সিন্ডিকেটের খপ্পরে রোহিঙ্গারা

  19-09-2017 02:44PM

পিএনএস ডেস্ক : রোকসানা (২১)। কোলে দেড় বছরের ফুটফুটে ছেলে। বোরখা পরা। মুখ খোলা। পায়ে জুতো নেই। মুখ দেখেই মনে হলো সচ্ছল কোনো পরিবারের সদস্য। আগুন আর গুলিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে আসলেও বিপদ যেন এখনো তাকে তাড়া করে ফিরছে।

চোখে মুখে যেন আতংকের ছাপ। শনিবার দুপুর ২টা ছুঁই ছুঁই। শাহপরীর দ্বীপে দেখা মিললো রোহিঙ্গা এই নারীর সাথে। কাছে যেতেই আৎকে উঠলেন। নাম জিজ্ঞাসার সাথে সাথে বললেন। তবে কেন এই আতংক উত্তর খোঁজার চেষ্টা। বাঁচার আকুতি আর মনোবলকে সম্বল করে ছোট্ট এই ছেলেকে নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন।

দীর্ঘ পথে প্রতিটি ক্ষণই তাদের তাড়া করছে ভয়াল মৃত্যু। বৃহস্পতিবার মায়ানমার উপকূল থেকে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকায় উঠেছিল রোকসানা। বোটের মাঝিরা দাবি করলো ৫ হাজার টাকা। টাকা না থাকায় তার হাতের সোনার বালা দিতে হলো। মাঝিদের দাবি এটাই হবে না। কানের দুলও দাও। অবশেষে কানের দুল দিয়ে সেখান থেকে রক্ষা।

হাতে টাকা নেই আর যাওয়ারও উপায় নেই। তাই ছেলেকে নিয়ে বসে আছে। অন্যদের মতো হাত পেতে সাহায্যও চাইতে পারছে না। ছেলের বাবা কোথায় উত্তর জেলে নৌকায় তুলে দিয়ে বলেছিল তোমরা যাও। বাবা, মা ও ছোট বোনের লাশ দাফন করে আমি ফিরছি।

জানা গেছে, টেকনাফের শামলাপুর থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ২০টি নৌঘাটে ২ হাজারের বেশি ফিশিং বোট রয়েছে। এসব ফিশিং বোট এখন মৎস্য শিকারের পরিবর্তে মায়ানমার উপকূল থেকে রোহিঙ্গা বোঝাই করে আনতে ব্যস্ত সময় পার করছে।

মাছের পরিবর্তে মানুষ পার করাই এখন তাদের মূল ব্যবসা। প্রতিজন থেকে ৫ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। যারা টাকা দিতে পারছে না অথবা টাকার পরিমাণ কম তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে স্বর্ণালঙ্কার, টাকা, কাপড়-চোপড়সহ যাবতীয় মূল্যবান সামগ্রী।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এ অভিযোগে গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকজনকে সাজাও দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর মানুষ তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা করছেন। এসব নিরীহ মানুষগুলো তাদের ভয়ে সব শর্ত মেনে নিচ্ছে। আর এ সুযোগে দিনের পর দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এসব মাঝি ও জেলেদের সিন্ডিকেট।

দৃশ্যমান শত্রুকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশে আসা এসব শরণার্থীর অসহায়ত্বের সুযোগে লুট হয়ে যাচ্ছে শেষ সম্বল। কয়েকজনের এসব সিন্ডিকেট অসহায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আনা জিনিসপত্র কিনে নিচ্ছে সস্তা দামে। নিত্যপণ্য থেকে সর্বক্ষেত্রে চলছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। এ যেন রোহিঙ্গাদের নিয়ে নির্দয় বাণিজ্য।

সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে আসা নারীরা ২২ ক্যারেটের স্বর্ণ বিক্রি করছে প্রতি ভরি ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায়। বাধ্য করা হচ্ছে তাদের স্বর্ণ বিক্রি করতে। অন্যথায় ছিনিয়ে নেয়ার হুমকি দিচ্ছে ঐসব সিন্ডিকেট সদস্যরা। যাদের নাকি এমনিতেই দেখতেই ভয় লাগে বলে জানিয়েছে রোহিঙ্গা মহিলারা।

মানবিক এই মহাবিপর্যয়ের সময় সীমান্ত এলাকার অনেক মানুষ রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়ালেও মুনাফালোভীরা সিন্ডিকেট তৈরি করে হাতিয়ে নিচ্ছে সব। গত কয়েক দিনে টেকনাফ-উখিয়ার নয়াপাড়া, শাহপরী দ্বীপ, পালংখালী, বালুখালী, উনচিপ্রাং, হোয়াইক্যং শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থানরত শরণার্থীদের সাথে কথা বলে এসব চিত্র পাওয়া গেছে।

টেকনাফ উখিয়ার ৫টি, নয়াপাড়ার ২টি, শাহপরী দ্বীপের ২টি পয়েন্ট অন্তত ১৪টি সিন্টিকেটের অবস্থান করছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সন্ধ্যা পার হলেই বের হয় তারা। সাথে থাকে টর্চলাইট। রোহিঙ্গাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের জিনিসপত্র সস্তা দামে কেনাই তাদের কাজ। কেউ বিক্রি করতে না চাইলে কেড়ে নেয়ারও অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে।

হোয়াইক্যং ও লাম্বার বিল সীমান্ত পার হয়ে রাস্তার পাশে অবস্থান করছিলেন জসিম উদ্দিন। সাথে বউ আর বাচ্চারাও রয়েছে। কথা হলে তিনি বলেন, প্রাণ নিয়ে বেঁচে এসেছি। কিন্তু সীমান্তে কিছু লোক আমাদের জিনিসপত্র কিনতে চায়। আমি জিনিসপত্র বিক্রি না করে বিক্রি করলাম টাকা। ১৭ হাজার মায়ানমারের টাকা তাদের হাতে দিলাম, তারা আমাকে দিয়েছে ১৩শ টাকা। তাদের উগ্র মেজাজে আমি ভয় পেয়ে গেছি।

বাংলাদেশের ১ টাকায় মায়ানমারের ১৬ টাকা হিসেবে প্রতি লাখে ১৬ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু দেয়া হচ্ছে লাখে আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা। রক্তচোষা দালালচক্রের ভয়ে পানির দরে জিনিসপত্র বিক্রি করে দিত বাধ্য হচ্ছেন রোহিঙ্গারা।

ঐসব সিন্ডিকেট সদস্যদের হাত ধরেই রোহিঙ্গাদের হাতে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশি মোবাইল সিম। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া রোহিঙ্গারা স্বজনদের সাথে যোগাযোগে মোবাইল ব্যবহারের আকুলতার সুযোগে বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই এসব সিম বিক্রি হচ্ছে ৫শ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাথে থাকা গরু-ছাগল, মহিষ যেন একেবারে পানির দরে কিনছে বাংলাদেশি এসব সিন্ডিকেট সদস্যরা। ৬০ হাজার টাকার গরু বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ১০ হাজার টাকায়। মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী আব্দুল মালেক একটি ষাঁড় ও একটি গাভি বিক্রি করেছেন মাত্র ৩২ হাজার টাকায়। ছাগলের দাম আরও কম। ৫শ থেকে ৬শ' টাকা দিয়েও এখন ছাগল বেচা-কেনা হচ্ছে সীমান্তের এসব পয়েন্টে।

এব্যাপারে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক বলেন, যারা নিরহ মানুষদের নিয়ে খেলবে তাদের অবশ্যই গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে সাজা দেয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

ভয়াল মৃত্যু প্রতিদিন তাড়া করছে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীদের। আগুন, গুলি আর মৃত্যুর হানা থেকে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন তারা। বাঁচার আকুতি আর মনোবলকে সম্বল করে ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছেন তারা। হাতের কাছ জমানো টাকা-স্বর্ণালঙ্কারের পাশাপাশি হাতের কাছে থাকা পোষা প্রাণীগুলোও নিয়ে আসছেন সাথে করে। তবে সীমান্ত পাড়ি দিলেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ওঁৎ পেতে আছে বাংলাদেশর অন্য শত্রুরা। যাদের কাছ থেকে রক্ষা পাওয়াও রীতিমতো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।-জনতা

পিএনএস /জে এ মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন