রংমিস্ত্রি জহির আয়ের অর্ধেকই ব্যয় করেন জনকল্যাণে

  26-10-2016 01:31PM


পিএনএস, ঝিনাইদহ: পাখির বিশ্রাম আর আশ্রয়ের জন্য গাছে গাছে বাঁধা মাটির কলস। রাস্তার দুইপাশে সবুজ গাছের সারি। পথচারীদের বিশ্রামের জন্য পথের ধারে বেঞ্চ। দেয়ালে দেয়ালে লেখা মনীষীদের উপদেশবাণী। এসবই দেশের অন্য সব ইউনিয়ন থেকে ঝিনাইদহের কুমড়াবাড়িয়াকে আলাদা করেছে। আর এসব করেছেন ঝিনাইদহের জহির রায়হান যিনি পেশায় একজন রংমিস্ত্রি।

নিজের লাগানো গাছের নিচে নিজেরই হাতে গড়ে দেওয়া বেঞ্চে পথচলতি ক্লান্ত মানুষকে বিশ্রাম নিতে দেখে আপ্লুত হন জহির রায়হান। রংমিস্ত্রির কাজ করে যা আয় করেন তার ৫০ শতাংশ খরচ করেন সমাজের কল্যাণমূলক কাজে। নিজের সংসার কষ্টে চললেও হতদরিদ্র আট শিক্ষার্থীর পড়ালেখার খরচ দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবন্ধীদের বাড়িতে নিজ খরচে তৈরি করে দিচ্ছেন ফলদ ও বনজ বাগান।

সম্প্রতি তিনি শুরু করেছেন নিজের ব্যবহৃত বাইসাইকেলে বই রাখা। নাম দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। এলাকার বিভিন্ন বয়সের মানুষের কাছে তিনি এই বই বিতরণ করেন। পড়া শেষে আবার নতুন বই দিয়ে পুরাতন বইটি ফেরত নেন।

জহির রায়হান (৪৫) ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের দরিদ্র কৃষক মৃত কিয়াম উদ্দিন মোল্লার ছেলে। আর্থিক অনটনে লেখাপড়া করতে পারেননি। মাত্র আট বছর বয়স থেকে তিনি মাঠে ছাগল-গরু চরানোর কাজ শুরু করেন। এ সময় মাত্র দু-তিন মাস প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। পরে আবার নৈশ বিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়ালেখা করেন। অন্যের জমিতে কামলার কাজ করতেন। এখন মানুষের বাড়িঘর রং করার কাজটাই তার পেশা। এ থেকে মাসে গড়ে ১০ হাজার টাকা আয় করেন।

কৃষিজমি নেই। পাঁচ শতক জমির ওপর তার বাড়ি। স্ত্রী শাহনাজ বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করে মাসে তিন হাজার টাকার মতো আয় করেন। ছেলে তপু রায়হান (১৭) দ্বাদশ শ্রেণিতে ও মেয়ে সুমাইয়া রায়হান (১০) পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।

১৯৯০ সালের শুরুর দিকে একদিন গ্রামের জিল্লুর, এনামুল, সৌরভসহ কয়েকজনের সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন জহির। সেখানে দেশের মানুষের জন্য তারা কী করছেন বা করতে পারছেন, তা নিয়ে কথা হচ্ছিল। জহিরের মনে হলো আসলেও তো কিছুই করা হয়নি। ওই আড্ডার মাস দুয়েক পর জহির শুরু করেন দেয়াল লিখন ও বৃক্ষরোপণ। সারা দিন অন্যের বাড়িতে কাজ করে বিকেলে যেটুকু সময় পেতেন, রং-তুলি নিয়ে ছুটে যেতেন দেয়াল লেখার কাজে। দেয়ালের মালিকের অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন মনীষীর বাণী লিখতেন।

জহির জানালেন, দু-তিন মাস এভাবে গাছ লাগানো আর দেয়াল লেখার পর পড়ে যান আর্থিক সংকটে। গাছের চারা আর রং কেনা কষ্টকর হয়ে পড়ে। কিন্তু কাজ থামাতে রাজি নন তিনি। এ সময়ই স্ত্রী শাহনাজের সঙ্গে পরামর্শ করেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে ঠিক করেন, বাকি জীবনে যে টাকা আয় করবেন, তার অর্ধেক সমাজের কল্যাণে খরচ করবেন।

কষ্ট করে সংসার চালিয়ে কয়েকজন মেধাবী শিক্ষার্থীর পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছেন জহির। তারা হলো কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের আরিফ হোসেন, ধোপাবিলা গ্রামের সোহাগ হোসেন, হাবিবা খাতুন ও কনেজপুরের জেসমিন আক্তার, নগর বাথান এলাকার সুমি খাতুন, হামিরহাটির এলাকার শিমলা খাতুন, যাদবপুরের হালিমা খাতুন, ডেফলবাড়ীয়ার বাপ্পি, রামনগরের শাপলা। ইতিমধ্যে নিজ খরচে এক আনসার সদস্য’র সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন শিমলা খাতুনকে। লেখাপড়ার চালিয়ে যাচ্ছে সেও। এদের প্রত্যেককে এইচএসসি পর্যন্ত পড়ার খরচ দেবেন তিনি।

জহির দুঃখ করে বলেন, শুরুতে একবার ছন্দপতন ঘটেছিল তার কাজে। পয়সা খরচ করে দেয়াল লিখতেন, কিন্তু মানুষ সেগুলো মলমূত্র দিয়ে ঢেকে দিত। মানুষ বলাবলি করত, জহির নিজেই পড়ালেখা জানে না, তার লেখা আমাদের পড়তে হবে? এভাবে প্রায়ই লেখাগুলো মুছে দেওয়া হতো। তার লাগানো গাছগুলো উপড়ে ফেলা হতো। এসব কারণে মনে কষ্ট নিয়ে সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু বেশি দিন বসে থাকতে পারেননি। ২০০২ সালের পর আবার নতুন উদ্যমে শুরু করে আর থামেননি।

জহিরের ১৯৯০ সালের দিকে রোপণ করা গাছগুলো অনেক বড় হয়েছে। নগরবাথান বাজার থেকে শুরু করে কুমড়াবাড়িয়া, রামনগর, ডেফলবাড়িয়াসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর রাস্তা দিয়ে হাঁটলেই গাছগুলো চোখে পড়ে। বকুল, মেহগনী, নিম, অর্জুন, জলপাই, আমড়া, আম, জাম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন তিনি। জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ বিভিন্ন জেলায় তিনি গাছ লাগিয়েছেন কয়েক হাজার।

পথচারী শরিফুল ইসলাম বলেন, কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের রাস্তাগুলো আজ সবুজের ছায়ায় ঘেরা।

জহির বলেন, একসময় চিন্তা হয় গাছ লাগিয়ে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি অসহায় মানুষের কাজে কীভাবে তা লাগানো যায়। সেই চিন্তা থেকে রামনগর গ্রামের প্রতিবন্ধী সুমন মিয়া, একই গ্রামের ময়না খাতুন, ধোপাবিলা গ্রামের বাদশা মণ্ডল, কনোজপুর গ্রামের এনামুল ইসলামসহ আট প্রতিবন্ধীর বাড়িতে ৪০-৫০টি করে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়ে দিয়েছেন।

জহির এ পর্যন্ত ১০০০ দেয়ালে মনীষীদের বাণী লিখেছেন। প্রথম দিকে অনেকগুলো মুছে দিলেও বর্তমানে যেগুলো লিখছেন তা দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে।

কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘জহিরের এই লেখা বাণীগুলো অনেকেই পড়ছেন। শিক্ষণীয় এসব কথা মানুষের মন পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে।’

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সীমিত সামর্থের মধ্যেও নিজের স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে অন্যকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন জহির। তার মতো দেশপ্রেমিক সব এলাকায় থাকলে সমাজের অনেক উন্নয়ন হতো।’

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন