আদালত থেকে ধরে নিল পুলিশ, নিহত ‘বন্দুকযুদ্ধে’

  26-02-2017 08:15AM

পিএনএস, খুলনা: এক হাত নাই, আর হাত পঙ্গু। হাত-কাটা জিয়া, যাকে পুলিশ আদালত থেকে বৃহস্পতিবার দুপুরে আটক করেছিল। একজন পঙ্গু-সে কীভাবে রাত দুটাই ডাকাতির প্রস্তুতি নিতে পারে? আবার ৫-৬ জন দলের মধ্যে পুলিশের সাথে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’সে একাই নিহত হয়? বিষয়টি নিয়ে নগরজুড়ে মানুষের মধ্যে এ ধরনের নানা প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে সচেতন মহল। এভাবে যদি পুলিশ ম্যানেজ হয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাতে থাকে–তাহলে কেউ কি আমরা নিরাপদ?

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক মন্ত্রী মরহুম সালাহউদ্দিন ইউসুফের কাছে আলমগীর হোসেন ওরফে আলম তার সহযোগিদের নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। আলম পরে থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও নির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং চমরপন্থি মৃণালের সহযোগি হিসাবে ভারতে নিহত হন। আলমের সহযোগি ক্যাডার হিসাবে মূলত জিয়া সানা ওরফে হাতকাটা জিয়ার উত্থান। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সে সময়ের আন্দোলনের জন্য বোমা বানাতে গিয়ে এই জিয়ার একটি হাতের কবজি বোমায় উড়ে যায়। আওয়ামী লীগ নেতা ও সম্প্রতি হয়ে যাওয়া জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী অজয় সরকার জানান, হাতকাটা জিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাথে জড়িত। ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগে যোগদানের পর অন্য কোন দলে যায়নি। দলের প্রতিটি কর্মসূচিতে সে অংশ নিত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলা পরিষদ নির্বাচন আর খুলনার কৈয়া বাজারের মাদক ব্যবসার ভাগাভাগি বিরোধ নিয়ে একটি মহল পুলিশকে অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করে জিয়া সানা ওরফে হাতকাটা জিয়াকে কথিত বন্দুকযদ্ধের ঘটনা ঘটায় বলে অভিযোগ উঠেছে।

এই সূত্র জানায়, খুলনা–সাতক্ষীরা সড়কের পাশে অবস্থিত কৈয়া বাজারটি বর্তমানে মাদক ব্যবসার ট্রানজিট রুট। প্রতি মাসে মাদক ব্যবসা থেকে প্রভাবশালী মহল ৮-৯ লাখ টাকা ভাগবটোয়ারা করে থাকে। হাত–কাটা জিয়া এই টাকার ভাগ দাবি করেছিল। কৈয়া বাজারের নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে প্রতিপক্ষের কোপের আহত হন ৩ জন। এই মামলায় হাতকাটা জিয়াকে আসামি করা হয়। সেই মামলায় আত্মসমর্পণ করতে বৃহস্পতিবার মুখ্য মহানগর আদালতে হাজির হয় হাত কাটা জিয়া। এ্যাডভোকেট মৃণাল রায়ের ওকালতনামায় স্বাক্ষর দিয়ে সে আদালত কক্ষের বাইরে অবস্থান করছিল হাকিমের ডাকার অপেক্ষায়। এই সময় ড্রেস পরিহিত ১ জন এবং ২ জন সাদা পোশাকের পুলিশ এসে হাতকাটা জিয়াকে তুলে নিয়ে যায়। এ্যাডভোকেট মৃণাল রায় বৃহস্পতিবার দুপুরে আদালতকে অবহিত করেন যে, তার মক্কেলকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে।

সেদিনই আইনজীবীদের পরামর্শে হাতকাটা জিয়ার ভাই আব্দুর রহিম সানা বৃহস্পতিবার দুপুরেই খুলনা প্রেস ক্লাবে এসে তার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবার কথা বলে সংবাদ সম্মেলন করেন। লিখিত বক্তব্য তিনি বলেন, একজন পোশাকধারী পুলিশ এবং ২-৩ জন সাদা পোশাকের পুলিশ তার ভাইকে গাড়িতে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যায়। তিনি সেই সময় দাবি করেন তার ভাই দোষি হয়ে থাকলে আইনের মাধ্যমে বিচার করা হোক। তার ভাইকে ক্রসফায়ার দেওয়ার জন্য পুলিশকে টাকা দেওয়া হয়েছে। কৈয়া বাজারের ব্যবসায়ীরা চাঁদা তুলে পুলিশকে দিচ্ছে বন্দুকযুদ্ধের নামে জিয়া সানাকে হত্যার জন্য। এই আশঙ্কার কথা সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়েছিল।

এ ব্যাপারে হরিণটানা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, জিয়া সানার নামে হত্যাসহ ৯টি মামলা রয়েছে। বন্দুকযুদ্ধে হাতকাটা জিয়া নিহত হওয়ার খবর শুনে এলাকায় স্বস্তি ফিরে এসেছে। বৃহস্পতিবার রাতে হাতকাটা নিজে ডাকাতির প্রস্তুতি নেওয়ার সময় তাদের সাথে গুলি বিনিময় হয়। এতে চার পুলিশ কনস্টেবল আহত হয়ে পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এই সময় টিমের সাথে তিনিও ছিলেন। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আহত পুলিশের শরীরের গুলির ছররা লেগেছিল। তিনি হাতকাটা জিয়াকে দুপুরে আটক করার কথা অস্বীকার করেন।

হাতকাটা জিয়াকে নিয়ে পুলিশের ডাকাতির প্রস্তুতির কথা শুনে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আগে থেকে পুলিশ বুঝলো কি করে, যে হাত কাটা জিয়া ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে? পুলিশকে রাজনৈতিক ব্যবহারের ফলে দেশের জনগণকে এক সময় মাশুল দিতে হবে। নিহত হাতকাটা জিয়াকে মৃণাল বাহিনীর সদস্য কেউ বা সেকেন্ড ইন কমান্ড বলছে। কিন্তু এক সময়কার মৃণালের অন্যতম দোসর, উপদেষ্টা যাদের নামে ৫০-৬০টা মামলা ছিল তাদের কেন পুলিশ প্রোটেকশন দিচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী এ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম এ ব্যাপারে বলেন, বিচার বহির্ভূত যে কোন হত্যাকাণ্ড নিন্দনীয়। আদলতের আত্মসমর্পণ করা কোন ব্যক্তি পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়া আদালত অবমাননার সামিল। এ ধরনের ঘটনা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সংবিধানপরিপন্থী কাজ।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘অধিকার’এর খুলনা ফোকাল পারসন মো. নুরুজ্জামান হাতকাটা জিয়াকে নিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধকে হত্যাকাণ্ড আখ্যা দিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন। তিনি এই ঘটনাকে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন আখ্যা দিয়ে দোষি পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন