ভয়াবহ ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফির কবলে বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা

  27-10-2016 07:49AM


পিএনএস ডেস্ক: পর্নোগ্রাফি থেকে শিশুদের নিরাপদে রাখতে দেশে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেই। সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও পর্নোগ্রাফি বন্ধে তার তেমন প্রয়োগ নেই। আর ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান এবং মোবাইল অপারেটরগুলোরও বিষয়টিতে রয়েছে গা ছাড়া ভাব। বিশেষত মোবাইল ফোন সহজলভ্য ও অতিপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠায় অভিভাবকরাও এর অপব্যবহার রোধে সার্বক্ষণিক নজরদারি করতে পারছেন না। এ অবস্থায় শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত শিশু-কিশোররা পর্নোগ্রাফির ঝুঁকিতে পড়েছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বখে যাওয়া থেকে রক্ষায় পর্নোগ্রাফি বন্ধে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, রাজধানীতে ৭৭ শতাংশ স্কুলগামী শিক্ষার্থী পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেট সেবা সহজলভ্য হওয়ায় মানুষের যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। পাশাপাশি ভালো ও খারাপ ভিডিও লেনদেন, সংগ্রহ বা প্রচার করাটাও বেশ সহজ হয়ে পড়েছে। পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত বেশির ভাগ শিশুই ইন্টারনেট ব্যবহার করে মোবাইল বা ব্যক্তিগত কম্পিউটারে এসব দেখছে। আবার ইন্টারনেট ছাড়াও বিভিন্ন ডিভাইস বা অ্যাপসের মাধ্যমে মোবাইলে এসব ভিডিও লেনদেন হচ্ছে।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জব্বার গণমাধ্যমকে বলেন, ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি বন্ধে মূল ভূমিকা হলো বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি)। তারাই দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। যেসব অ্যাকসেসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি দেশে পরিবেশিত হয় সেগুলো বন্ধ করে দিলেই শিশুরা বা অন্য কেউ পর্নোগ্রাফি দেখতে পাবে না। দুঃখের বিষয় হলো, বিটিআরসির এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো ধরনের উদ্যোগ লক্ষণীয় নয়।

মোস্তাফা জব্বার বলেন, শিশুরা বেশির ভাগ সময় মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি দেখে থাকে বলে অভিযোগ উঠছে। তবে এই পর্নোগ্রাফি বন্ধে মোবাইল অপারেটর কম্পানিগুলোর তেমন ভূমিকা নেই। সরকার যদি উদ্যোগ নেয় আর বিটিআরসি পর্নোগ্রাফি অ্যাকসেস বন্ধ করে দেয় তাহলে মোবাইল অপারেটররাও ইন্টারনেটে ওই অ্যাকসেস দিতে পারবে না।
শিশুদের পর্নোগ্রাফির থাবামুক্ত রাখতে অভিভাবকদের ভূমিকা নিয়ে মোস্তাফা জব্বার বলেন, কৌতূহলী বিষয়গুলোর প্রতি শিশুদের ঝোঁক সব সময় বেশি। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত, শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। তাতে করে এসবের বিরুদ্ধে শিশুরা মানসিকভাবে তৈরি হয়।

বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ইন্টারনেট ব্যবহার করে বেশির ভাগ পর্নোগ্রাফি দেখছে অনেকেই। আমরা বেশ কিছু পর্ন সাইট বন্ধ করেছি বিভিন্ন সময়। ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ের (আইআইজি) কাছে তালিকা পাঠালে তারা সেগুলো বন্ধ করে দেয়। বিদেশি পর্ন সাইটগুলো আবার বিকল্প গেটওয়ে ব্যবহার করে তাদের সাইট চালু করে। ফলে অনেক সাইট বন্ধ হলেও আবার চালু হচ্ছে। এ ছাড়া নতুন নতুন যেসব পর্ন সাইটের তালিকা আমরা পাচ্ছি সেগুলোও বন্ধ করে দিচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘বেশ কিছু দেশি ওয়েবসাইটেও পর্ন সরবরাহ করা হচ্ছে। এগুলো বন্ধেও আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। তবে এসব বাজে সাইট বন্ধের জন্য আমাদের দেশের জনগণকে সবচেয়ে বেশি সচেতন হতে হবে। যেসব সাইটের ঠিকানা পাওয়া যাবে সচেতন জনগণ সেগুলোর তালিকা যেন বিটিআরসিকে দেয়। আমরা ওই তালিকা ধরে সেগুলো বন্ধ করে দেব। এ ছাড়া পর্নোগ্রাফির সাইট বন্ধ ও ইন্টানেটের আরো নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমরা বিশেষ প্রযুক্তি স্থাপনের কাজ করে যাচ্ছি। একটু সময় লাগবে। আশা করি, এই প্রযুক্তি স্থাপন হলে এসব সমস্যা থাকবে না।’

এক জরিপে জানা যায়, দেশে বেশির ভাগ ইন্টারনেট ব্যবহার হয়ে থাকে মোবাইল অপারেটর কম্পানিগুলোর মাধ্যমে। দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের অভিভাবক কম্পানি টেলিনরের এক জরিপে উঠে আসে, বাংলাদেশের প্রায় ৪৯ শতাংশ স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী কোনো না কোনোভাবে সাইবার হুমকির শিকার। গ্রামীণফোনের একটি সূত্র জানায়, এসব ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকার জন্য তারা একটি বিশেষ প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী ২০১৭ সালের মধ্যে উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমে আসবে।

ঢাকার সাইবার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, শিশুরা এখন বিদেশি পর্নোগ্রাফির পাশাপাশি দেশি পর্নোগ্রাফিও পাচ্ছে সহজভাবে। দেশি এসব ওয়েবসাইটের ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করতে পারে সরকার। এ জন্য সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং বিটিআরসি তা বাস্তবায়ন করবে। এ ছাড়া পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে একটি ভালো আইন রয়েছে। ওই আইনে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা হয়। বিচার হয় দায়রা আদালতে। পর্নোগ্রাফি তৈরি, সরবরাহ, সংরক্ষণ ও অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যারা পর্নোগ্রাফি তৈরি ও সরবরাহ করে আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তির আওতায় আনতে পারলে এই অপতৎপরতা কমে আসবে। তা ছাড়া সাইবার অপরাধ দমনে পুলিশের একটি বিভাগ রয়েছে। তারা এসবের প্রতি নজরদারি বাড়িয়ে ঝুঁকি কমিয়ে আনায় ভূমিকা রাখতে পারে।

এদিকে তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার করে ওয়েবসাইট, মোবাইল ফোন, ভিসিডি, সিডি ও ম্যাগাজিনে পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে দেওয়া বন্ধে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না—এ মর্মে গত বছর একটি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। আইন, স্বরাষ্ট্র, তথ্য, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ, তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি, মহিলা ও শিশু, ডাক ও টেলি যোগাযোগ, যুব ও ক্রীড়া সচিব এবং পুলিশের মহাপরিদর্শককে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়। রিটটি করেন জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী। তিনি বলেন, এখনো বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়নি, শুনানি চলছে।

চলতি মাসের শুরুতে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় স্কুলগামী শিশুদের প্রায় ৭৭ শতাংশ নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখে। বর্তমানে চারটি পদ্ধতিতে পর্নোগ্রাফি তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি পর্নোগ্রাফির তুলনায় ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ঘিরে তৈরি পর্নোগ্রাফি শিশুরা বেশি দেখছে। আর এসব ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ১৮ বছরের কম বয়সী স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের।

আবার ২০১৩ সালে ঢাকার কয়েকটি স্কুলে জরিপ চালায় একটি বেসরকারি টেলিভিশন। তাতে দেখা যায়, স্কুল শিক্ষার্থীদের ৮২ শতাংশ স্বীকার করেছে যে তারা সুযোগ পেলে মোবাইলে পর্ন ছবি দেখে।

মোস্তাফা জব্বার বলেন, মোবাইল ফোনের অপব্যবহার রোধে সবার আগে দরকার অভিভাবকদের সচেতন হওয়া। এখন অনেক ধরনের মোবাইল অ্যাপস পাওয়া য়ায়। এগুলো ব্যবহার করে নির্দিষ্ট কোনো বিষয় ব্যবহারের ক্ষমতা অকার্যকর করা যায়। যদি কোনো অভিভাবক তাঁর শিশুকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেন তাহলে ওই অ্যাপসগুলো কার্যকর করে দিলে শিশুটি মোবাইলের অপব্যবহার থেকে দূরে থাকবে।

রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সৈয়দ আরেফিন আশিক বলেন, ‘স্মার্টফোনের এই যুগে ছোট ছেলেমেয়েদের সাধারণ দাবি থাকে মোবাইল ফোনের। তবে সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়ার পর অবশ্যই তা নজরে রাখতে হবে।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন