আমাজনের ক্ষমতার গোপন কথা

  25-04-2019 11:34AM


পিএনএস ডেস্ক: বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান আমাজনে যাঁরা নির্বাহী পদে চাকরি করেন, তাঁদের প্রতিবছর ছয় পাতার একটি পরিকল্পনা লিখতে হয়। ওই পরিকল্পনায় মেশিন লার্নিং (এমএল) কীভাবে ব্যবহার করবেন, সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বাধ্যতামূলক।

আমাজনের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা এ প্রশ্নের উত্তরকে মূল্যায়ন করেন সবচেয়ে বেশি। যাঁদের পরিকল্পনায় এমএলের গুরুত্ব কম থাকে, তাঁদের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে উৎসাহ কম দেওয়া হয়।

প্রশ্ন জাগতে পারে—এমএল কী? এমএল মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের (এআই) একটি রূপ, যা বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে তা কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় পূর্বাভাস দিতে পারে।

এমএল ও আমাজনে এর ব্যবহার নিয়ে ইকোনমিস্ট সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে যখন আমাজনে জেফ ওয়াইকি যোগ দেন, তখন থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে এমএলের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৫ সালের ১৬ জুলাই আমাজন প্রতিষ্ঠা করেন জেফ বেজোস। ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনলাইনে বই বিক্রি করাই ছিল বেজোসের প্রথম ব্যবসা। জেফ ওয়াইকি বর্তমানে জেফ বেজোসের সেকেন্ড ইন কমান্ড। তিনি ওয়ার্ল্ডওয়াইড কনজুমার সিইও পদে আছেন। আমাজনে যোগ দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলীদের নিয়ে তাঁদের দক্ষতা উন্নয়ন ও অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করতে একটি দল গঠন করেন ওয়াইকি। তিনি কর্মীদের নিজস্ব মূল্যায়ন ও উন্নতির জন্য একটি ধরন ঠিক করে দেন। দ্রুতই এ প্রক্রিয়ায় এমএল অ্যালগরিদম যুক্ত হয়। ওই এমএল অ্যালগরিদম ব্যবহার করে গ্রাহকেরা কোন বই পছন্দ করবেন, তার প্রস্তাব পাওয়া যেত। এরপর বেজোসের আকাঙ্ক্ষা বাড়তে শুরু করলে স্বয়ংক্রিয় ইনসাইট জানার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এমএল বিষয়টি শুধু আমাজনের মধ্যেই আর আটকে নেই; বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এখন এর পেছনে ছুটছে। ফেসবুকের চেহারা শনাক্তকরণ সফটওয়্যার, অ্যাপলের সিরি নামের ভার্চ্যুয়াল ডিজিটাল সহকারী বা অ্যালফাবেটের স্বচালিত গাড়িতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। তবে আমাজন এমএলের ক্ষেত্রে আরও বুনিয়াদি নীতি গ্রহণ করেছে। অ্যাপলের সিরির সঙ্গে পাল্লা দিতে ক্লাউডের ক্ষেত্রে অ্যালেক্সাকে নামিয়ে দিয়েছে আমাজন। তবে প্রতিষ্ঠানের সফলতার জন্য তাদের কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনা করতে অ্যালগরিদম আরও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত প্রতিক্রিয়া তারই একটি অংশ।

আমাজনের বিশাল ওয়্যারহাউসগুলোর কথা একবার ভাবুন তো! যুক্তরাষ্ট্রে ১০০টির বেশি আর বিশ্বের অন্যান্য দেশে ৬০টির মতো ওয়্যারহাউসে ২০ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের অনলাইন কেনাকাটার ব্যবসা চলছে। এরই মধ্যে একটি সিয়াটলের ওয়্যারহাউসে কাজ শুরু করেছে রোবট। আমাজন ওয়্যারহাউসে পণ্য রাখার পডগুলোয় সাজিয়ে রাখার কাজ করে এসব রোবট। টুথপেস্ট, বই, মোজার মতো জিনিসগুলো এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়, যা মানুষের কাছে একই কাজ বারবার করার মতো মনে হবে। অ্যালগরিদম লেন্সের মধ্যে দিয়ে এসব রোবটের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এখানে রোবটের সহকর্মী হিসেবে মানুষ রয়েছে। রোবট যেসব জিনিস এনে দেয়, তাদের কেউ তা প্যাকেট করে বা কেউ তা সংরক্ষণ করে। যখন কেউ পণ্য তুলে নেয় বা তা সংরক্ষণ করে, তখন তা স্ক্যান করে বারকোড দিয়ে রাখা হয়, তবে সফটওয়্যার ওই পণ্যের হিসাব রাখতে পারে।

এসব অ্যালগরিদম তৈরির দায়িত্বে রয়েছেন ব্র্যাড পর্টার। আমাজনের প্রধান রোবট নির্মাতা হিসেবে তিনি পরিচিত। তাঁর নেতৃত্ব যে দল আছে, তারা এমএল বিভাগের প্রধান জেফ ওয়াইকির সহায়তাকারী স্কোয়াড হিসেবে কাজ করে। পর্টার মূলত একটি রোবট পণ্য আনা–নেওয়ার ক্ষেত্রে কতটা সময় নিচ্ছে, সে হিসাব রাখেন। একটি তাক থেকে মানবকর্মীর কাছে পণ্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যদি সময় কম লাগে, তবে আমাজনের ক্ষেত্রে পণ্য ক্রেতার হাতে পৌঁছাতে সময় লাগে কম। পর্টারের টিম নতুন সুযোগের বিষয়গুলো নিয়ে ক্রমাগত পরীক্ষা চালাচ্ছে। তবে তাদের এ পরীক্ষার সময় যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয়। কারণ, ‘রোবটজ্যাম’ বেধে গেলে তো সর্বনাশ!

আমাজনের ক্ষেত্রে আরেকটি অবকাঠামো হচ্ছে তাদের ওয়েবসেবা বা আমাজন ওয়েব সার্ভিসেস (এডব্লিউএস)। বিভিন্ন কোম্পানির নিজস্ব সার্ভারের বদলে ওয়েব ও অ্যাপ হোস্টিং সেবা দেয় এটি। আমাজনের ২ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবসার মূলেও ওই এডব্লিউএস। কম্পিউটিংয়ের চাহিদার পূর্বাভাস দিতে এমএল এডব্লিউএসে ব্যবহৃত হয়। অপর্যাপ্ত কম্পিউটিং শক্তি হলে ওয়েবসাইটে নানা সমস্যা হতে পারে এবং পেজ ঠিকমতো লোড হবে না। এডব্লিউএসের প্রধান অ্যান্ডি জেসি বলেন, ‘আমরা কাউকে বলতে পারি না যে, আমাদের কম্পিউটিং শক্তি কম। তাদের কোনো সময় সে সমস্যা হবে না, তার নিশ্চয়তা দিতে হয়। এ কাজে তার দল গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহ করে। তাদের সার্ভারে কী রাখা হচ্ছে, আমাজন তা দেখে না। তবে ওই সাইটে ট্রাফিক বা ভিজিটর কত আসছে, তা জানতে পারে। একজন ভিজিটর বা গ্রাহক সাইটে এসে কতক্ষণ থাকে বা তারা কতটা বিশ্বস্ত, তাও জানার সুযোগ থাকে। এগুলোকে মেটাডেটা বলা হয়। আমাজন এসব মেটাডেটা মেশিন লার্নিং মডেলে ব্যবহার করে তাদের চাহিদা সম্পর্কিত পূর্বাভাস দিতে পারে।’

আমাজনের এডব্লিউএস সেবার বড় গ্রাহক আমাজন নিজেই। কারণ, আমাজনের অন্যান্য ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পূর্বাভাস জানা। এর চাহিদা এখন এত বেড়েছে যে আমাজনকে এর জন্য ‘ইনফেরেনশিয়া’ নামে একটি নতুন চিপ তৈরি করতে হয়েছে।

জেসি বলেন, ‘মেশিন লার্নিংসংক্রান্ত কাজে আমাজনের অর্থ সাশ্রয় করছে ইনফেরেনশিয়া। বাতি জ্বালিয়ে রাখা থেকে শুরু করে ক্লাউড সেবায় গ্রাহক আকর্ষণ করার মতো মেশিন লার্নিংয়ের কাজগুলোয় এ চিপ কাজে লাগানো যাচ্ছে।’ খরচ সাশ্রয় ও দক্ষতা উন্নয়নে এক অভূতপূর্ব উন্নতি বলা যায়। এ ছাড়া মানুষের কণ্ঠস্বর বুঝতে পারা ও অ্যালেক্সাতে মানুষের ভাষা বুঝতে পারার যে অ্যালগরিদম, তা এখান থেকে বিশেষ সুবিধা পাবে।

আমাজনের তৈরি হালনাগাদ অ্যালগরিদম উদ্যোগের নাম ‘আমাজন গো’। এটি মূলত দোকানদারবিহীন দোকান ব্যবস্থা। একটি দোকানে কয়েক শ ক্যামেরা বসানো থাকবে, যাতে ক্রেতাদের ওপর নজর থাকবে। ক্যামেরায় ধরা তথ্যগুলো থ্রিডি প্রোফাইলে রূপান্তরিত হবে এবং তাতে গ্রাহক হাত দিয়ে কোন পণ্য স্পর্শ করছে, তা ধরা যাবে। কোন পণ্য ক্রেতা নিচ্ছে, তা শনাক্ত করে বিল তৈরি করে আমাজন অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ নিতে পারবে এ সিস্টেম।

আমাজন গো বিভাগের প্রধান দিলীপ কুমার বলেন, ক্রেতার শরীরের নড়াচড়া ধরতে পারে তাদের সিস্টেম। এটি ফেসিয়াল রিকগনিশন বা মুখমণ্ডল শনাক্তকরণ ব্যবহার করে না। এটা দোকানের বারকোডে সোয়াইপ করলে কাজ করে। এটা এমএলের একটা আশীর্বাদ। শত শত ক্যামেরা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ক্রেতা কোন জিনিস কিনছেন, তা শনাক্ত করা যায় এতে। এ সিস্টেম এতটাই উন্নত যে একে বোকা বানানো বা ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করাও বিপদ। ‘নাইক ইনটেন্ট ডিটেকশন’ নামে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করেছে আমাজন। এতে ক্রেতার শরীরের নড়াচড়া শনাক্ত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হয়েছে। এর বাইরে পণ্য নজরদারির বিশেষ সিস্টেমও তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে দক্ষতার সঙ্গে দ্রুতগতিতে পণ্য পৌঁছে দেওয়া।

অবশ্য তথ্য সংগ্রহ নিয়ে ফেসবুক ও গুগল সম্প্রতি যে সমালোচনার মুখে পড়েছে, তার আঁচ লেগেছে আমাজনের গায়েও। আমাজন দাবি করে, তারা শুধু গ্রাহককে উন্নত অভিজ্ঞতা দিতে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। তারা বিতর্কিত কোনো কাজে গ্রাহকের তথ্য ব্যবহার করে না। মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগ ও সার্চ বিনা মূল্যে পায়, কারণ বিজ্ঞাপনদাতারা ফেসবুক ও গুগলকে অর্থ দেয়। বিনিময়ে বিজ্ঞাপনদাতারা এসব সেবা ব্যবহারকারীর তথ্য পায়। আমজনের ক্ষেত্রে তা নয়। নিয়ন্ত্রকেরা এখন অনলাইন কেনাকাটা ও ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে আমাজানের আধিপত্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

আমাজনের এখনকার ক্ষমতা এমএলের ওপর তৈরি হয়েছে। এ ক্ষমতা দিনকে দিন যে হারে বাড়ছে, তাতে কমে যাওয়ার আশঙ্কা এখন অমূলক।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন