বিচার দেখে মরতে চান মাহাবুবুরের বাবা-মা

  21-08-2017 12:32AM

পিএনএস ডেস্ক: ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী কুষ্টিয়ার খোকসার ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুবুর রশিদ। তার বৃদ্ধ বাবা-মা মৃত্যুর একদিন আগে হলেও খুনিদের বিচার দেখে যেতে চান। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে এটিই এখন তাদের একমাত্র চাওয়া।

প্রতিদিন ফজরের নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে মাহবুবুরের বাবা বৃদ্ধ হারুন অর রশিদের দিন শুরু হয়। মোনাজাতের সময় তিনি দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে ছেলের খুনিদের বিচার চান, আর চান বাবাহারা দুই নাতি যেন তার বাবার মতো সৎ মানুষ হতে পারেন।

মাহবুবুরের মৃত্যুতে বৃদ্ধ বাবা হারুন অর রশিদের সব স্বপ্ন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে ছেলের রেখে যাওয়া বিবর্ণ সব স্মৃতি, স্বপ্ন আর হতাশার মধ্যেও কিছু প্রাপ্তি তার মনকে কিছুটা হলেও পুলকিত করে। শনিবার সকালে কুষ্টিয়ার খোকসার জয়ন্তিহাজরা ইউনিয়নের ফুলবাড়ি গ্রামে নিজ বাড়িতে কথা হয় কর্মব্যস্ত বৃদ্ধ হারুন অর রশিদের সঙ্গে।

ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হারুন অর রশিদের মুখ দিয়ে আক্ষেপের কথাগুলো বেরিয়ে আসছিল। অবিবাহিত ছোট মেয়ে আবিদার একটি সরকারি চাকরি হওয়ার খবর দিয়ে প্রাপ্তির কথা শুরু। তিনি দাবি করেন, স্ত্রী শামীমা আক্তার আসমা এবং দুই পুত্র আশিক ও রবিনকে নিয়ে জীবন যুদ্ধে সফল সৈনিক ছিলেন মাহবুবুর। সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নিহত সৈনিকের শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত ফুলবাড়ি স্কুলের পাশের কবরস্থানের সমাধিস্থলটি পাকা করে দেয়ার পর থেকে তিনি সেখানেই অবসর সময় কাটান। কিন্তু রাস্তা না থাকায় বৃষ্টির পানিতে সেখানে নিয়মিত যেতে পারছেন না।

মাহবুবুরের বাবা বলেন, গ্রিল না থাকায় দৃষ্টিনন্দন সমাধিস্থলটির ওপর শেয়াল-কুকুর চলাফেরা করে। এটি সংরক্ষণের জন্য কবরস্থানের সীমান প্রাচীর, রাস্তা ও বিদ্যুতের সংযোগ খুবই জরুরি।

ছেলে হত্যার বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওইদিন ইতিহাসের নিকৃষ্টতম হামলা হয়েছিল। কিন্তু এখনও বিচার হচ্ছে না। বিচার বিলম্বিত হওয়ায় আমি খুবই হতাশ। মামলাটির দ্রুত বিচার এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বাস্তবায়ন দেখে মরতে চাই আমি।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে তেমন কোনো সহায়তা পান না বলেও আক্ষেপ প্রকাশ করেন বৃদ্ধ এই বাবা। মাহবুবুরের বয়োবৃদ্ধ মা হাসিনা বেগম ও অবিবাহিত মেয়ে (মাহবুবুরের বোন) আবিদাকে নিয়ে যত না দুঃশ্চিন্তা তার চেয়ে বেশি চিন্তা দুই নাতি ও পুত্রবধূর ভবিষৎ নিয়ে।

শত কষ্ট ও হতাশার মধ্যেও নিহত ছেলেকে নিয়ে গর্বিত এই বাবা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘাতকদের বুলেট থেকে রক্ষায় তার ছেলে জীবন উৎসর্গ করেছেন- এটি ভাবলে এখনও গর্বে বুক ভরে যায় হারুন অর রশিদের।

এক সময় বিড়ি তৈরির কারিগর হারুন অর রশিদের দ্বিতীয় পুত্র মাহবুবুর। বাড়ির পাশের ফুলবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার লেখাপড়ার হাতে খড়ি। পাশের উপজেলা পাংশার বাহাদুরপুর শহীদ খবির উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৪ সালে এসএসসি পাশ করেন। নিজের চেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিক পদে নিয়োগ পান। এতে দরিদ্র বাবার সংসারে একমাত্র আশার প্রদীপ জ্বলে ওঠে।

ছোট চাকরির আয়ে সংসারের উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হলেও তিন বেলা অন্ন নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতে হতো না। পাঁচ বোনের তিন বোনকে বিয়েও দেন। ছোটদের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। সতীর্থ সৈনিকদের মাধ্যমে খবর পেয়ে ২০০০ সালের দিকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসাবে যোগ দেন।

বিশ্বস্ততা অর্জন করায় অল্প সময়ের মধ্যে নেত্রীর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর দায়িত্ব পান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে বর্বর গ্রেনেড হামলার সময় দায়িত্বপালন করতে গিয়ে নিহত হন মাহবুবুর।

কুষ্টিয়া-৪ (খোকসা-কুমারখালী) আসনের সংসদ সদস্য আব্দুর রউফ জানান, মাহবুবুরের লাশ গ্রহণ থেকে শুরু করে সমাধি পর্যন্ত তার টাকায় নির্মিত হয়েছে। অবশ্য সমাধির গায়ে লাগানো ফলকে জেলা প্রশাসনের নাম লেখা। অল্প সময়ের মধ্যে কবরস্থানে যাওয়ার রাস্তা নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হবে বলে জানান এই সংসদ সদস্য। তিনি সব সময়ই নিহত মাহবুবুরের পরিবারের পাশে রয়েছেন বলেও দাবি করেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিনা বানু জানান, নিহত দেহরক্ষী মাহাবুবুরের সমাধিস্থল ও কবরস্থানের উন্নয়নের জন্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চেয়ে পাঠানো হয়েছে। নিহতের ভাই-বোনদের চাকরি, বৃদ্ধ বাবার নামে আজীবন ভিজিডি ও বয়স্ক ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা দেয়া হয়েছে।

পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন