বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক থেকে হ্যাকার, অতঃপর...

  04-09-2020 08:05AM

পিএনএন ডেস্ক : অতিথি শিক্ষক হিসেবে পড়াতেন বিদেশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। নামধামও ছিল বেশ। নিজেও পড়েছেন নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেশ-বিদেশে খ্যাতির কমতি ছিল না তার। বিশ্ববিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন ও মার্কিন সাময়িকী অনট্রাপ্রেনারের মতো ম্যাগাজিনে ছাপা হতো তার সাক্ষাৎকার। দেশি-বিদেশি অন্যান্য গণমাধ্যম তো আছেই। ফেসবুক-কমার্স বা এফ কমার্সের জন্য গ্রাহকসেবা সমাধান অর্থাৎ ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য কিনতে গ্রাহককে পুরো প্রক্রিয়ায় সহয়তার জন্য উদ্ভাবন করেছে চ্যাট বক্স ‘দ্য জেড বয়’। শুধু কি তাই, তিনি বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তথ্য-প্রযুক্তিবিদ হিসেবে নানা পদে কাজ করেছেন।

টাকা-পয়সার কমতিও ছিল না। তারপরও তিনি ডেবিড কার্ড হ্যাক করেছেন, কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এখন আছেন কারাগারে। তিনি হলেন বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তির জগতের প্রসিদ্ধ নাম নাজমুস সাকেব নাঈম। অথচ তিনিই কি না করেছেন এমন প্রতারণা।

জানা গেছে, পাপুয়া নিউগিনির ব্যবসায়ীর ভিসা কার্ড হ্যাক করে ৮ মাসে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, বাংলাদেশসহ ৯টি দেশ থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকার কেনাকাটা করেছেন বাংলাদেশি এই হ্যাকার। প্রতারণার শিকার ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াহেদ দীর্ঘ ৬ বছর বিভিন্ন দেশে ঘোরাঘুরি করে অবশেষে বাংলাদেশ পুলিশের আশ্রয় নেন তিনি।

তদন্তে নেমে পুলিশ তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় গত ২৫শে আগস্ট রাতে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে এক সহযোগীসহ ওই সাকেবকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পরপরই তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। রিমান্ড শেষে গত মঙ্গলবার আদালতে জবানবন্দি দেন সাকেব। জানা গেছে, ২০১৪ সালের জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে ৮০ দিনে মোট ১ হাজার ৪৭৩টি লেনদেনের মাধ্যমে সাড়ে তিন কোটি টাকা খরচ করেন তিনি। ওই কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে ৯টি দেশ থেকে দামি সফ্‌টওয়্যার, ম্যাকবুক, আইফোন কিনেন নাজমুস সাকেব। পাশাপাশি নিজের এন্টোপে অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ভার্চ্যুয়াল ভিসাকার্ড জেনারেট করে ৬৯ বারে ৯৯ হাজার মার্কিন ডলার তুলে নেন। আর নেটলার ইউকে অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে আরেকটি ভার্চ্যুয়াল ভিসা কার্ড জেনারেট করে আরও কয়েক হাজার ডলার হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এছাড়া থাই এয়ার ওয়েজে পরিবার নিয়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন সাকেব।

প্রতারক সাকেবকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পুলিশ। প্রতারণায় শিকার পাপুয়া নিউগিনিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি আবদুল ওয়াহেদের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ডিসেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি হয়। বাদী ওয়াহেদ পাপুয়া নিউগিনির শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেশ বেশ এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রতিষ্ঠানটি সে দেশের সুপার মার্কেট, সুপারশপ চেইন, ফাস্ট ফুড অ্যান্ড বেকারি, রেস্টুরেন্ট চেইন, ফিলিং স্টেশন, ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড লজিস্টিকস, কনটেইনার ইয়ার্ড, অ্যাপার্টমেন্ট ইত্যাদি ব্যবসায় জড়িত। আশির দশকে পাপুয়া নিউগিনিতে পাড়ি জমান ওয়াহেদ। সেখানে প্রথমে শিক্ষকতা করলেও পরে ব্যবসা শুরু করেন তিনি।

আবদুল ওয়াহেদ ২০০৭ সালে পাপুয়া নিউগিনির ব্যাংক সাউথ প্যাসিফিক লিমিটেডে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট খুলে ভিসা ইন্টারন্যাশনাল ডেবিট কার্ড গ্রহণ করেন। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের শেষদিকে ব্যবসায়িক কাজে সিঙ্গাপুরে যান তিনি। কাজ শেষে বাংলাদেশে আসার কথা। ব্যবসায়িক কাজ শেষে সিঙ্গাপুরের পার্কবয়েল হোটেলের বিল পরিশোধ করতে হোটেলের পজ মেশিনে নিজের ভিসা ইন্টারন্যাশনাল ডেভিট কার্ডটি প্রবেশ করাতেই মেশিনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে কার্ডটি রেস্টিক্টেড করা হয়েছে, তাই ব্যাংকে যোগাযোগ করতে হবে। পরে যোগাযোগ করেন ব্যাংক সাউথ প্যাসিফিক লিমিটেড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতারণামূলক বৈদেশিক লেনদেন সন্দেহে তার ভিসা কার্ডটি রিজেক্ট করা হয়েছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই লেনদেনের দায় আবদুল ওয়াহেদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ব্যাংকের এ দায়সারা বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করেন আবদুল ওয়াহেদ। ক্ষতিপূরণ দাবি করে পাপুয়া নিউগিনির ন্যাশনাল কোর্টে ব্যাংক সাউথ প্যাসিফিক লিমিটেডের বিরুদ্ধে মামলা করেন ওয়াহেদ। ব্যাংক সাউথ প্যাসিফিক লিমিটেড তার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে যে, আত্মীয় অথবা কর্মচারীকে কার্ডের তথ্য পাচার করে ওয়াহেদ নিজেই দাবিকৃত টাকা খরচ করিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবির পাশাপাশি ব্যাংকের সুনাম নষ্ট করেছেন। কিন্তু ওয়াহেদ এতে দমে জাননি। তিনি ক্ষতিপূরণ আদায়ের পাশাপাশি ব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণে আইনি লড়াই শুরু করেন। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশে মামলা করেন। ছয় বছর পর আসামি শনাক্ত ও গ্রেপ্তার হয়।

জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন তিনি। পরে অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, ডিজিটাল ডিস্ট্রিবিউশন, এন্ট্রি ফ্রড সুইট, কাউড অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউটেড কম্পিউটিং, ডিপ লার্নিং নেচারাল ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিংয়ে পড়াশোনা করেছেন সাকেব। সাকেবের তৈরি ‘পেখম’ অনলাইনে হোটেল বুকিংয়ের জন্য প্রসিদ্ধ বাংলাদেশের ৩৫০টির বেশি হোটেলের রুম ইনভেন্টরি বুকিং ডটকম ও এক্সপেডিয়ায় অটো আপডেট করার ব্যবস্থা করেন সাকেব। ইজিপেওয়ে (পেমেন্ট গেটওয়ে সার্ভিস প্রোভাইডার) প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ব্যাকবাস্টার ও সিলভার স্টিক্রন সিনেপ্লেক্সের ডিজিটাল টিকিট ব্যবস্থার প্রবর্তকও তিনি। সাকেব নন্দন গ্রুপের হেড অব আইটি, কডেরো লিমিটেডের সিইও, এসএসএল’র ওয়্যারলেসের হেড অব ই-কমার্স, জারস সলিউশনের সিইও হিসেবে কাজ করছেন। প্রতারক হ্যাকার নাজমুস সাকেব তার তৈরি পেখম অনলাইনে হোটেল বুকিংয়ের জন্য বিকাশ, ওয়ান ব্যাংক, যমুনা ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। পেমেন্ট গেটওয়ে সার্ভিস প্রোভাইডারও ইজিপেওয়ের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। থাইল্যান্ডের সিয়াম বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন সিভিল ব্যাংক নেপালের পরামর্শক হিসেবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, ২০১৪ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৮০ দিনে ওয়াহেদের আন্তর্জাতিক ভিসা কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। দেখা যায় যে, হ্যাকার অনলাইনে আটটি দেশ থেকে ১ হাজার ৪৭২টি লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এই মামলাটি আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা সফল হয়েছি।

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন