ীর অ্যাকাউন্টে কয়েন জমা হয়। পাঁচশ কয়েন জমা হলে তা উইথড্র অপশনের মাধ্যমে তুলতে পারবেন জুয়াড়িরা। এক্ষেত্রে এডমিনের কাছে রিকোয়েস্ট করে বিকাশ, রকেট বা নগদ নাম্বার দেয়ার ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে টাকা পাঠিয়ে দেয় ওয়েবসাইট এডমিনরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জুয়ার অর্থ লেনদেনের জন্য এডমিনদের কাছে ১০ থেকে ১৫টি করে বিকাশ, রকেট ও নগদ মোবাইল ব্যাংকিং সেবার নাম্বার রয়েছে। বিকাশ, রকেট ও নগদের এজেন্ট সিম নিতে ভুয়া তথ্য-প্রমাণ ব্যবহার করছে এসব ওয়েবসাইট পরিচালকরা।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিফোন রেগুলেটরি কমিশন-বিটিআরসির নজরে এলে এসব ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। তবে বন্ধ করে দেয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই ওয়েবসাইটের ডোমেইন নাম পরিবর্তন করে পুনরায় তারা ফিরে আসছেন।

ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিলেও জুয়াড়িদের জমা রাখা টাকার নিশ্চয়তা দেয় অনেক ওয়েবসাইট। নতুন ডোমেইন নিয়ে ফিরে এসে জুয়াড়িদের জমা থাকা কয়েন ফেরত দিচ্ছে তারা। জুয়াড়িরা বেটিংয়ের জন্য জমা বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া ওয়েবসাইটের সংখ্যাও কম নয়।

জানা গেছে, বেটিং ওয়েবসাইট তৈরিতে পেশাদার ওয়েব ডেভলপার্সদের মাত্র দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। আর ডোমেইন বন্ধ করে দেয়া হলে ওয়েবসাইটের সঙ্গে নতুন ডোমেইন যুক্ত করতে সময় লাগে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট। আর প্রতিটি ডোমেইনের দাম সাকল্যে এক হাজার টাকা।

এছাড়া আন্তর্জাতিক বেটিং ওয়েবসাইটের মধ্যে বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় ওয়ানএক্স বেট এবং বেট ৩৬৫। এরমধ্যে বেট ৩৬৫ নামের ওয়েবসাইটি অনেক আগেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নজরে আসে। ফলে ওয়াবসাইটকে বাংলাদেশ সার্ভার থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পিভিএন ব্যবহার করে ব্যবহার করে এ সাইটটিকে জুয়ায় লিপ্ত হচ্ছেন জুয়াড়িরা।



এছাড়া ওয়ানএক্স বেটে জুয়া খেলতে গুগল প্লে স্টোর থেকে অ্যাপের সাহায্য নিচ্ছেন জুয়াড়িরা। এ ওয়েবসাইটটির একজন এজেন্টের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা টাইমস। তার নাম আনিস মোহাম্মাদী। বেটিং বা জুয়ার জগতে তিনি আনিস ভাই বা আনিস ভাই দুবাই ক্লাব হিসেবে পরিচিত।

সূত্র বলছে, আনিস মোহাম্মদী ঢাকার কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সক্রিয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমো ব্যবহার করে অবৈধ জুয়ায় টেনে নিচ্ছেন সব বয়সী মানুষকে। জুয়া খেলার জন্য অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়া থেকে শুরু করে জুয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কয়েনও সরবরাহ করেন তিনি।

সূত্র মতে, অন্যদের জুয়া খেলিয়ে সেখান থেকে মাসে প্রায় সাত থেকে আট লাখ টাকা পর্যন্ত কমিশন পান এ এজেন্ট। বর্তমানে চলমান আইপিএল এর কারণে তার আয় বেড়েছে কয়েক গুণ।

আনিস মোহাম্মাদী বেটিং জগতে বিগম্যান হিসেবে পরিচিত। তবে বেট ৩৬৫ থেকে শুরু করে বেশ কিছু ওয়েবসাইটে জুয়া খেলার জন্য কয়েন বা ডলার সরবরাহকারীর সংখ্যাও এখন কম নয়। ৯০ থেকে ১০০ টাকা দরে প্রতিটি কয়েন বিক্রি করছেন তারা। আর এসব কয়েন দিয়ে জুয়া খেলায় লিপ্ত হচ্ছেন জুয়াড়িরা।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, হাজারীবাগ, লালবাগ, বাড্ডা এলাকার মহল্লার চায়ের দোকানে উন্মুক্তভাবে অনলাইন ও অফলাইনে জুয়া খেলার দৃশ্য এখন নিয়মিত।

সম্প্রতি আইপিএল খেলাকে কেন্দ্র করে টেলিভিশনে সামনে বসে খেলা দেখার পাশাপাশি দল, ওভার এমনকি বল প্রতি জুয়া খেলছে এমন অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-১০। জুয়াড়িদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে জানিয়ে র‌্যাব-১০ এর কর্মকর্তা মেজর শাহরিয়ার জিয়াউর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, 'জুয়া বা অনলাইন জুয়ার বিষয়ে আমাদের অভিযান অব্যাহত। সম্প্রতিও আমরা বেশ কয়েকজন জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করেছি, যারা আইপিএলকে কেন্দ্র করে জুয়া খেলছিল। এখন লকডাউন চলছে। এটাকে জুয়া খেলার সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। এটা যেন না হয়, এজন্য আমরা সজাগ রয়েছি।'

পিএনএস /জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন