ফেসবুকে ভয়ঙ্কর ফাঁদ

  16-02-2017 08:54AM


পিএনএস ডেস্ক: ফেসবুকে ভয়ঙ্কর ফাঁদ। ছদ্মবেশী প্রতারকের সেই ফাঁদে আটকে ঘটছে নানা সর্বনাশ। মার্জিত ছবি ও আকর্ষণীয় পরিচিতির আড়ালে ওরা টার্গেট করছে নারীদের। কেড়ে নিচ্ছে সম্ভ্রম। শুরুটা একেবারে সাদামাটা। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো। সরল বিশ্বাসে নারীরা তা এক্সসেপ্ট করছে। তারপর বন্ধুত্ব। এভাবে বেড়ে চলছে ফেসবুক ফ্রেন্ড। কিন্তু কখনো কখনো তা এখানেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। লাইক, শেয়ার, কমেন্ট, পোস্ট ও চ্যাটে আকর্ষণ করছে নারীদের। প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে কিশোরী বা তরুণী থেকে শুরু করে মধ্য বয়সী নারীদেরও। সাক্ষাতের নামে গড়ে তুলছে ঘনিষ্ঠতা বা সম্পর্ক। ফাঁদ পাতছে প্রেমের। সুযোগ বুঝে জিম্মি করছে সহজ-সরল নারীকে। একদিন উন্মোচিত হচ্ছে ভদ্রতার মুখোশ। ততদিনে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া সকল পথই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বরণ করতে হচ্ছে ধর্ষণের নির্মম পরিণতি। পৈশাচিক যৌন নির্যাতন। কখনো প্রথম সাক্ষাতেই ধর্ষিত হচ্ছে অসহায় নারী। এখন প্রায় প্রতি মাসেই দেশে এভাবে ধর্ষণ ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন কেউ না কেউ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইম্যান অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারপারসন তানিয়া হক বলেন, কিছুদিন আগেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ফেসবুকের পরিচয়ের পর নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে দেখেছি। এখন আমাদের দেশে তা প্রায়ই ঘটছে। তিনি বলেন, এখনই চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স বা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা না করা গেলে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে এটি। গ্লোবালাইজেশনের এ যুগে টেকনোলজির ভালো দিকের চেয়ে খারাপ দিকটাই বেশি ব্যবহার হচ্ছে। সন্তানদের ফেসবুক ব্যবহারে মা-বাবারও সচেতন হওয়া উচিত। আর ছেলেদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে নারীদের সম্মান দিতে শেখে।

পনের দিন আগের ঘটনা। প্রিন্স চৌধুরী বাপ্পী। ফেসবুকের রঙিন পরিচিতিতে একজন ব্যবসায়ী। জানুয়ারি ২০১৭। টার্গেট করে দশম শ্রেণির ১৪ বছরের এক মেধাবী ছাত্রীকে। ফেসবুকে আলাপের পর ওই মাসের শেষদিকে কিশোরীর মোবাইলফোন নম্বর সংগ্রহ করে। ফোন করে দেখা করতে চায়। জানতে চায় অবস্থান। ওই ছাত্রীর সম্মতি পায় নি। কিছুই জানায় নি তাকে। তবে কথার ভুলে মোহাম্মদপুরের স্কুলটির নাম বলে দেয়। সেটাই কাল হয় তার জন্য। পরদিন ২৯শে জানুয়ারি সকাল। স্কুলের সামনে আকস্মিক যুবকটিকে দেখে হতভম্ব ওই ছাত্রী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে জোর করে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় তুলে নেয়। তারপর মিরপুরে একটি ছয়তলা ভবনের ছাদে নিয়ে যায়। জোর করে ওই কিশোরীকে ধর্ষণ করে। এরপর ফেলে রেখে দ্রুত পালিয়ে যায় সে। ওই দিন সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। বেশ কয়েকদিন লেগে যায় সুস্থ হতে। এক-আধটু ফেসবুক ব্যবহার থেকে উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের আদরের ওই কনিষ্ঠ কন্যার এমন পরিণতিতে কালো ছায়া নেমে আসে পরিবারে। শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠছে। তবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে ওই মেধাবী ছাত্রী। তার ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বিগ্ন পরিবার। তাই মামলাও করতে চায় না মেয়েটির পরিবার। কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর গত মঙ্গলবার তাকে ওসিসি থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ওসিসির কর্তব্যরত চিকিৎসক ও পুলিশ কর্মকর্তার শত অনুরোধেও মামলা করতে অনীহা পরিবারের।

ওই ধর্ষিত মেয়ের পিতা বলেন, আগে ফেসবুক পরিচয়ে বা অপহরণ করে নারী ধর্ষণের খবর সংবাদপত্রে পড়েছি। এখন আমার পরিবারেই এমন ঘটনা ঘটতে দেখে আমরা হতভম্ব। এর আগে এমন বহু ঘটনা ঘটলেও অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি না হওয়ায় আজ আমার মেয়েও এ ঘটনার শিকার হলো। কিন্তু মামলা করেও তো কোনো লাভ নেই। বরং দীর্ঘসূত্রতা ও ভোগান্তিতে তার ভবিষ্যতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এর আগে ঘটে আরো ভয়াবহ ঘটনা। ফেসবুকের পরিচয়ে ধারাবাহিক ধর্ষণ। একে একে ১৩ নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠন। ধর্ষণের পর অপর একজনকে খুন করে ধরা পড়লো বরিশালের সায়েম আলম মিমু। ফেসবুকে পরিচয়ের ফাঁদে ফেলে এইচএসসি পাস করা নাইমা ইব্রাহিম ঈশীকে। বরিশাল শহরের হোটেল ফেয়ার স্টারে গতবছর ৯ই আগস্ট রাতে পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান ঈশীকে ধর্ষণ করে। তারপর খুন করে লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে পালায়। হাতিয়ে নেয় স্বর্ণালংকার ও হাতের মোবাইলফোন। এর আগে ধারাবাহিকভাবে ১৩ নারীকে ধর্ষণ ও ঈশীকে খুনের পর ৩০শে আগস্ট রাজধানীর মগবাজার থেকে গ্রেপ্তার হয় সে। বরিশালের ওয়ারী থানাধীন ৬০/১ যোগীনগর রোড এলাকার বাসিন্দা সেলিম মিয়ার পুত্র এই সায়েম আলম মিমু। গ্রেপ্তারের পর সে পুলিশকে জানায়, ফেসবুকে পরিচয়ের পর নারীদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতো। একইভাবে আরো ১৩ জনের সঙ্গে ফেসবুক পরিচয় থেকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার পর মোবাইল সেট, স্বর্ণালংকার, নগদ টাকাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নেয়। নারীদের দেহ ও সম্পদ লুটের জন্যই সে অভিনব কৌশলে ফেসবুকের অপব্যবহার করে যাচ্ছিল। নারীর বিশ্বাস ও গভীর ভালোবাসা আদায় করে একে একে তাদের চরম ক্ষতি করে যাচ্ছিলো।

এর আগে ফেসবুকে পরিচয়ের দু’মাস ধরে প্রতারণা করে গেছে তামিম নামে এক প্রতারক। সে নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বলে পরিচয় দেয়। সম্পর্ক গড়ে তোলে ২০১৬ সালে এসএসসি পাস করা কেরানীগঞ্জের এক কিশোরীর সঙ্গে। তারপর গতবছর ২২শে মে ওই ছাত্রীকে মোবাইলফোনে বলে আজ অবশ্যই দেখা করতে হবে। ওই ছাত্রীও সন্ধ্যায় কেরানীগঞ্জ থেকে বাসে চড়ে ঢাবি’র টিএসসি মোড়ে আসে। সাক্ষাৎ হয়। তাকে ভুলিয়ে বাংলামোটরের একটি হোটেলে নিয়ে যায়। কোমল পানীয়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়। তারপর রাতভর ধর্ষণ। পরদিন সকাল ১১টার দিকে বের হয়ে আবার টিএসসি মোড়ে যায়। ওই ছাত্রীকে সেখানে ফেলে রেখে গাঢাকা দেয় প্রতারক ধর্ষক। এরপর ওই ছাত্রীর পরিবারের লোকজন তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করে।

এর আগে রাজধানীর মিরপুরে ঘটে আরো এক ঘটনা। ২০১৫ সালের ২০শে জুন ফেসবুকের পরিচয়ের পর মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় ঘটে আরো ভয়াবহ অপরাধ। ফেসবুকের পরিচয় থেকে সাকিব এক কলেজছাত্রীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে। দেখা করার কথা বলে তাকে মিরপুরের একটি বাসায় নেয়। সেখানে তাকে ধর্ষণ করে। সঙ্গে থাকা তার দু’বন্ধু ওই অপকর্মের ভিডিও চিত্র ধারণ করে। কেড়ে নেয় ওই ছাত্রীর সঙ্গে থাকা দু’টি মোবাইলফোন, ল্যাপটপ ও দু’হাজার টাকা। ভিডিও চিত্র ধারণের পর তাকে জিম্মি করে দাবি করে ১০ হাজার টাকা। পরে ওই ছাত্রীর অভিযোগের পর পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে।

চট্টগ্রামে ভুয়া ফেসবুক আইডিতে নিজের তরুণ বয়সের ছবি ব্যবহার করে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে ফাঁদ পাতে নাছির উদ্দিন (৫৫) নামে এক ব্যক্তি। সেখানে নিজের পরিচিতি উল্লেখ করে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও তরুণ আইনজীবী হিসেবে। তখন সে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেও কর্মরত ছিল। ১৭ বছরের এক কিশোরীকে ফেসবুকের পরিচয় থেকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে। তারপর সাক্ষাতের কথা বলে গতবছর ২২শে অক্টোবর মুখোমুখি হয়। দেখা হতেই ভুল ভাঙে ওই কিশোরীর। এরপরই সে কেটে পড়ার চেষ্টা করতেই তাকে অপহরণ করে গাড়িতে তুলে নেয় নাছির। এরপর তাকে একটি বাসায় তুলে আটকে রাখে। এক-দু’দিন নয়। সেখানে তাকে টানা দু’মাস আটকে রেখে চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। ব্যর্থ হয় কিশোরী পালানোর সব কৌশল। অবশেষে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার অভিনয় করলে তাকে ওই ধর্ষক চিকিৎসকের কাছে নেয়। সেখান থেকে পালায় কিশোরী। এরপরই জানাজানি হয় এমন ফাঁদের কথা।
এব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ফেসবুকসহ তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ ও যথেচ্ছ ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। অথচ এক্ষেত্রে মনিটরিং নেই। এসবের অনেক ব্যবহার আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে সাংস্কৃতিক অসঙ্গতিও বাড়ছে। একটা নতুন প্রযুক্তি বা জিনিসের প্রচলন যখন শুরু হয় তখন তা যথেষ্ট মনিটরিং বা সচেতনতার আওতায় আসার আগ পর্যন্ত সাধারণত সংশ্লিষ্ট অপরাধও বাড়ে। সে হিসেবে ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকের পরিচয়ে ধর্ষণের ঘটনা আরো বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। এর সঙ্গে যথেষ্ট আলাপ-আলোচনা, সচেতনতা বৃদ্ধি, আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ বাড়লে এই নতুন অপরাধের লাগাম টানা যাবে। সূত্র: মানবজমিন

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন