যৌন সন্ত্রাসের শিকার রোহিঙ্গা নারীরা কী করবে?

  21-09-2017 11:18AM


পিএনএস, কক্সবাজার: মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। স্যানিটেশনের অভাব, গোসলের পানি তো দূরের কথা। নেই বিশুদ্ধ পানিও। কয়েক দিনের একটানা বৃষ্টিতে সবখানে নোংরা পরিবেশ। দুর্গন্ধ বাতাসে। এমতাবস্থায় সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গা আশ্রিত উখিয়া টেকনাফের এলাকাগুলোতে। আক্রান্ত হচ্ছে সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া, জ্বর, ডায়রিয়া ও চর্মরোগসহ নানা রোগে।

বুধবার উখিয়ার উপজেলায় রোহিঙ্গা আশ্রিত বিভিন্ন পরিদর্শনে দেখা গেছে বৃষ্টিতে সব তাঁবুতে এবং সবখানে স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থা। কোথাও জমাটবদ্ধ পানি। পরিবেশ এমন পচেগলে গেছে যে সেখানে মানুষ তো দূরের কথা কোনো জীব জন্তুর পক্ষেও বসবাস করা কঠিন হবে। এমনি এক পরিবেশের পলিথিনের তাঁবুর নিচে ঘুম, খাবার, বৃষ্টির জমে যাওয়া পানিতে থালা বাসন ধোয়া, এখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ। পানির অভাবে গোসল নেই অনেক দিন। শিশু ও পুরুষেরা তো এখানে সেখানে মলমূত্র সেরে নিচ্ছে কিন্তু মহিলাদের কষ্টের সীমা নেই, তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে রাতের অন্ধকারের জন্য। অন্ধকার নামলেই কেবল তারা প্রাকৃতিক কাজে যেতে পারছেন। প্রতি তাঁবুতে রোগ ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ায় স্বাস্থ্যকর্মীদের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। সেখানেও দীর্ঘ লাইন। অবস্থা এমন হয়েছে জরুরিভাবে ব্যবস্থা না নিলে রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

কুতপালংয়ের কাছে একটি পলিথিনের তাঁবুতে স্বামী সন্তানসহ পাঁচ জনের বসবাস রোহিঙ্গা নারী জয়নবের (২৪)। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে খাওয়া দাওয়া ও বিশ্রাম। আবার সেখানেই মলমূত্র ত্যাগ। ১৫ দিন ধরে কেউ গোসল করতে পারেনি। তিন চার দিন ধরে সন্তানসহ জয়নব সর্দি, জ্বর ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। এরকম অবস্থা সব রোহিঙ্গা পরিবারের। সঠিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ না পাওয়ায় রোগ ব্যাধি ছাড়াচ্ছে গণহারে। এক বেলা আহারের সাথে রোহিঙ্গাদের এখন লড়তে হচ্ছে রোগ ব্যাধির বিরুদ্ধেও। আক্রান্তরা আশ্রয়স্থল কিংবা অনেক দূরে মেডিকেল ক্যাম্পে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। মেডিকেল ক্যাম্প পরিচলনাকারী ডাক্তার ও স্বাস্থকর্মীরা রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। চিকিৎসা দিলেও ঘাটতি থাকায় অনেককে ওষুধ দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না।

বুধবার দুপুরে কুতুপালংয়ের একটি পাহাড়ের স্থাপিত হোপ ফাউন্ডেশনের একটি মেডিকেল ক্যাম্পে দেখা যায় রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ লাইন। এদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। লাইনে দাঁড়ানো মায়ের কোলের শিশুরা সর্দি কাশির সাথে ডায়রিয়াও আক্রান্ত। প্রত্যেকের জ্বর ও ডায়রিয়া। সেখানে এক স্বাস্থ্যকর্মী জানান, ঠাণ্ডাজনিত রোগ ছাড়াও ডায়রিয়া চর্মরোগ ও বহু যক্ষ্মা রোগী পাওয়া যাচ্ছে। রইক্ষ্যং এলাকায় বিজিবি পরিচালিত মেডিকেল ক্যাম্পের পরিচালক লে.কর্নেল ডা. নুরে আলম জানান, চিকিৎসা নিতে আসা রোহিঙ্গাদের মাঝে ডায়রিয়া চর্ম রোগ ছাড়াও অনেক যক্ষ্মা রোগী পাওয়া যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা এসব রোগীর তাৎক্ষণিক রক্ত পরীক্ষা করছি ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস বি সি জাতীয় রোগ ধরা পড়লে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তিনি আরো বলেন, রোগগুলো সংক্রামক আকারে ছড়াতে পারে।

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী জানান, এখন প্রতিদিন অনেক রোহিঙ্গা জটিল রোগ নিয়ে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন। তাদের চিকিৎসা দিতে কোনো গাফলতি করা হচ্ছে না। গত সোমবার একজন (পরিচয় গোপন রাখা হলো) এইডস রোগীও ভর্তি হয়েছেন সদর হাসপাতালে। ধর্ষণের কারণে নানা জটিলতায় আক্রান্ত রোগীরাও আসছে সদর হাসপাতলে। এসব রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীরা।

কক্সবাজার জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের মাঝে এ পর্যন্ত ২৬ জন পোলিও, ১৬ জন হাম ও অসংখ্য চর্ম রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এ পরিসংখ্যান কয়েক দিন আগের। এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মেজবাহ উদ্দিন আহমদও জানান, কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে পোলিও রোগী পাওয়া যাওয়ার কথা।

তিনি জানান, ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ পোলিও মুক্ত রয়েছে। কিন্তু শরণার্থীদের মাধ্যমে এসব রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

এদিকে ২৫ আগস্টের পর থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা গোসলও করতে পারেনি। তাদের শরীর থেকে এক ধরনের দুর্গন্ধের জন্য তাদেরও দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। আক্রান্ত হচ্ছে নানা চর্মরোগে। কুতুপালংয়ের অনিবন্ধিত একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি আবদুর রশিদ জানান,তাদের ক্যাম্পে প্রায় দশ হাজার রোহিঙ্গা গত ২০ দিন ধরে গোসল করতে পারছে না পানির অভাবে। খাবার পানিরও তীব্র সংকট। এছাড়া টয়লেট না থাকায় মহিলাদের বেশি কষ্ট হচ্ছে। রাতের অন্ধকার হলেই তারা প্রাকৃতিক কাজে যেতে পারছে কিন্তু দিনের আলোতে তাদের কষ্টের সীমা থাকছে না।

যৌন নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা নারীরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারীদের জন্য আলাদা চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় ওই সব নারী মারাত্মক কষ্টে রয়েছে। লোকলজ্জার ভয়ে তারা এসব কথা সকলকে প্রকাশও করতে পারছেন না বলে জানান এক রোহিঙ্গা নারী। তিনি দুই সন্তানের জননী এবং তার কোলে রয়েছে আট মাসের সন্তান। তিনি আছেন কুতুপালংয়ের একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে।

তিনি জানান, আমাকে বার্মার সেনারা ‘জুলুম’ করেছে। জুলুম মানে কী প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছুটা দ্বিধার সাথে বলেন, ধর্ষণ’। তার মতো অনেক রোহিঙ্গা নারী বাংলাদেশে এসে লোকলজ্জার ভয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে পারছেন না বলে জানান অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী।

অনেক রোহিঙ্গা নারী জানান, বার্মার সেনাবাহিনীর হামলার সময় যারা পালিয়ে গিয়েছিল তারা প্রাণে বেঁচে গেছেন। আর যারা পালাতে পারেননি তারা প্রত্যেকে ‘জুলুমের’ (ধর্ষণ) শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ নিহত হয়েছে কেউ ধর্ষণের যন্ত্রণা নিয়ে প্রাণে বেঁচে আছেন। যারা ইতিমধ্যে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। এক নারী (পরিচয় গোপন রাখা হলো) জানান তার বীভৎস নির্যাতনের কথা। বলেন, ‘জুলুমের’ পর আমরা সীমাহীন কষ্ট সহ্য করে বাংলাদেশে এসেছি। এখানে এসে আমার মতো অনেক নারীই চিকিৎসা নিতে চেয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা পাচ্ছি না। আমি নির্যাতনের পরেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু অনেক মেয়ে আছে যাদের ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা মেজবাহ উদ্দিন আহমদ জানান, এ পর্যন্ত ১৮ জন ধর্ষিতা মহিলা উখিয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। এরকম সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে। লোকলজ্জার ভয়ে অনেক নারী মুখ খুলছেন না বলেই তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি জানান, স্বাস্থ্য কর্মীরা এখন ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন এসব নির্যতিত নারীর। তবে ডা. মেজবাহ উদ্দিন আরো জানান, তাদের সনাক্ত করে চিকিৎসা দিতে না পারলে বড় ধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়বেন তারা।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন