বাংলাদেশে ৯৮ শতাংশ ফেসবুক ব্যবহারকারীই নিষ্ক্রিয়!

  07-09-2017 12:04AM

পিএনএস ডেস্ক: দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৯০ লাখ। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই নিষ্ক্রিয়। মাত্র ২ শতাংশ সক্রিয়। স্ট্যাটাস দেওয়া, নিউজ শেয়ার, লাইক, মন্তব্য ও বিতর্ক করাসহ বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তারাই জমিয়ে রেখেছেন সামাজিক যোগাযোগের এই ভার্চুয়াল স্পেস। আর সক্রিয়দের বেশিরভাগের আগ্রহ বিভিন্ন অনলাইন ও দৈনিকের খবরে। দেশের মোট ব্যবহার হওয়া (৪৩৬ গিগা) ব্যান্ডউইথের প্রায় ৮৮ গিগা ব্যবহার হয় ফেসুবকের পেছনে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি), ইন্টারনেট সেবাদাতা সংগঠন সূত্রে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী ইন্টারনেটের সেবার সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ৭ কোটি ৩৩ লাখেরও বেশি। এরমধ্যে বেশিরভাগই শুধু ফেসবুক ব্যবহারের জন্যই ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।

সামাজিক গণমাধ্যম বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উই আর সোশ্যাল’ ও ‘হুট সুইট’-এর এক জরিপে দেখা যায়, ফেসবুক ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। এখানে ২ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছেন। গত এপ্রিল মাসে প্রকাশিত এ সংখ্যা বর্তমানে ২ কোটি ৯০ লাখের মতো। অন্যদিকে ইন্টারনেট ওয়ার্ল্ডস স্ট্যাটস জানাচ্ছে ২০১৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী ছিল ২ কোটি ১০ লাখ। সে সময় বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল ৬ কোটি ৭২ লাখ ৪৫ হাজার। আর বিটিআরসির হিসাবমতে বাংলাদেশের বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৭ কোটি ৩৩ লাখ।

বাংলাদেশের মানুষ ফেসবুকে আসলে কী করে, সে বিষয়ে কোনও গবেষণা হয়েছে কিনা, এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি না। তবে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসানের ব্যক্তিগত ধারণা হলো, দেশের মোট ফেসবুক ব্যবহারকারীর মাত্র ২ শতাংশ সক্রিয়। মুক্ত সফটওয়্যার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজের ফলে তিনি বিষয়টি খুব নিবিড়ভাবে দেখেছেন। তিনি জানান, ‘ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করেন। এদের সংখ্যা সব মিলিয়ে সাড়ে ৫ লাখের মতো হবে। তারা ফেসবুকে মন্তব্য করেন, কোনও বিষয় নিয়ে বিতর্ক করেন, শেয়ার করেন। এরমধ্যে রয়েছেন সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, মার্কেটিয়ার ইত্যাদিরা।

মুনির হাসান বলেন, ২৫ শতাংশ ব্যবহারকারী ফেসবুকে মোটামুটি সক্রিয়। তারা সপ্তাহে গড়ে একবার হলেও ফেসবুকে ঢোকেন। বিশেষ কোনও উৎসব বা জন্মদিনে তারা সক্রিয় হন। জন্মদিনকে ঘিরে কিছু লাইক, কমেন্ট পেয়েই তারা খুশি। আর ৩০ শতাংশ ব্যবহারকারী ফেসবুকে কিছুই করেন না। তাদের মধ্যে অনেকে ফেসবুকে আইডি খুলতে হয়, তাই খোলেন। তাদের অনেকেই আবার ভুলে যান যে তার একটি ফেসবুক আইডি আছে।

অন্যদিকে ৪০-৪৩ শতাংশ ফেসবুক ব্যবহারকারী একেবারে নীরব। তাদের সম্পর্কে বিডিওএসএন-এর সাধারণ সম্পাদক বলেন, তারা ফেসবুকে ঢোকেন কিন্তু কিছুই করেন না। কোনও কিছুতে লাইক বা কমেন্ট করেন না। মাঝে মাঝে কোনও লিংক হয়তো ওপেন করে দেখেন। তারা লগইন করেন, ফলে তার ছাপ দেখা যায়।’ তিনি জানান, ‘এর ফলে বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ট্রেন্ডটা ঠিক বোঝা যায় না।’

এদিকে দেশের ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএপিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিম দেশে ফেসবুক ব্যবহারে কী পরিমাণ ব্যান্ডউইথ খরচ হয়, তার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। তিনি জানান, ‘বিভিন্ন আইএসপির ব্রডব্যান্ড (উচ্চগতি) ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যারা ফেসবুকে ঢোকেন, তাদের মধ্যে মধ্যবয়সীরা ফেসবুকের নিউজ ফিডে খবর পড়তে পছন্দ করেন। তবে গবেষণা না থাকায় একেবারে সুনির্দষ্ট কোনও তথ্য নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

আমিনুল হাকিম বলেন, ‘দেশে মোট ব্যবহার হওয়া ব্যান্ডউইথের মধ্যে (মোবাইলফোন অপারেটর ১১০ গিগা এবং আইএসপি ৩২৬ গিগা) ৮৮ গিগা ব্যবহার হয় ফেসবুকের পেছনে।’ তিনি জানান, ‘মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা প্রায় সারাক্ষণই ফেসবুক, মেসেঞ্জারে লগইন অবস্থায় থাকেন। মোবাইলফোন অপারেটরগুলোর ব্যবহার হওয়া ১১০ গিগা ব্যান্ডউইথের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যবহার হয় ফেসবুক ব্যবহারে। আর আইএসপিগুলোর গ্রাহকদের ব্যবহার হওয়া ৩২৬ গিগা ব্যান্ডউইথের মধ্যে ১০ শতাংশ তথা ৩২ দশমিক ৬ গিগা ব্যবহার হয় ফেসবুক ব্যবহারে।

গত কয়েকদিনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৩০ জনের বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা প্রত্যেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এর সাহায্যে বিভিন্ন কাজ করলেও মূলত ফেসবুকেই তাদের বেশি সময় ব্যয় হয়। কেউ কেউ আবার ফেসবুকে কম ঢুকলেও প্রায় সারাদিন মেসেঞ্জারে থাকেন। সব মিলিয়ে তারা গড়ে ৩-৪ ঘণ্টা ফেসবুকে কাটালেও মেসেঞ্জারে থাকেন ৮-১০ ঘণ্টা।

এদিকে ফেসবুক ব্যবহারের জন্য ইন্টারনেট কেনার পেছনে তাদের সবার মাসে ব্যয় হয় গড়ে ৩০০-৪০০ টাকা। এর মধ্যে সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকাও ব্যয় করেন তারা। ওয়াই-ফাই সংযোগের খরচ ধরলে ব্যয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে। ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যাদের ওয়াই-ফাই ব্যবহারের সুযোগ নেই, তাদের ফেসবুক ব্যবহারের খরচ কিছুটা বেশি।

তবে একটি বিষয়ে উল্লিখিত সব বয়সী ব্যবহারকারীর মধ্যে মিল রয়েছে। তারা সবাই দিনের অবসর সময় অনলাইনে কাটান। তরুণরা রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই অনলাইনে থাকেন বলে মত দিয়েছেন। এছাড়া দিনের অন্যান্য অবসর সময়েও তারা ফেসবুকে সময় ব্যয় করেন। অন্যদিকে কর্মজীবীরা অফিসের অবসর সময়ে ফেসবুক স্ক্রল করেন বলে জানান। তবে কর্মজীবীরা ফেসবুকে বেশি লগইন করেন অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে। সেই হিসাবে দেখা গেছে বিকাল সাড়ে ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বেশিরভাগ কর্মজীবী ফেসবুকে লগইন করেন। আর যারা মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে অপছন্দ করেন না, তারা ইউটিউবে লগইন করে কানে ইয়ারফোন গুজে গান শোনেন। কেউ কেউ ‍মুভিও দেখেন।

নিজের ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণ বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আফরিদা জেরিন প্রশা বলেন, ‘দিনের বেশিরভাগ সময়-ই নেটে যুক্ত থাকি। মূলত ফেসবুকই বেশি ব্যবহার করা হয়। আমাদের ক্লাস শিডিউল চেক করার জন্য নিয়মিত ফেসবুক গ্রুপ চেক করি। মেসেঞ্জারে বলতে গেলে সবসময়ই থাকি।’

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শাহেদ হাসান বলেন, ‘বেশ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করি। এরমধ্যে ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি সময় দেই। এটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।’

জানতে চাইলে অপসোনিন ফার্মাসিটিউক্যালস লিমিটেডের বিপণন বিভাগের কর্মকর্তা হাবীব কাজী বলেন, ‘মূলত ফেসবুক ব্যবহারের জন্যই ইন্টারনেট ব্যবহার করি। ফেসবুকে মজার সব ভিডিও দেখতে ভালো লাগে। এছাড়া ইউটিউবেও অনেক সময় দেই। রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত অনলাইনে বেশি থাকি।’

নিজের ইটারনেট ব্যবহারের যৌক্তিকতা বলতে গিয়ে গাজীপুরের উধুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কল্পনা আক্তার বলেন, ‘আমি রাত ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ইন্টারনেটে থাকি। ফেসবুক চালাই, খবর পড়ি। ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে নতুন সব কাপড়ের কালেকশন দেখি।’

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রওজাতুল জান্নাত জানান, ‘ফেসবুকে অনেক সময় যায়। বিশেষ করে নতুন ডিজাইনের জামা-কাপড় দেখতেই বেশি সময় ব্যয় হয়। সবচেয়ে বেশি থাকি মেসেঞ্জারে।’


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন