তাড়াশে তৈরি হচ্ছে সু-স্বাদু খেজুর গুড়

  20-01-2017 11:40PM

পিএনএস ডেস্ক: শীত এসেছে। সেই সঙ্গে এসেছে সিরাজগঞ্জের চলনবিলের সুস্বাদু খেজুরের রস ও গুড়ের মৌসুম। পৌষ-মাঘের ভরা মৌসুমে সু-স্বাদু খেজুর গুড় তৈরিতে রাত-দিন ব্যস্ত সময় পাড় করছেন সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার খেজুর গুড় উৎপাদনকারী গাছিড়া।
প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকে এই উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে গাছিদের তৈরি করা গুড় কিনতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন ব্যাপারিরা।
একই সঙ্গে পিঠা তৈরিকে কেন্দ্র করে গ্রামের বাড়িগুলো আনন্দ উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠেছে। আর পুরো শীত মৌসুম জুড়ে চলে বিভিন্ন ধরনের পিঠা খাওয়ার ধুম। বাড়ির উঠানে শীতের সকালে খেজুরের রস আর মুড়ি খাওয়ার আনন্দ চিরায়ত। তাই শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে সিরাজগঞ্জের বৃহত্তর চলন বিলাঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে অবহেলা আর অনাদরে বেড়ে ওঠা খেজুর গাছের পরিচর্যাও বেড়েছে।
স্থানীয় অনেকেরই অভিযোগ অতিরিক্ত মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও গাছিদের রসের সঙ্গে চিনি ব্যাবহারের ফলে চলন বিলের শত বছরের ঐতিহ্য খেজুর গুড় সু-ঘ্রাণ ও স্বাদ হারাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার প্রত্যন্ত দেশীগ্রাম, তালম, মাধাইনগর, ওয়াসিন, সগুনা ও সদর ইউনিয়নের রাস্তা বা পুকুরপাড়ে শত বছরের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৩০ হাজার খেজুর গাছ। এই এলাকাগুলোতে প্রতি বছরেই রাজশাহী ও নাটোর থেকে গাছিড়া ছুটে আসেন খেজুর রসের গুড় তৈরি করার জন্য।
রাজশাহী-নাটোরের গাছিদের পাশাপাশি স্থানীয় গাছিড়াও অগ্রহায়ণ মাস থেকে খেজুর গাছ ইজারা নিয়ে গাছ পরিস্কার, চুলা তৈরিসহ রস সংগ্রহের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করেন। পৌষের প্রথম থেকে খেজুরের রস নামতে শুরু করলে ব্যস্ততা বেড়ে যায় গাছিদের।
পৌষ-মাঘের প্রতিদিন দুপুর থেকে গাছে গাছে হারি ঝুলানো, ভোর রাতে সেই হারি নামিয়ে রস সংগ্রহের পর চুলায় জ্বাল করে পাটালি, দানা, ঝুড়াসহ নানা প্রকারের সু-স্বাদু গুড় তৈরি, তৈরি করা গুড় বিক্রির পর আবারও গাছে হাড়ি ঝুলানো, এই কর্মযজ্ঞে টানা দু-মাস ব্যস্ত থাকে গাছি ও তাদের পরিবারের অন্য সদস্যরা। এক মৌসুমে প্রতিটা গাছে ৩ কেজি গুড় ইজারা শুধানোর পরেও প্রতিটি চুলায় দিনে ৪০ থেকে ৫০ কেজি গুড় তৈরি করার পর গাছিড়া মৌসুমে আয় করে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
তাড়াশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে আরো জানা যায়, তাড়াশ ও চলনবিলে প্রায় ২শ হেক্টর জমির উপর প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। এ গাছ থেকে প্রতি বছর পাওয়া যায় ১ হাজার ৫৫০ মেঃ টন রস। যা দিয়ে তৈরি হয় ১ হাজার ৩৫০ মেঃ টন গুড়। একশত টাকা কেজি দরে এই গুড়ের বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা।
সুদীর্ঘকাল ধরে সিরাজগঞ্জের বৃহত্তর চলনবিল খেজুরের রস ও গুড় উৎপাদনে এগিয়ে রয়েছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও উপজেলার ওয়াসিন, চারমাথা, ভোগলমান, মাঝদক্ষিণা বাজার, দেশিগ্রাম, গুড়পিপুল, চৌড়া, মানিক চাপড়, বস্তুল, বিনসাড়াসহ বেশ কয়েকটি স্পটে খেজুর গাছের চাষিরা রস দিয়ে পাটালি গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সিরাজগঞ্জের চলন বিলের তৈরি সুস্বাদু খেজুরের গুড়ের চাহিদা রয়েছে সারাদেশেই। চলনবিলসহ স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে খেজুরের গুড় যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। এদিকে গুড়ের মান ও স্বাদ ভালো হওয়ায় ব্যাপক চাহিদা থাকলেও সঠিকভাবে বাজারজাতকরণের অভাবে খুব বেশি লাভের মুখ দেখছে না গুড় চাষিরা।
আমন ধান কাটা শেষে খেজুর রসে তৈরি শীতকালিন পিঠাপুলির উৎসব চলন বিল অঞ্চলের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য শত বছর যাবৎ রক্ষা করা খেজুর গুড় উৎপাদন এখন অনেকটাই বাণিজ্যিক রুপ ধারণ করেছে। কিন্তু এই বাণিজ্যিক প্রসারের কারণে গাছি ও ব্যাবসায়ীদের খাটি রসে মাত্রার চেয়ে অধিকহারে চিনি ও হাইডোজ ব্যবহারের ফলে সু-ঘ্রাণ ও স্বাদ অনেকটাই কমেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
তারপরও ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি গুড়ের চুলার পাশে ভিড় জমে স্থানীয়দের। এই গুড় ক্রয়-বিক্রয় হয় ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি হিসেবে। ভিড় করা মানুষগুলোর দাবি খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য রক্ষায় চিনি ও হাইডোজ ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে প্রশাসন।
জেলার তাড়াশে খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ করা প্রতি এক মণ রস চুলায় জ্বাল করার পরে বিক্রি উপযোগি ৪ কেজি পাটালি, ৫ কেজি দানা, ৭ কেজি ঝুলাগুড় পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে চিনি, হাইডোজ ব্যবহার বন্ধ ও খেজুর গাছ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে আঞ্চলিক ঐতিহ্য রক্ষা করার পাশাপাশি গাছি হিসেবে স্থানীয় বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে সংশ্লিষ্ট দপ্তর এমনটাই প্রত্যাশা তাড়াশবাসীর
তাড়াশ উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হক বলেন, খেজুর গাছ বৃদ্ধি ও প্রশাসনিক নজরদারি বৃদ্ধি করে আঞ্চলিক ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। এবিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে তিনি আহ্বান জানান।
তাড়াশ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. হাসান ঈমাম জানান, খেজুর গাছ বৃদ্ধিতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। এই নির্দেশনা অনুযায়ী গত দুই বছর যাবত নিয়মিতভাবে খেজুর গাছ লাগানো হচ্ছে উপজেলার বিভিন্নস্থানে। বৃহত্তর চলনবিলের খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য রয়েছে। এখানকার উৎপাদিত খেজুরের গুড় বিভিন্ন জেলায় রফতানি হয়।

পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন