ইতিহাসের সাক্ষী: জলবায়ুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ 'জেট স্ট্রিম' আবিষ্কৃত হয়েছিল যেভাবে

  16-06-2021 03:55PM

পিএনএস ডেস্ক : বায়ুমণ্ডলের অনেক উপরে তীব্র গতির যে 'জেট স্ট্রিম‌' বা বায়ুপ্রবাহ, তাকে তুলনা করা যেতে পারে তীব্র স্রোতের এক নদীর সঙ্গে। পুরো পৃথিবীর পরিবেশ, জলবায়ু থেকে শুরু করে সবকিছুর ওপর এর একটা বিরাট প্রভাব আছে। ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্বে থাকছে এই জেট স্ট্রিম আবিষ্কারের কাহিনী।

জেট স্ট্রিম নিয়ে এই কাহিনির শুরু ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে।

যুক্তরাষ্ট্র তাদের নতুন তৈরি এক যুদ্ধ বিমান বি-২৯ ব্যবহার করা শুরু করেছে তখন।

আকাশে অনেক উঁচু দিয়ে যাওয়া এই নতুন ধরনের বোমারু বিমান পাঠানো হলো প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় জাপানের বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর বোমা হামলা চালানোর জন্য।

প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু দ্বীপের বিমান ঘাঁটি থেকে আকাশে উড়তো এই বিমানগুলো, এরপর দিনের বেলায় ৩৫ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে যেত জাপানের বিভিন্ন শহরে বোমা ফেলতে।

লেফটেন্যান্ট এড হায়াট ছিলেন এরকমই একটি বি-২৯ বোমারু বিমানের পাইলট।

বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, প্রায় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা ওড়ার পর তারা বোমা ফেলার জন্য বিমান নিয়ে আরও উঁচুতে ওঠে যেতেন, প্রায় ৩৭ হাজার ফুট উঁচুতে।

"এরপর আমরা আমাদের টার্গেটের দিকে বিমান ঘোরাতাম, যেটা ছিল টোকিওর উত্তর-পশ্চিম দিকে।"

এই বি-২৯ যুদ্ধ বিমানগুলোতে এমন ধরণের প্রযুক্তি জুড়ে দেয়া হয়েছিল, যার ফলে এগুলো দিয়ে কোন লক্ষ্যবস্তুর ওপর নির্ভুলভাবে বোমা ফেলা যেত। যুদ্ধবিমানটির সত্যিকারের গ্রাউন্ড স্পীডকে হিসেবে নিয়ে এটা করা সম্ভব হতো।

কিন্তু এসব বোমারু বিমানের পাইলটরা শীঘ্রই বুঝতে পারলেন, কোথাও একটা মারাত্মক ভুল হচ্ছে, তাদের বিমান আসলে অনেক বেশি দ্রুত উড়ে যাচ্ছে।

লেফটেন্যান্ট এড হায়াট বিবিসিকে বলেন, তারা যতবারই একটা টার্গেট খুঁজে পাওয়ার পর এর ওপর টেলিস্কোপ তাক করছিলেন, ততবারই ব্যর্থ হচ্ছিলেন। তখন তারা একজন রেডার অপারেটরকে গ্রাউন্ড স্পীড যাচাই করে দেখতে বলেন।

লেফটেন্যান্ট এড হায়াট বলেন, "রেডার অপারেটর আমাদের বললো, আমাদের টেইল উইন্ড হচ্ছে ১২৫ নটিক্যাল মাইল, আমরা যাচ্ছি ঘণ্টায় ৪৮০ মাইল গতিতে।"

"এটা একেবারে অসম্ভব। এখানে তো বাতাসের গতি সেরকম নয়। আমাদের আসলে যখন ৩৪০ মাইল বেগে যাওয়ার কথা, তখন আমাদের বিমান যাচ্ছে ঘণ্টায় ৪৮০ মাইল বেগে।"

"আমি বললাম বোমার বাক্সটা ফেল, ও তখন বোমা ফেললো বিমান থেকে। কিন্তু ততক্ষণে আমাদের বিমান আসলো টার্গেট ছাড়িয়ে ১২ মাইল সামনে চলে গেছে।"

এই পাইলটরা আসলে জানতেন না, তারা যার মধ্যে পড়েছিল, সেটা ছিল একধরণের বায়ুপ্রবাহ বা জেট স্ট্রিম।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর টিম ওলিংস জেট স্ট্রিম নিয়ে একটি বই লিখেছেন।

তিনি জানান, জেট স্ট্রিম আসলে এক ধরণের বায়ু প্রবাহ, কিন্তু এই বায়ুর স্রোত খুবই তীব্র, কিন্তু এর বিস্তার খুব বেশি নয়।

"আমি এটাকে বায়ুর সরু স্রোত বলছি, কিন্তু আসলে তার বিস্তার প্রায় একশো কিলোমিটার। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হতে সাত মাইলের মধ্যবর্তী জায়গায় এই জেট স্ট্রিম সবচেয়ে শক্তিশালী। এটি পুরো বিশ্বের চারিদিকে প্রবাহিত হয়। এটির বড় প্রভাব আছে আবহাওয়া এবং জলবায়ুর ওপর।"

পৃথিবীতে মূলত দুটি প্রধান জেট স্ট্রিম আছে: একটি গেছে উত্তর গোলার্ধ দিয়ে, আরেকটি জেট স্ট্রিম পুরো দক্ষিণ গোলার্ধের ওপর দিয়ে প্রবাহিত।

প্রফেসর টিম ওলিংস বলেন, বি-২৯ যুদ্ধবিমানের পাইলটরা আসলে এই জেট স্ট্রিমের মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু তারা কেউ আসলে জানতেন না যে এরকম একটা জেট স্ট্রিম সেখানে আছে।

"লোকে সন্দেহ করতো যে হয়তো অত উপরে ঘূর্ণিবায়ু আছে। আঠারো শতকেও লোকে সন্দেহ করতো, গ্রীস্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে যে আয়ন বায়ু প্রবাহিত হয়, তার উল্টো-ধরণের কিছু হয়তো নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু কেউ আসলে আশা করেনি একটা এত তীব্র আর এই প্রবাহ এত সংকীর্ণ। "

টার্গেটের ওপর বোমা ফেলতে ব্যর্থ হওয়ায় লেফটেন্যান্ট এড হায়াট এবং তার সহকর্মীদের জেরার মুখে পড়তে হয়।

"ওরা আমাদের মিশনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। ওরা আমাদের মোটেই বিশ্বাস করছিল না। ওরা বলছিল, জাপানে অত উপরে বাতাসের বেগ ঘণ্টায় ১৪০ মাইল হতেই পারে না। ওরা বললো, না, এরকম কিছু নেই। এরকম একটা বায়ুপ্রবাহ থাকতেই পারে না। তোমরা মিথ্যে বলছো। তোমরা টার্গেটে হামলা চালাতে পারোনি। এসব তোমরা বানিয়ে বলছো। "

"আমাদের অপারেশন্স অফিসার যদি যাত্রী হিসেবে আমাদের বিমানে না থাকতো, এটা বিশ্বাস করানো আসলে কঠিন হতো। ও বললো আসলেই এরকম একটা বায়ুপ্রবাহ সেখানে ছিল।"

জাপানে বি-২৯ যুদ্ধবিমানের আরও কিছু অভিযানের পর এই জেট স্ট্রিমের অস্তিত্বের প্রমাণ অস্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়লো। জাপানের উপরে আসলেই এরকম একটা তীব্র বায়ু প্রবাহ আছে, এবং এটি মার্কিনীদের জন্য সমস্যা তৈরি করছিল।

লেফটেন্যান্ট ডেভিড ব্রাডেন ছিলেন বি-২৯ বিমানের নেভিগেটর। তিনি দেখলেন, জেট স্ট্রীমের উল্টোদিকে উড়ে গেলে আসলে সামনে এগুনোই যায় না।


লেফটেন্যান্ট ডেভিড ব্রাডেন বলেন, "এই বাতাসের বেগ কতটা শক্তিশালী সেটা আপনাকে বলতে পারি। একবার একটা অভিযানের পর কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার ছবি তোলার জন্য একটা বিমান পাঠানো হলো। তখন ন্যাভিগেটর পাইলটকে কল করে বললেন, তারা আসলে প্রতি ঘণ্টায় তিন মাইল পিছিয়ে যাচ্ছেন।"

"আপনি যদি পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে বিমান উড়িয়ে যান, তখন আপনি কিন্তু জাপানি যুদ্ধবিমানগুলোর টার্গেটে পরিণত হবেন।"

এই জেট স্ট্রিম আবিষ্কারের পর মার্কিনীরা বাধ্য হলো তাদের কৌশল পরিবর্তন করতে, আর এর পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ।

দিনের বেলায় অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে গিয়ে একেবারে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করার পরিবর্তে মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলো রাতের বেলায় অনেক নিচু দিয়ে উড়ে গিয়ে নির্বিচারে বিধ্বংসী বোমা ফেলা শুরু করলো, যার ফলে জাপানের নগরীগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ আর প্রাণহানি ঘটতে লাগলো।

বি-২৯ যুদ্ধবিমানটি তৈরি করা হয়েছিল অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে গিয়ে একেবারে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতেই শুধু আঘাত হানার জন্য।

কিন্তু বাস্তবে সেটি করা যাচ্ছিল না। তখন এগুলোকে একেবারে নিচু দিয়ে উড়ে গিয়ে সবকিছুর ওপর নির্বিচারে বোমা ফেলতে হচ্ছিল।

এর মূল কারণ ছিল জেট স্ট্রিম, কারণ এই জেট স্ট্রিমের কারণে সঠিক টার্গেটে এগুলো আঘাত হানতে পারছিল না।

জাপানে অনেক উঁচু দিয়ে বয়ে যাওয়া এই তীব্র বায়ুর প্রবাহ হয়তো মার্কিনীদের কাছে একটা নতুন আবিষ্কার, কিন্তু একজন জাপানি বিজ্ঞানী কিন্তু বহু দশক আগেই এর অস্তিত্বের কথা জানতে পেরেছিলেন।

তার নাম ছিল ওয়াসিবোরো ওইশি। তিনি ছিলেন একজন জাপানি আবহাওয়াবিদ।

১৯২০ এর দশকে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় জাপানে ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে আকাশে একটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের। জাপানে তো বটেই, সারা পৃথিবীতে এটি ছিল এ ধরণের প্রথম কোন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র।

১৯২০ এর দশকে তিনি বেলুন ব্যবহার করে খুব সতর্কতার সঙ্গে কিছু পরীক্ষা চালালেন এবং দেখতে পেলেন জাপানে অত উপরে আসলে খুবই তীব্র বায়ুর প্রবাহ আছে।

তিনি জাপানে ভূপৃষ্ঠ থেকে সাত মাইল উপরে ঘণ্টায় প্রায় দেড়শ মাইলের তীব্র বায়ু প্রবাহ দেখতে পেলেন। বলা যেতে পারে, সেই প্রথম আসলে কেউ যথাযথভাবে কোন জেট স্ট্রিম মেপে দেখেছিল।

কিন্তু এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বাকী বিশ্ব যে জানতে পারেনি, তার একটা কারণ ছিল।

প্রফেসর টিম ওলিংস বলেন, "আসলে ওয়াসিবোরো ওইশি জানতেন যে তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিষ্কার করেছেন এবং তিনি তার এই আবিষ্কার বাকী দুনিয়াকে জানাতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি তার এই আবিষ্কার সম্পর্কে লিখেছিলেন নতুন এক ভাষা এসপেরান্তোতে, যেটি বিশ্বের নতুন আন্তর্জাতিক ভাষা হয়ে উঠবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ভাষাটি আসলে সেভাবে চালু করা যায়নি, কাজেই ওইশির এই আবিষ্কার হারিয়ে গিয়েছিল কয়েক দশকের জন্য।"

তবে ওইশির এই রিপোর্ট পড়েছিলেন জাপানের মানুষ। ১৯৪৪ সালে জাপানের সামরিক বাহিনী তার গবেষণাকে অন্য এক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা বোমার সঙ্গে বেলুন বেঁধে উড়িয়ে দেয় এই জেট স্ট্রিমের মধ্যে, এই আশায় যে, জেট স্ট্রিম এসব বোমা উড়িয়ে নিয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত। জাপানিরা এরকম হাজার হাজার বেলুন উড়িয়েছিল।

প্রতিটি বেলুন ইউনিটের সঙ্গে ছিল একটি গ্যাস ভর্তি একটি কাগজের ব্যাগ, এগুলো জাপান থেকেই আকাশে ওড়ানো হয়। কিন্তু বেশিরভাগ বেলুন আসলে সে পর্যন্ত যায়নি।

প্রফেসর টিম ওলিংস বলেন, "ওরা যখন এসব বোমা ছেড়েছিল, তারা জানতো না যে ঐ মৌসুমে জেট স্ট্রিম প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রমের সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। কাজেই সময়টা ভালো ছিল না। অনেক বেলুনই তারা আসলে আগে-ভাগে ছেড়ে দিয়েছিল। সেগুলো গিয়ে পড়েছিল ভূমধ্যসাগরে।"

এসব বেলুন বোমা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। একদল ছেলেমেয়ে খেলার সময় একটা বোমা খুঁজে পেয়েছিল ওরেগনের এক জঙ্গলে । এই বোমা ফেটে ছয়জন মারা যায়। কিন্তু এই বেলুন বোমার পরীক্ষা এবং জাপানে মার্কিন যুদ্ধবিমানের পাইলটদের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা গিয়েছিল এই জেট স্ট্রিম আসলে কত শক্তিশালী এবং এর প্রভাব কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। যুদ্ধের পর এই জেট স্ট্রিম নিয়ে অনেক গবেষণা হয়।

প্রফেসর টিম ওলিংস বলেন, জেট স্ট্রিম আসলে পৃথিবীর জলবায়ুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

"আমাদের আবহাওয়ার ওপর এটির নানা রকম প্রভাব আছে। এটি প্রতিটি আবহাওয়াকে পরিচালিত করে, আর উষ্ণ বায়ুমণ্ডল এবং ঠাণ্ডা বায়ুমণ্ডলের মাঝখানে একটা বাধা হিসেবে কাজ করে।"

" বেশিরভাগ অঞ্চলের আবহাওয়া নির্ধারণে জেট স্ট্রিম হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা এখনো পর্যন্ত যেটা বুঝতে পারি, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে, জেট স্ট্রিম হয়তো বিষুবরেখা থেকে সামান্য সরে আসবে, কিছুটা মেরু অঞ্চলের দিকে আসবে।"

বিজ্ঞানীদের আশংকা, জেট স্ট্রিমে পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে কোন অঞ্চলে ঝড় হবে, কোথায় ঠাণ্ডা বা গরম পড়বে, এসবের ভারসাম্য পাল্টে যেতে পারে।-বিবিসি

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন