তাঁবু ছেড়ে বাইরে রোহিঙ্গারা

  23-09-2017 12:53PM


পিএনএস, কক্সবাজার: চট বা ত্রিপল নয়। নয় কোনো স্বাস্থ্যকর তাঁবু। লবণ মাঠের পরিত্যক্ত অস্বাস্থ্যকর কালো পলিথিন। তা পানিরোধী হলেও তাপ প্রতিরোধী নয়। আবার তা লবণাক্ত, স্যাঁতসেঁতে ও দুর্গন্ধযুক্ত। ফেলনা পলিথিন। মৃত্যুর তাড়া খেয়ে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে আশ্রয়হারা রোহিঙ্গারা মাথার উপর একটু ছায়ার জন্য মরিয়া। সেই সুযোগটি নিয়েছে উখিয়া-টেকনাফের অসাধু ব্যবসায়ীরা। শয়ে শয়ে সেই নষ্ট পলিথিনের গাদা নিয়ে বিক্রি করতে বসে। বাছ-বিচারের সুযোগটিও না পেয়ে সর্বহারা নিরুপায় রোহিঙ্গারা সেই পলিথিন টানিয়েই তাঁবু গেড়েছে। প্রতিটি ফেলনা পলিথিন কিনতে হয়েছে দুই থেকে তিনশ টাকায়।

বৃষ্টি থেকে সাময়িক রক্ষা পেলেও পলিথিনগুলো প্রচণ্ড উত্তাপ ছড়াচ্ছে। বৃষ্টির সময়ও ভেতরে গরমে টেকা কঠিন হয়ে পড়ছে। তার ওপর ছোট্ট স্থানে অত্যাধিক নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধের গাদাগাদি অবস্থান। এতে অসুস্থ হয়ে পড়ছে তারা। শতাধিক পলিথিনের তাঁবু ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। প্রায় প্রতিটি তাঁবুতে কেউ না কেউ জ্বর, ডায়রিয়া, বমি, সর্দি, খোস-পাঁচড়া, শ্বাসকষ্ট, আমাশয়, নিউমোনিয়া ইত্যাদি এক বা একাধিক অসুখে ভুগছে। এর জন্য অধিকাংশ রোহিঙ্গাই এই অস্বাস্থ্যকর পলিথিনের তাঁবুগুলোকে দায়ী করলেন।
গতকাল শুক্রবার। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিট। সকাল থেকে উত্তাপ ছড়াচ্ছিল সূর্য। কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের বি ও ডি ব্লক পেরিয়ে পশ্চিমে নতুন শরণার্থীদের তাঁবু। হাজার হাজার। যতদূর চোখ যায় তাঁবু আর তাঁবু। পাহাড়, পাহাড়ের ঢাল, সমতল, খালের তীর, সব জায়গায় তাঁবু। এর প্রায় সবই সেই কালো পলিথিনে তৈরি।
কুতুপালং ক্যাম্পের পশ্চিমে লম্বাশিয়া পাহাড়। সেখানে একটি পলিথিনের তাঁবু টানিয়ে আশ্রয় নেন জিয়াবুল। তার বয়স ২৩। তিনিও কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। জিয়াবুল বুথেডংয়ের চানগানা এলাকার ছৈয়দুল ইসলামের ছেলে। তার বাসার ছেলে-বুড়ো সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার পিতা ষাটোর্ধ্ব ছৈয়দুল আমিনও ভুগছেন জ্বরে। তার মা সাজেদা অবশ্য উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত। তার ভাই জিয়া (২৩) এবং বোন খাদিজা (২১) ও ইয়াছমিন সর্দি-জ্বরে ভুগছে। অপর ভাই এনামের গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। পলিথিনের তাঁবুকে পরিবারের সবার অসুস্থতার কারণ বলে ধারণা জিয়াবুলের।

তিনি বলেন, আমরা এত কষ্ট করে দুর্গম পথ দিয়ে বাংলাদেশে আসার পরও সবাই এক সঙ্গে অসুস্থ হইনি। ত্রাণের তাঁবু না পেয়ে বাজারের পলিথিনে ঘর বানিয়ে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু গরমে এর মধ্যে থাকা দায়। বাইরের চেয়ে ভেতরেই বেশি গরম। এজন্য আমরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছি। তাদের তাঁবুর কাছে কোনো নলকূপ এবং টয়লেটও নেই।

কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে অপর এক বোনের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন রাজিয়া (২৭)। তার বাড়ি রাখাইনের মংডুর বালুখালী এলাকার মগনামায়। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসার সময়ই তার স্বামী মোহাম্মদ আলীকে (৩০) মিয়ানমার সেনা সদস্যরা ধরে নিয়ে হত্যা করেছে বলে জানান তিনি। এমন অস্বাস্থ্যকর ঘরে থেকে তার ৫ ছেলে-মেয়েও অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে জানান। তিনি নিজেও জ্বরে আক্রান্ত। তার মেয়ে আসমাউল হোসনা (৯) জ্বরে, ছেলে রুবেল (৮) ডায়রিয়া ও কাশি, মো. রাসেল (৫) ও রেশমী আক্তার (৩) জ্বরে এবং কোলের শিশু জেসমিন আক্তার (১) ডায়রিয়ায় ভুগছে।

তিনি বলেন, নিজেরা কোনো ঘর করতে পারিনি। বোনের পলিথিনের ঘরে এতগুলো শিশু নিয়ে থাকাতে এখন অসুখে ধরেছে।

কুতুপালং নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের ডি-ব্লকের পশ্চিমে পাহাড়ের ঢালে টানানো হয়েছে শত শত পলিথিনের তাঁবু। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কয়েকটি তাঁবুর ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে প্রচণ্ড উত্তাপ। অসহনীয় গরম। তাতে ঘামছে মানুষ। পলিথিন ভেদ করে মাথায় পড়ছে আবছা আলোর প্রতিফলন। চারপাশের বেড়াও পলিথিনের হওয়ায় ঢুকছে না বাতাস। ঘরে হালকা ছায়া থাকলেও গরমের জন্য অপেক্ষা করতে পারছে না লোকজন। একটু বাতাসের জন্য পাহাড়ের ঢালে কয়েক বছর বয়সি গাছের ছোট্ট ডালের নিচে দাঁড়িয়ে-বসে আশ্রয় নিয়েছে মানুষ। নারীদের কোলে শিশু।

সেখানে অন্যদের সঙ্গে তাঁবু টানিয়েছেন বিবুলা খাতুন (৬০)। তার ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ে। সবাই বিবাহিত। ছোট ছেলে ছৈয়দ হোসেনের পরিবারের সঙ্গে থাকেন তিনি। তিন টুকরো পলিথিনে চালা ও চারপাশের বেড়া বানিয়ে একটু আড়াল করেছেন। মিয়ানমারে দীর্ঘদিনের সাজানো সংসার হারিয়ে এটাকেই তারা সাময়িক নিরাপদ আশ্রয় হয়েছে বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু পলিথিনের এই শেষ আশ্রয়টুকু দুঃসহ গরমে অতিষ্ঠ করছে তাদের। এতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন নিজে। সেই সঙ্গে অসুস্থ হয়েছে তার গর্ভবতী পুত্রবধূ নূর নাহার (২০)। এখন একটি চটের তাঁবুর জন্য প্রতীক্ষা করছেন মংডুর সাহেববাজারের মিনগিজি থেকে আসা এই বিধবা। অবশ্য কিছুটা ভেতরের দিকে তাঁবু টানানোয় খাদ্য বা অন্য সহায়তাও পাননি বলে জানান। তিনি সেনা সদস্যদের গুলিতে গ্রামের আরো ১২ জনের সঙ্গে মরতে দেখেছেন তার ভাইপো মো. হোছনকে (৫৪)।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন