যুদ্ধের পর এই প্রথম এত্ত লাশ দেখলাম

  25-06-2017 04:00PM


পিএনএস, লালমনিরহাট: ৭১ সালের কথা, সেই ছোট বেলায় যুদ্ধের শব্দ শুনেছি, ওই সময় এক সাথে অনেকগুলো লাশ দেখেছি। তখন মনে করতাম যুদ্ধ হলেই বুঝি অনেক লাশ এক সাথে দেখা যায়। কিন্তু ৪৬ বছর পর আবার আমার এলাকায় এত্ত লাশ দেখে চোখে জল এসেছে। কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন সামসুল হোসেন।

লোক সমাগমে কানায় কানায় পুর্ন চন্দ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদ মাঠ। সবার চোখে মুখে উৎবেগ উৎকন্ঠা। স্বজন হারানোর বেদনায় কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে চারদিক। বিশেষ করে বৃদ্ধ লোকরা বলছেন এ যেন নতুন করে যুদ্ধ হলো। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ১০টি মরদেহবাহী ৩টি এ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছে ইউপি মাঠে।

এ্যাম্বুলেন্সগুলোর গেট না খুলতেই উৎসুক জনতা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে প্রিয়জনের মরদেহটি খুজতে চেষ্টা করেন। যে ছিল তার বেঁচে থাকার এক মাত্র অবলম্বন। যে ছিল ওই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

পরে একে একে ১০টি মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ ইউএনও শাহীনুর আলম।

নিহত ১০ জনই এ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। তারা সবাই পোশাক ও কাঠ শ্রমিক।

এ সময় প্রতিবেশীর মরদেহ দেখতে ওই মাঠে আসা বয়োবৃদ্ধ আফাজ উদ্দিন জানান, যুদ্ধের পরে বুঝি এই প্রথম এত্তগুলো লাশ দেখলাম এক সাথে। এর আগে কখনো দেখিনি।

মরদেহ বুঝে নেয়ার পর ওই এ্যাম্বুলেন্সে বাড়ি বাড়ি মরদেহ পৌছে দেয়া হয়। মরদেহ বাড়িতে পৌছলে আত্মীয়-স্বজনের আহাজারীতে বাতাস ভারি হয়ে উঠে।

এক সাথে দুই সন্তানের মরদেহ দেখে সজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছেন সাদ্দাম হোসেন ও আলমগীর হোসেন মা জড়িনা বেগম। কখনো জ্ঞান ফিরলেই চিৎকার মেরেই থেমে যাচ্ছেন। দুই ছেলের মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন আইয়ুব আলী। তার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল দুই ছেলেই ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। দুই পুত্রবধু আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঈদে বাসের চাপ বাড়বে বলেই দুই নাতনীকে রমজানের শুরুতে নিজেই ঢাকা থেকে নিয়ে আসেন আইয়ূব আলী।

এ আইয়ুব আলী শুধু দুই ছেলেকে নয় বড় ছেলে সাদ্দামের শ্যালক দেলোয়ার হোসেনও মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হয়েছে।

শনিবার সকাল ৬টার দিকে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার কলাবাগান এলাকায় ট্রাক উল্টে তাদের পাশ্বের গ্রামের আরো ৭ জনসহ ওই ইউনিয়নের মোট ১০ জনের মৃত্যু ঘটে। এ দুর্ঘটনায় আদিতমারী উপজেলার ২ জনসহ মোট ১৭ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

নিহতরা হলেন- কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের লতাবর গ্রামের আইয়ুব আলীর ছেলে আলমগীর (৩০), ছোট ছেলে সাদ্দাম হোসেন (২৮), খাঙ্গার চওড়া গ্রামের মনোয়ারের ছেলে মনির হোসেন (২২), ঘোঙ্গাগাছ গ্রামের সৈয়দ আলীর ছেলে দেলোয়ার হোসেন (২৫), চাপারহাট গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে মজনু মিয়া (২২), ঝন্টু মিয়ার মেয়ে সুবর্ণা আক্তার(৮), উত্তর বত্রিশ হাজারী গ্রামের আহমেদ আলীর ছেলে কোহিনুর ইসলাম (৪০), আশরাফুলের ছেলে সহিদুল ইসলাম (৩৫), শাহজামানের কলেজ পড়ুয়া ছোট ছেলে মোহসিন আলী (১৯) ও বড় ছেলে আনোয়ার হোসেন (২২)।

আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা গ্রামের আব্দুল খালেকের ছেলে রবিউল ইসলাম (২৮) ও একই এলাকার বড়াইবাড়ি গ্রামের আইয়ূব আলীর ছেলে আজিজুল ইসলাম (২২)।

মরদেহ হস্তান্তর শেষে কালীগঞ্জ ইউএনও শাহীনুর আলম জানান, রংপুর জেলা প্রশাসন নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার ও আহতদের পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপুরণ ঘটনাস্থলেই প্রদান করেছে। এ ছাড়াও লালমনিরহাট জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে আরো ক্ষতিপুরণ দেয়া হবে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন