পিএনএস ডেস্ক: ঘুট ঘুটে অন্ধকার রাত। সমুদ্রের মধ্যে মাছ ধরা ট্রলারের দু’একটি বাতি টিপ টিপ জ্বলছে। ফুচকা দোকানের বাতির আলোতে হালকা আলোকিত সৈকত। সাগরের পাতলা তুফান ছোট্ট গর্জনে ফেটে আস্তে আস্তে তীরে আচরে পড়ে নিস্তেজ হচ্ছে। সৈকতের ছাতার নিচে বেঞ্চে বসে নৈসর্গিক এসব দৃশ্য উপভোগ করছে আগত পর্যটকরা। একটু পূর্বদিক থেকে কানে ভেসে আসল একতারার সুরের মিশ্রণে বাউল গানের সুর। সুরের টানে কাছে এগুতেই দেখলাম আগত পর্যটকদের বিনোদনের উদ্দেশ্যে বাউল গানের সুর তুলছেন শিল্পী রেজাউল করিম। আর চার পাশে পর্যটকরা ভীর করে গান শুনছেন।
লালনপ্রেমী বাউল রেজাউল করিম কখনও চা বিক্রেতা, কখনও বাঁশিওয়ালা, কখনও গায়ক, কখনও গীতিকার, কখনও সুরকার, কখনও আবার সংগীত শিক্ষক। কুয়াকাটায় সমুদ্র সৈকতে ছোট্ট দোকানে চা-পান-সিগারেট বিক্রয় করেন। ক্ষুদ্র ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে পান পাতায় লালন সাঁইজির গানে সুর তুলেন এ বাঁশির যাদুকর। একতারা হাতে বাউল পোশাকে মঞ্চ মাতিয়ে তোলেন সঙ্গীতপ্রেমী বাউল রেজাউল করিম শাহ।
রেজাউল করিম শাহ'র সুরে বিমোহিত হন কুয়াকাটায় আগত পর্যটকরা। সৈকতে চা পান বিক্রির ফাঁকে পান পাতা দিয়ে লালন সাঁইজির গানে সুর তোলেন তিনি। পর্যটকরা সাগরের উম্মাদনার পাশাপাশি পাতার সুরে বিনোদনের এক নতুন মাত্রা খুঁজে পেয়েছেন। সুরে মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় নানা পেশাজীবী মানুষ রুটিন করে তার চায়ের দোকানে ভিড় জমায়। পান পাতায় সুর তুলে অথবা গান গেয়ে পর্যটকদের মনে আনন্দ দিতে পারলেই তার আনন্দ।
সঙ্গীতপ্রেমী এ মানুষটি বাগেরহাট জেলার মংলা থানার গোয়ালীর মাঠ এলাকা থেকে তিন বছর আগে কুয়াকাটায় বেড়াতে আসেন। সদালাপী ওই অভাবী মানুষটি স্থানীয় সংগীত প্রেমীদের নজরে আসলে অস্থায়ীভাবে একটি পরিত্যক্ত ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়। রুটি রুজির জন্য সে কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন এলাকায় চা-পানের দোকান দেয়। আর দোকানে বসে লালনের গানের পাশাপাশি নিজের লেখা গানেও সে পান পাতায় ব্যতিক্রমী সুর তুলে পর্যটকদের মাতিয়ে রাখেন।
স্থানীয়রা জানায়, গান, গল্প ও আড্ডার ফাঁকে চলে বিপণনের কাজ। বে-হিসেবি মানুষটি দরকষাকষি না করেই ক্রেতারা যা পরিশোধ করে তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। প্রায়ই ভুলে যান আপ্যায়িত ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা নিতে। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে তার বিকিকিনি।
এক সময় খুলনা বেতারের নিয়মিত গান পরিবেশন করলেও দূরত্ব ও খরচের জন্য এখন যাওয়া হয় না তার। অনেকে আবার চা-পান ও সিগারেট খাবার ছলে একটা গান শোনার জন্য অনুরোধ করে বসেন। গত বছর ঢেউ নামের একটি নাটকে তার অভিনয়সহ গানের চিত্র ধারণ করেছে একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। যা মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে ধারাবাহিক সম্প্রচার করছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
এছাড়া কুয়াকাটায় কোন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর পেলেই তিনি সেখানে ছুটে যান। নিজের লেখা গান ও মুখে পান পাতার সুর দিয়ে মাতিয়ে রাখেন দর্শকদের। এসব কারণে অল্প সময়ে তিনি এখন সব মানুষের পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে।
লালনপ্রেমী রেজাউল করিম শাহ বলেন, অনেকটা অভাবের তাড়নায় কুয়াকাটায় আসা। লালন সাঁইজিকে অন্তরে লালন করার চেষ্টা করছি এমন দাবি করে তিনি আরো বলেন, মানুষকে সেবা ও বিনোদন দিতে পারলেই স্বার্থক।
বয়সের ভারে নুব্জ ওই ব্যক্তির সামান্য আয়ে বড় ছেলে রহমাত আলী সবুজ বাগেরহাট পিসি কলেজ থেকে অনার্স শেষ করে মংলা সরকারি কলেজে মাস্টার্সে অধ্যায়নরত এবং ছোট ছেলে ওমর ফারুক সজিব মংলা সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। তার একমাত্র মেয়েকে অনেক আগেই বিবাহ দিয়েছেন বলে তিনি জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, কুয়াকাটা সৈকতে বেড়াতে এসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি রেজাউল করিম শাহ'র পান পাতার সুর শুনে বিমোহিত হয়েছেন।
কুয়াকাটা খানাবাদ কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও বিচ রোটারি ক্লাবের সভাপতি সঙ্গীত শিক্ষক শহিদুল ইসলাম শাহিন বলেন, ‘যখন সুযোগ পাই তখনই তার দোকানে পাতার সুর শুনতে যাই। সত্যিই অসাধারণ ও অভিন্ন প্রতিভা রয়েছে রেজাউল করিম শাহ।’
কুয়াকাটা প্রেস ক্লাব সভাপতি নাসির উদ্দিন বিপ্লব বলেন, ‘লালনপ্রেমী মানুষটির গুণগান শুনে অসংখ্যবার তার দোকানে গিয়ে চা বিস্কুট খেয়েছি এবং গান ও পান পাতার সুর শুনে সত্যিই ভালো লেগেছে।’
পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম
কুয়াকাটায় যেন সে সুরের জাদুকর
19-11-2017 11:52PM